জীবনের কিছু গল্প হার মানায় সিনেমার চিত্রনাট্যকেও। সুইজারল্যান্ডের ম্যারিও কুলসুমের গল্পটাও এমনই। বহু বছর আগে পারিবারিক অসচ্ছলতায় পাঁচ বছর বয়সে ঠাঁই মেলে অনাথ আশ্রমে। এরপর তাকে দত্তক নেন এক সুইস দম্পতি। কিছুদিনের জন্য দেশে ফিরেছিলেন শেকড়ের টানে। আবছা স্মৃতিতে খুঁজে ফিরছিলেন হারিয়ে যাওয়া আপনজনকে।
১৯৭৭ থেকে ২০২২ সাল। দীর্ঘ ৪৫ বছরের হাহাকার শেষ হয়েছে। এত বছর পরে নিজের মাকে মা বলে ডাকতে পেরেছেন কুলসুম। চলতি বছরে সুইজারল্যান্ড থেকে দেশে এসে নিজের পরিবারকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন ম্যারিও কুলসুম। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ডিএনএ ল্যাবে মাফিয়া বেগম আর তার ছোট ছেলে সেলিমের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। আর কুলসুমের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষা করা হয় সুইজারল্যান্ডে। এরপর পরিবারকে ফিরে পাওয়ার দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষার অবসান ঘটে। এবারই প্রথম সিআইডি ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে দীর্ঘ বছর পর আত্মীয়তার বন্ধন উদঘাটন করেছে। সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবের বিশেষ পুলিশ সুপার রুমানা আক্তার বলেন, কুলসুম, মাফিয়া ও সেলিমের তিনটি ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া যায়। এসব প্রোফাইল বিশ্লেষণের পর দেখা যায় মাফিয়া এবং সেলিম সত্যিকারই কুলসুমের মা ও ভাই। সিআইডির ডিএনএ পরীক্ষার ফল জানার পরই আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়েন কুলসুম। ফল জানার পর মাফিয়া বেগমের সঙ্গে ভিডিও কলে কথাও বলেন কুলসুম। মোবাইল ক্যামেরায় একে অপরকে দেখে কান্নায় জড়িয়ে পড়েন। নিজের মাকে ফিরে পেয়ে আনন্দে কিছুতেই যেন কান্না থামছিল না কুলসুমের। ৪৫ বছর আগের গল্পটা শুরু যখন কুলসুমের বয়স মাত্র পাঁচ। আগুনে পুড়েছে ঘর, বাবা মৃত, সচ্ছল নয় সংসারও। টানাটানির জীবন থেকে মেয়েকে উন্নত জীবনের ঠিকানা দিতে চেয়েছিলেন মা। পরে চাচার পরামর্শে কুলসুমের ঠাঁই হয় একটি অনাথ আশ্রমে। তখন ১৯৭৭ সাল। এরপর সুইজারল্যা-ের এক দম্পতি সেই অনাথ আশ্রম থেকে দত্তক নেন কুলসুমকে। সঙ্গে কুলসুমের ছোটবোন শমুকেও। সিআইডি সূত্র জানায়, ৩১ জানুয়ারি মাফিয়া বেগম এবং সেলিমের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি সেই ফল আসে। আর কুলসুমের ডিএনএ পরীক্ষা করা হয় সুইজারল্যান্ডে। দুটি রিপোর্ট সিআইডির ডিএনএ অ্যানালিস্টরা বিশ্লেষণ করে মিল খুঁজে পান। সিআইডির ডিপুটি চিফ ডিএনএ অ্যানালিস্ট আহমাদ ফেরদৌস জানান, তারা কখনই এভাবে স্বপ্রণোদিত হয়ে ডিএনএ পরীক্ষা করেনি। পরিবারকে খুঁজে দিতে এবারই প্রথম তারা পরীক্ষা করে ফলাফল দিয়েছেন। তারা ফল সুইজারল্যান্ডে থাকা কুলসুমকে দিয়েছেন। আগামী এপ্রিলে কুলসুম আসবেন তার মাকে দেখতে। এর আগে ১ জানুয়ারি সুইজারল্যান্ড থেকে ঢাকার দোহার উপজেলায় শেকড়ের সন্ধানে আসেন ম্যারিও। তার সঙ্গে ছিলেন সুইজারল্যান্ডের নাগরিক স্বামী অদ্রে ম্যারিও। এক সপ্তাহ ধরে তারা ঢাকা ও এর আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজনের খোঁজ করেন। কিন্তু সে সময় কুলসুম বাবার নাম ও পরিচয় বলতে পারেনি। শুধু জানিয়েছিলেন, তার বাবা ওষুধের ব্যবসা করতেন। বাবা হঠাৎ মারা যাওয়ায় পাঁচ ভাই-বোনকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন মা। তাই মা তাকে ও তার ছোট বোনকে ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি আশ্রমে রেখে যান। সে সময় তার বয়স পাঁচ বছর হলেও ছোট বোনটির বয়স ছিল তিন বছর। বর্তমানে কুলসুম সুইজারল্যান্ডে শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত। কুলসুমের বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানতে পেরে মাফিয়ার পরিবারের অন্য সদস্যরা সিআইডিতে যোগাযোগ করে ডিএনএ নমুনা দেন। মাফিয়া আর তার সন্তানরা এখন থাকেন রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায়।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল