৩ জুন, ২০২৩ ১৭:০৬

গাছ রোপণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া মেয়রের নাকের ডগাতেই শতাধিক বৃক্ষ কর্তন

অনলাইন ডেস্ক

গাছ রোপণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া মেয়রের নাকের ডগাতেই শতাধিক বৃক্ষ কর্তন

ছবি: জয়ীতা রায়।

সম্প্রতি জোর গলায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম গাছ কাটার বিপক্ষে নিজের অবস্থান ঘোষণা করেন। বলেছিলেন, ‘আমরা বুঝতে পারছি যে কী হিটের (দাবদাহ) মধ্যে আছি। তাই পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় দুই লাখ গাছ লাগাবো। এর জন্য নগরবাসীর সাহায্য ও সহযোগিতা চাই। আর নগরের যে খালগুলো দখল হয়ে গেছে সেগুলো উদ্ধার করে পানি প্রবাহ করার চেষ্টা করছি। গাছ ও পানির প্রবাহ- তবেই ন্যাচার বেজ সলিউশনে আমরা নগরকে ঠাণ্ডা রাখতে পারি।’

তবে সেই মেয়র আতিকের এলাকাতেই সড়ক উন্নয়নের নামে গাছ কাটার মহড়া চলছে। এরইমধ্যে কাটা হয়েছে শতাধিক গাছ।

রাজধানীর মহাখালীর আমতলী থেকে গুলশান-১ পর্যন্ত বীর উত্তম এ কে খন্দকার সড়কে শতাধিক গাছ কাটা হয়েছে। মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে আমতলীর দিকে আসতেই চোখ জুড়াতো নানা রকম গাছের সবুজ শ্যামল দৃশ্যে, এসব গাছের ফুলও নানা ঋতুতে নজর কাড়তো পথাচারীদের। কিন্তু সড়কটির বিভাজক উন্নয়নের নামে ছায়াদানকারী শতাধিক গাছ ইতোমধ্যে কেটে ফেলা হয়েছে। পরিবেশবাদী ও স্থানীয়দের দাবি, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন পরিকল্পিতভাবেই দীর্ঘসময় নিয়ে গাছগুলো কেটেছে।

স্থানীয়রা বলছেন, সড়কটির ৬০টির বেশি গাছ কাটা হয়েছে প্রায় দুই মাস আগে, যেন উন্নয়ন প্রকল্প চলাকালে গাছ কম কাটতে হয়, যেন কারো দৃষ্টিগোচর না হয়। কাটা পড়া গাছগুলোর অধিকাংশই বড়। অন্যদিকে বর্তমানে কাজ চলমান থাকায় গাছগুলোর গোড়ার অংশের মাটি সরাতে হচ্ছে। কোনো কোনো গাছের শিকড়সহ মূল কাটা পড়ছে। ফলে গাছগুলো হেলে পড়ার অজুহাত দেখিয়ে কাটা হচ্ছে। উন্নয়নকাজ যত এগিয়ে যাচ্ছে, তত বেশি গাছ কাটা পড়ছে। সব মিলিয়ে ১০০ এর বেশি গাছ কাটা পড়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের। জানা গেছে এই কাজ শেষ করতে আরও বেশ কিছু গাছ কাটা পড়বে।

স্থানীয়রা বলছেন, কৌশলে গাছগুলোর অধিকাংশই কাটা হয়েছে রাতের আঁধারে। অপসারণ করাও হয় দ্রুত সময়ে। আর এগুলো মেয়রের নতুন দুই লাখ গাছ লাগানোর ঠিক বিপরীত চিত্র।

এ বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মত, মেয়র দুই লাখ গাছ লাগানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়ার তারা ভেবেছিলাম পরিস্থিতিতে বদলাবে। তবে এখন দেখা যাচ্ছে সবই কথার কথা।

বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, মহাখালী-গুলশান রোডের মধ্যবর্তী সড়ক বিভাজকে প্রায় তিনশ’গাছ ছিল। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ও হাসপাতালের সামনের সড়কের ডিভাইডারে চলমান সংস্কারকাজের কারণে অনেক গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক গাছ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ডিভাইডারের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে ৩০টি গাছের গুঁড়ি।

আরেক স্থানীয় বাসিন্দা জানান,  গত ২৬ মে কৃষ্ণচূড়া গাছটি কাটা হয়েছে। ভেকু মেশিন দিয়ে চারপাশের মাটি সরিয়ে ফেলায় গাছটি হেলে যায়। এক পর্যায়ে গাছটি কাটা হয়। বাকি সবগুলো গাছ দুই মাস আগে কাটা হয়েছে।

প্রকল্পে কাজ করা নির্মাণশ্রমিকরা জানান, গাছের কারণে তারা ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না।

এদিকে ডিএনসিসি গাছ কাটার বিদ্যমান আইনও লঙ্ঘন করেছে। বন বিভাগ থেকে প্রয়োজনীয় অনুমতিও নেওয়া হয়নি বলেই জানা গেছে অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে।

বনজদ্রব্য পরিবহন (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০১১ এর ৫ ধারায় বলা আছে সড়ক ও জনপথ, বাঁধ, রেলপথ, সংযোগ সড়ক ইত্যাদি ভূমি থেকে বনজ সম্পদ আহরণ, অপসারণ বা পরিবহন করতে হলে বন বিভাগের অনুমতি প্রয়োজন হয়। তবে সেই আইনের তোয়াক্কা করেনি ডিএনসিসি। অনুমতি না নিয়ে বন বিভাগের অফিসের সামনের গাছ কাটলেও ডিএনসিসির এ কাজে বাধা দেয়নি বন বিভাগ।

নাম প্রকাশ না করতে অনিচ্ছুক এক বন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা ডিএনসিসি থেকে এ ধরনের কোনো আবেদন পাননি এবং এ বিষয়ে কোনো অনুমতিও দেননি।

গাছ কাটার জন্য দায়ী প্রকল্পের ডিজাইনারদের সঙ্গে আলোচনা করে স্থানীয় পরিবেশ উন্নয়নকর্মী জামিল গণমাধ্যমকে বলেন, এ ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা প্রয়োজন। ‘গাছ না কেটে একটি মিডিয়ান স্ট্রিপ তৈরি করা সম্ভব। ’

এদিকে এ উন্নয়ন প্রকল্পটির ঠিকাদার জনি এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজিং ডিরেক্টর দিলীপ জানিয়েছেন, মিডিয়ান স্ট্রিপ নির্মাণের সময় যে গাছগুলো ‘মরে গিয়েছিল’ সেগুলো ডিএনসিসি তুলে নিয়েছিল যেন সেগুলো রাস্তায় না পড়ে। আর তারা কোনো গাছ কাটেনি বলেও এ সময় দাবি করেন।

সার্বিক বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সেলিম রেজা বলেন, আইল্যান্ডের কাজ করতে গিয়ে হয়তো কিছু গাছ হেলে পড়েছিল, ঝুলে পড়েছিল। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সব সময় গাছ কাটার বিপক্ষে। সিটি করপোরেশন এরিয়ায় দুই লাখ গাছ লাগানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে কিছু সড়ক ঠিক করা হয়েছে। যেখানে বীর উত্তম এ কে খন্দকার সড়কও রয়েছে। সড়কটিকে সবুজায়নের উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। শিগগিরই কাজটি শুরু হবে বলে আশা করছি। তখন এ সড়কটিও সবুজায়ন হবে ইনশাআল্লাহ।

ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে, ‘ট্রাফিক অবকাঠামো উন্নয়ন ও সড়ক নিরাপত্তা’ প্রকল্পের আওতায় উন্নয়নকাজে এরই মধ্যে প্রায় ২২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে ডিএনসিসি। চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, গাছ কাটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অপ্রয়োজনীয় মিডিয়ান স্ট্রিপ তৈরি করা উচিত নয়। এটি অর্থের সুস্পষ্ট অপচয়ও বটে।

সম্প্রতি বুয়েটের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগ জানিয়েছে, ঢাকায় ২০ শতাংশ বন প্রয়োজন, যেখানে এ ধরনের স্থান আছে সাড়ে ৮ শতাংশের কম। সচেতন মহল বলছে, উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা প্রয়োজন। তাদের বোঝা উচিত গাছ না কেটেও একটি রোড ডিভাইডার তৈরি করা সম্ভব।

বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোট (বিএনসিএ) সদস্য সচিব মুহাম্মদ আনোয়ারুল হক বলেন, উন্নয়নের নামে এ শহরের যেকোনো গাছ কাটা ও লাগানোর আগে উদ্ভিদবিদদের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। শহরের মানুষগুলোর বাঁচার স্বার্থে গাছ না কেটে আরও বেশি দেশীয় গাছ রোপণ করা প্রয়োজন।
 


বিডি প্রতিদিন/নাজমুল

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর