সীমান্তবর্তী সিলেটের একেবারে কাছেই অবস্থান ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ের। সিলেটের তামাবিল সীমান্ত পেরোলেই ওপারে শিলংয়ের পথ। শিলংয়ে জুয়াড়িদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় জুয়ার আসর হচ্ছে 'তীর'। ১ থেকে ৯৯ পর্যন্ত সংখ্যাভিত্তিক এই জুয়া এখন মহামারি রূপে ছড়িয়ে পড়েছে সিলেটজুড়ে। শুরুতে নির্দিষ্ট দু/একটি জায়গায় এ সর্বনাশা জুয়ার আসর বসলেও এখন তা লাগামহীন। গত প্রায় দুই বছরে সিলেট মহানগরীর অর্ধশতাধিক স্পট এবং বিভিন্ন উপজেলায়ও ছড়িয়ে পড়েছে ভয়ঙ্কর এই ‘শিলং তীর’ নামক জুয়ার আসর।
চেষ্টা করেও ‘শিলং তীর’র ভয়ঙ্কর ছোবল রুখতে পারছে না পুলিশ। এ জুয়া অনলাইনভিত্তিক হওয়ায় এবং জুয়াড়িরা মোবাইলের মাধ্যমে পরস্পর যোগাযোগ রাখায় পুলিশ এদের রুখতে পারছে না।ফলে মাঝে মধ্যে চিহ্নিত জুয়ার স্পটে অভিযান চালিয়ে কয়েকজন জুয়াড়িকে আটক করার মধ্যে সীমাবদ্ধ পুলিশের তৎপরতা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারতের শিলং থেকে ‘শিলং তীর’ নামক জুয়া বছর কয়েক আগে সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাটে বিস্তার লাভ করে। এসব উপজেলা থেকে গত প্রায় দুই বছরে এ জুয়াটি মহামারি রূপে ছড়িয়ে পড়তে থাকে সিলেট মহানগরী ও অন্যান্য উপজেলাগুলোয়। বর্তমানে শুধুমাত্র সিলেট মহানগরীর অন্তত অর্ধশত স্পটে বসে ভয়ঙ্কর এ জুয়ার আসর। এসব আসরে লাভের আশায় টাকা খরচ করা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষরা সর্বস্বান্ত হয়ে ফিরেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, শুরুর দিকে সিলেট নগরীর বিমানবন্দর থানাধীন বড়শালা এলাকায় ‘শিলং তীর’র আসর বসতো। শুরুতে কৌশলী জুয়াড়িরা সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়াতে দেদারসে জুয়ায় টাকা ঢালতে থাকে। এতে রিকশাচালক, দিনমজুর শ্রেণির মানুষদের ভিড় বাড়ে জুয়ার আসরে। ১০ টাকায় ৭০০ টাকা, ২০ টাকায় ১৪০০ টাকা তথা প্রতি টাকার বদলে ৭০ গুণ লাভ পেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মানুষ। ক্রমেই সর্বনাশা এ জুয়ার বিস্তার ঘটতে থাকে সিলেটজুড়ে।
জানা যায়, বর্তমানে সিলেট নগরীর কাজিরবাজার, সুরমা মার্কেট, করিম উল্লাহ মার্কেট, বালুচর, বড়বাজার, বন্দরবাজার, রিকাবিবাজার, তালতলা, মদিনা মার্কেট, লালদিঘীরপাড় হকার্স মার্কেট, সিটি মার্কেট, শাহী ঈদগাহ, আম্বরখানা, শেখঘাট, মালনীছড়া চা বাগান, কুয়ারপাড়, চাঁদনিঘাট, দক্ষিণ সুরমার কদমতলিস্থ বালুর মাঠ, পুরাতন রেলস্টেশন এলাকা, লাউয়াই, কামালবাজারসহ অর্ধশত স্পটে প্রতিদিন বসে ‘শিলং তীর’র জুয়ার আসর।
এসব জুয়ার আসরে রিকশাচালক, দিনমজুর, শিক্ষার্থী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে জুয়ার নেশায় মত্ত বড় ব্যবসায়ীরাও টাকা ঢালছেন। হাতেগোণা কয়েকজন জুয়ার আসর থেকে হাসিমুখে ফিরলেও সিংহভাগই ফিরেন টাকা খুইয়ে।
‘শিলং তীর’ জুয়ার আসর সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, মূলত এটি একটি কৌশলগত জুয়া। টাকা হাতিয়ে নেওয়ার একটি বিরাট ফাঁদ এটি। এ জুয়ার আসর থেকে সাধারণ মানুষ যাতে মুখ ফিরিয়ে না নেন, সেজন্য প্রতিদিনই কয়েকজনকে জুয়ার বাজিতে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শিলংয়ের জুয়াড়িদের সাথে সিলেটের জুয়াড়িদের যোগাযোগ রয়েছে। শিলংয়ের জুয়াড়িরা সিলেটের শীর্ষ জুয়াড়িদের মাধ্যমে বেশ কিছু এজেন্ট নিয়োগ করেছে। এসব এজেন্টদের মাধ্যমেই সিলেটজুড়ে ‘শিলং তীর’ পরিচালিত হচ্ছে।
এ জুয়ায় ১ থেকে ৯৯ পর্যন্ত সংখ্যা দিয়ে বাজি ধরতে হয়। একটি সংখ্যার বিপরীতে সর্বনিম্ন ১০ টাকা থেকে বাজি ধরা শুরু হয়। বাজির সর্বোচ্চ অংক অনির্ধারিত। ১ থেকে ৯৯ সংখ্যাগুলোর মধ্যে যে নির্দিষ্ট সংখ্যায় বাজি ধরা হয়, সে সংখ্যা যদি বিজয়ী হয়, তবে বাজি ধরা ব্যক্তি নির্দিষ্ট টাকার ৭০ গুণ বেশি পান। অর্থাৎ, কেউ যদি এক হাজার টাকায় বাজি ধরে বিজয়ী হন, তবে তিনি পান ৭০ হাজার টাকা। বাজিতে প্রাপ্ত টাকার অংক কম হলে সাথে সাথেই পরিশোধ করা হয়। টাকার অংক বেশি হলে পরদিন তা পরিশোধ করা হয়। একই ব্যক্তি একাধিক সংখ্যা নিয়ে জুয়া খেলতে পারেন।
সূত্র জানায়, প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে ‘শিলং তীর’র জুয়া। শিলংয়ের সাথে মিলিয়ে সিলেটে সপ্তাহে রবিবার ছাড়া বাকি ছয়দিনই এ জুয়ার আসর বসে। এছাড়া ভারতের রাষ্ট্রীয় ছুটির দিনে এ জুয়ার আসর বন্ধ থাকে। প্রতিদিন বিকাল ৫টায় জুয়ার ফলাফল ঘোষণা করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, www.teercounter.com, www.teerresults.com, gravatar.com, www.meghalayateer.com, nightteer.com, www.teerresulttoday.com প্রভৃতি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ‘শিলং তীর’র জুয়ার আসর পরিচালিত হচ্ছে। এসব সাইট বাংলাদেশে বন্ধ করে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) পুলিশ চিঠি দিলেও কাজ হয়নি এখনও।
যেমনটি বলছিলেন সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুজ্ঞান চাকমা, ‘শিলং তীর নামক জুয়া মূলত ওয়েবসাইটের মাধ্যমে চলে। পুলিশ কিছু ওয়েবসাইট চিহ্নিত করে সেগুলো বন্ধের জন্য বিটিআরসিকে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে। তবে সাইটগুলো এখনও বন্ধ হয়নি।’
পুলিশের পক্ষ থেকে ‘শিলং তীর’র ওয়েবসাইটগুলো বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিটিআরসিকে আবারও চিঠি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা।
পুলিশ বলছে, যেসব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ‘শিলং তীর’ নামক চলে, সেগুলো যদি বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব হয়, তবে এ জুয়ার মহামারি রোধ করা সম্ভব হবে।
পুলিশ আরও বলছে, ‘শিলং তীর’র বিভিন্ন আসরে প্রায় নিয়মিতই অভিযান চালানো হয়। এতে জুয়াড়িরা ধরাও পড়ে। কিন্তু পরবর্তীতে এরা জামিনে বেরিয়ে এসে ফের এ জুয়ায় লিপ্ত হয়।
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জেদান আল মুসা বলেন, ‘পুলিশ শিলং তীরের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালায়। অভিযানে জুয়াড়িরা ধরা পড়ে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়, আদালতে পাঠানো হয়। তবে কিছুদিন পরই এরা জামিনে বেরিয়ে এসে ফের জুয়ায় জড়িয়ে পড়ে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিলং তীর বন্ধ করতে হলে কিছু ওয়েবসাইট বন্ধ করতে হবে। সেগুলো বন্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের মাধ্যমে আমরা বিটিআরসিকে অবহিত করেছি।’
বিডি-প্রতিদিন/০৬ জুলাই, ২০১৭/মাহবুব