১৪ আগস্ট, ২০২০ ১৭:৫৮

পিটুনিতে তিন কিশোর নিহত; কী হয়েছিল যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে

তদন্ত কমিটি গঠন

নিজস্ব প্রতিবেদক, যশোর

পিটুনিতে তিন কিশোর নিহত; কী হয়েছিল যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে

সংগৃহীত ছবি

যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বেধড়ক পিটুনীতে তিন কিশোর নিহতের ঘটনার তদন্তে দুই সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে সমাজ সেবা অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) যুগ্মসচিব সৈয়দ মো. নূরুল বাসিরকে তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্য হলেন অধিদপ্তরের প্রতিষ্ঠান-২ এর উপপরিচালক এমএম মাহমুদুল্লাহ। 

সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শেখ রফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক আদেশে আগামি তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য কমিটিকে বলা হয়েছে।  

এর আগে সকালে এ ঘটনায় ওই কেন্দ্রের ১০ কর্মকর্তা, কর্মচারী ও আনসার সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ অফিসে নেওয়া হয়। বিকেল পর্যন্ত কাউকে আটক দেখানো হয়নি। যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ) তৌহিদুল ইসলাম জানান, জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পরবর্তী কার্যক্রম নির্ধারণ করা হবে। তবে যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তাদের নাম-পরিচয় জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হওয়ার আগে জানাতে চাননি তিনি।

এদিকে বৃহস্পতিবারের ঘটনায় নিহত তিনজনের মরদেহ বিকেল পর্যন্ত যশোর জেনারেল হাসপাতাল মর্গে ছিল। আইনী প্রক্রিয়া শেষে মরদেহ নেওয়ার জন্য সেখানে ছিলেন নিহতদের স্বজনরা। বিকেল পর্যন্ত থানায় এ ব্যাপারে কোন মামলাও হয়নি। তবে নিহতদের স্বজনরা মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

বৃহস্পতিবার যশোর শহরতলীর পুলেরহাটে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বেধড়ক পিটুনীতে সেখানে থাকা তিন কিশোর পারভেজ হাসান রাব্বি (১৮), রাসেল সুজন (১৮) ও নাইম হোসেন (১৭) নিহত হয়। আহত হয় ১৪ জন। সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত কয়েক দফায় নিহতদের মরদেহ ও আহতদের যশোর জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। 

দুই পক্ষের হামলা, নাকি হত্যা করেছেন কর্মকর্তারাই?
যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের প্রবেশন অফিসার মুশফিকুর রহমান বৃহস্পতিবার রাতে বলেন, সেখানে থাকা কিশোররা দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে লাঠিসোটা নিয়ে মারামারি করায় এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। তবে আহত কিশোররা বলছে, কেন্দ্রের কর্মকর্তারাই তাদেরকে পিটিয়ে হতাহত করে। 

পুলিশের খুলনা বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি একেএম নাহিদুল ইসলামের কথাতেও আহত কিশোরদের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে। রাতে দীর্ঘসময় ওই কেন্দ্রের ভেতরে থেকে পুরো বিষয় পর্যবেক্ষণ করে গভীর রাতে বের হওয়ার সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বৃহস্পতিবারের ঘটনা একপক্ষীয়। তিনি বলেন, আহতদের কথার সত্যতা ও যৌক্তিকতা রয়েছে। পুলিশের অনুসন্ধানে আহতদের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে।

চুল কাটা নিয়ে বিরোধের সূত্রপাত!
প্রাথমিকভাবে জানা যাচ্ছে যে, গত ৩ আগস্ট কেন্দ্রের হেড গার্ড আনসার সদস্য নূর ইসলাম তার চুল কেটে দেওয়ার জন্য চুয়াডাঙ্গা থেকে আসা কিশোর পাভেলকে বলেন। কিন্তু পাভেল আরও অনেকের চুল কেটে দেওয়ায় তার হাত ব্যথা করছে জানিয়ে আনসার সদস্য নূর ইসলামকে বলেন যে তার চুল সে পরে কেটে দেবে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নূর ইসলাম পাভেলকে গালিগালাজ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে কেন্দ্রে থাকা কয়েকজন কিশোর নূর ইসলামকে মারধর করে। এ ঘটনায় নূর ইসলাম অফিসে অভিযোগ করেন যে কিশোররা মাদক সেবন করে তাকে মারপিঠ করেছে।

বৃহস্পতিবারের ঘটনায় আহত পাভেল যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সাংবাদিকদের কাছে বলেছে যে ওই ঘটনার পর বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে তাকেসহ আরও কয়েকজন কিশোরকে অফিসে ডেকে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়। কর্মকর্তাদের পুরো ঘটনাটি জানানোর পর কেন্দ্রের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহসহ আরও কয়েকজন কর্মকর্তা একসাথে তাদের মারপিট করেন।

অসন্তোষের তুষ জলছিল আগে থেকেই:
যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে এ ধরণের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। প্রায়ই এখানে থাকা কিশোরদের লাশ উদ্ধার, মারপিট ও পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। থাকা-খাওয়াসহ নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় এখানকার কিশোরদের মাঝে অসন্তুষ্টি ছিল অনেক আগে থেকেই। ২০১৪ সালে মে মাসে এক সপ্তাহের ব্যবধানে এখান থেকে পালিয়ে যায় ৮ কিশোর, যাদের ৬ জনই হত্যা মামলায় আটক হয়ে আদালতের মাধ্যমে এই কেন্দ্রে এসেছিল। উচু প্রাচীরের মাধ্যমে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীতে থাকা এই কেন্দ্রের নাম যাই হোক না কেন, কার্যত এটি কারাগার। এই কারাগারের নাম সংশোধনী কেন্দ্র হলেও শিশু-কিশোরদের ওপর প্রায়ই নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ আছে। যে কারণে সংশোধন হওয়ার পরিবর্তে এখানে থাকা শিশু-কিশোররা আগের চেয়ে আরও বেশি অপরাধপ্রবণ ও হিংস্র হয়ে উঠছে। সর্বশেষ ঘটনায় ১৪ জন হতাহত হওয়া তারই প্রমাণ দেয়। এর আগে মারপিটের একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি কেন্দ্রটি পরিবেশ ও আনুষঙ্গিক বিষয় উন্নত করার জন্য একগুচ্ছ সুপারিশ করেছিল। কিন্তু তারপরও পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি।

বৃহস্পতিবারের ঘটনায় আহত কিশোররা যা বলছে:
যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে নোয়াখালীর কিশোর বন্দি জাবেদ হোসেনকে। সে জানায়, অন্য বন্দিদের সাথে স্যাররাও লোহার পাইপ, বাটাম দিয়ে তাদের কুকুরের মতো পিটিয়েছে। জানালার গ্রিলের ভেতর হাত ঢুকিয়ে বেঁধে, পা বেঁধে এবং মুখের ভেতর কাপড় দিয়ে মারা হয়েছে তাদের। মারতে মারতে কেউ অজ্ঞান হয়ে গেলে তাকে ভবনের বাইরে গাছতলায় ফেলে রেখে আসছিল। জ্ঞান ফিরলে নিয়ে একে আবার একই কায়দায় মারপিট করেছেন। বৃহস্পতিবারের ঘটনায় নিহত রাসেলের সাথে একই রুমে থাকতো যশোরের বসুন্দিয়া এলাকার বন্দি ইষান। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইষান জানায়, আগামী মাসেই রাসেলের জামিনে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। স্যারদের মারপিট আর চিকিৎসা না পেয়ে সে মারা গেছে। 

ইষান জানায়, ‘মারধরের সময় প্রবেশন অফিসার বলেন, তোদের বেশি বাড় বেড়েছে। জেল পলাতক হিসেবে তোদের বিরুদ্ধে মামলা করে ক্রসফায়ারে দেওয়া হবে’। আহত কয়েকজন অভিযোগ করেছেন, মারধরের পর তাদেরকে সেখানেই দীর্ঘক্ষণ ফেলে রাখা হয়েছিল। পরে একজন করে মারা যাচ্ছিল, আর লাশ হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছিল। এরপর রাত ৮টা থেকে ১১টার মধ্যে চার দফায় আহতদের হাসপাতালে আনা হয়। আহতদের চিকিৎসা প্রদানে দীর্ঘসূত্রীতার বিষয়টি খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি একেএম নাহিদুল ইসলামের কথাতেও প্রমাণ হয়। 

বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের পর কেন্দ্রটি থেকে বেরিয়ে যাবার সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে এরকম মর্মান্তিক ও অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটার ৬ ঘণ্টা পর আমরা বিষয়টি অবহিত হয়েছি। এ কারণে মূল ঘটনা উদ্ধার জটিল ও সময়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে’। তিনি বলেন, ‘যারা আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে তারাই মূল সাক্ষী। তাদের কথায় সত্যতা ও যৌক্তিকতাও রয়েছে। আমাদের অনুসন্ধানে তাদের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে’। 


বিডি প্রতিদিন/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর