মূলধনবিহীন ভুয়া কোম্পানির ছড়াছড়ি শেয়ারবাজারে। প্রতি মাসেই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হচ্ছে নামসর্বস্ব কোম্পানি। বেশির ভাগ কোম্পানির তালিকাভুক্তির তিন মাসের মধ্যে ফেসভ্যালুর নিচে চলে আসে শেয়ার দর। গত দুই বছরে শতাধিক কোম্পানি শেয়ারবাজার থেকে টাকা তুলতে আইপিও আবেদন করেছে। এর মধ্যে অন্তত ২০টি কোম্পানির কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। এসব কোম্পানিকে অনুমোদন না দিলেও কয়েকটি কোম্পানি বিভিন্ন ভুয়া তথ্য দিয়ে আইপিও অনুমোদন পেয়েছে।
গত দুই বছরে তালিকাভুক্ত ও অনুমতি পাওয়া কোম্পানি প্রত্যক্ষ পরিদর্শন না করেই মূলধন সংগ্রহের অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রত্যক্ষ পরিদর্শন বিভাগ (এক্সপার্ট প্যানেল) বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে এসব কোম্পানির প্রায় সবকটির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাজার বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, পেইড আপ ক্যাপিটালের অতিরিক্ত মূলধন সংগ্রহের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। গত দুই বছরে যেসব কোম্পানি বাজার থেকে টাকা তুলেছে তার বেশির ভাগই ভুয়া। কোম্পানিগুলো ’৯৬ সালের স্টাইলে শেয়ারবাজার থেকে টাকা লুট করার প্রক্রিয়া চলছে। ১৯৯৬ সালেও একইভাবে শেয়ারবাজার থেকে ছোট পেইড আপ ক্যাপিটালের কোম্পানির তালিকাভুক্ত করে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। পরে এসব কোম্পানির কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে রয়েছে পদ্মা সিমেন্ট, চিক টেক্স, বিডি প্লান্ট, বিডিজিপার, রাইট বলপেনসহ প্রায় দুই ডজন কোম্পানি।
ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর আট মাসে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে ১১টি কোম্পানি। এই ১১ কোম্পানি বাজার থেকে আইপিওর মাধ্যমে তুলেছে প্রায় চারশ কোটি টাকা। তালিকাভুক্তির পর শেয়ার কারসাজি করে দর বৃদ্ধির মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকার ওপর নিয়ে গেছে। এর মধ্যে শাহজিবাজার, কেপিসিসিএল, এএফসি এগ্রোর শেয়ার নিয়ে জালিয়াতি ও কারসাজির অপরাধে পিএফআই, গ্যালাক্সি, শার্প, মোনা সিকিউরিটিজ নামে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে বিএসইসি। ২০১৩ সালে ১৫টি কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা তুলেছে। এর মধ্যে গোল্ডেন হার্ভেস্ট, সামিট পূর্বাঞ্চল, আরগন ডেনিমস, প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল শুরুতে শেয়ার কারসাজির অভিযোগের প্রমাণ পায় বিএসইসি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসইর সাবেক পরিচালক খুজিস্তা নুর-ই নাহরিন বলেন, ক্রেডিট রেটিং কোম্পানি, বিভিন্ন অডিটর ফার্ম কারসাজিতে জড়িত। কয়েকটি কোম্পানির নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে এসব কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এসব কোম্পানির ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ আছে। প্রত্যক্ষ পরিদর্শন করে কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, বিএসইসি কোম্পানি অনুমোদনে আইনগত দুর্বলতার কথা বলে। কিন্তু বাংলাদেশের স্টক মার্কেটের বিনিয়োগকারীরা দক্ষ নন। তাই বিএসইসির আরও বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখা উচিত। ’৯৬ সালের সঙ্গে ২০১০ সালের কারসাজি তুলনা হবে না। আবারও যদি বাজারে কোনো ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয় সেটা হবে আরও ভয়াবহ।
এসব কোম্পানি নিয়ে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ বলেন, আইনি দুর্বলতার কারণে ভুয়া কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হচ্ছে। আইপিও আবেদন করার পর সিএসই কোম্পানি পরিদর্শনের আগ্রহ দেখালে তারা আবেদনই ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। যাদের কোম্পানি প্রত্যক্ষ পরিদর্শন হয়নি এরকম অনেক প্রতিষ্ঠানই শেয়ারবাজার থেকে টাকা নিয়েছে। তালিকাভুক্তির মাধ্যমে যে টাকা নেয় পরে নিজেদের শেয়ার কারসাজি করেও টাকা হাতিয়ে নেয়। এ জন্য আইনি কাঠামো আরও সুসংহত করা উচিত।
অভিনব পদ্ধতিতে কোম্পানি পরিচালকদের কারসাজি : একই প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন নামে টাকা উত্তোলন করে এখন শুধুই শেয়ার লেনদেন করছে। এসব শেয়ার শুরুতে বাজারে ১০ টাকায় ছেড়ে মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে ৪০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এর পরে নিজেদের সব শেয়ার বিক্রি করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। পরে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কিছুই করার থাকে না। এ কাজে সহযোগিতা করছে বিভিন্ন সিকিউরিটিজ হাউস, মার্চেন্ট ব্যাংক। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বিএসইসি কোনো কিছু না দেখেই ভুয়া কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দিচ্ছে। এসব কোম্পানির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। ইস্যু ম্যানেজার কোম্পানি ভুয়া, মূলধনবিহীন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করে দেয়। কোম্পানির পরিচালকরা তালিকাভুক্ত হওয়ার পর নিজেদের লোক ও প্রতিষ্ঠানকে ঠিক করে রাখে। কয়েক দিন শেয়ার দর বৃদ্ধি করে বিক্রি করে দেয়। আর এভাবে তারা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। গত দুই বছরে যেসব কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে কয়েকটি বাদে বেশির ভাগই শেয়ারবাজার থেকে টাকা লুট করতে আসছে। ইতিমধ্যে অনেক কোম্পানির পরিচালক তাদের মূলধনের বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
ভুয়া তথ্য দিয়ে আইপিও আবেদন : পুরো ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে আইপিওর মাধ্যমে টাকা উত্তোলনের আবেদনও করছে। একই প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন নামে কোম্পানির কাগজপত্র তৈরি করে আবেদন করে টাকা উত্তোলনের অনুমোদনও পেয়েছে। এর মধ্যে ফার ইস্ট নিটিং, ফার কেমিক্যাল নামে দুই প্রতিষ্ঠানই অনুমোদন পেয়েছে। শুরুতে ফার কেমিক্যালের ১০ টাকার শেয়ার দর ৬০ টাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। এভাবেই এএফসি এগ্রো, এমারেল্ড অয়েল, তুংহাই নিটিংয়ের শেয়ার নিয়ে কারসাজির প্রমাণ পেয়েছে এসইসি। এসব প্রতিষ্ঠানের সহযোগী কোম্পানির পুরো ভুয়া কাগজ তৈরি করে আবেদন করেছে বিএসইসিতে। বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, গত দুই বছরে পুরো ভুয়া কাগজপত্র জমা দেওয়ায় ১৯টি কোম্পানির আইপিও আবেদন বাতিল করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স, কেয়া স্পিনিং মিলস, বিএমএসএল ইনভেস্টমেন্ট, রয়েল ডেনিম, সামিট শিপিং, ড্রাগন সোয়েটার অ্যান্ড স্পিনিং, আমান কটন ফেব্রিয়াস, এরিয়ান কেমিক্যালস, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স, ইয়াকিন পলিমার, মেট্রোসেম সিমেন্ট, করিম স্পিনিং, আইটি কনসালট্যান্টস। অন্যদিকে আইপিওর মাধ্যমে ২ হাজার ৩৮০ কোটি টাকার মূলধন উত্তোলনের অপেক্ষায় রয়েছে আরও প্রায় ৩৫টি কোম্পানি। এর মধ্যে সর্বাধিক ১৯৬ কোটি টাকার মূলধন উত্তোলনের জন্য আবেদন করেছে প্যাসিফিক ডেনিম। অ্যালায়েন্স হোল্ডিংস নামে আরেক কোম্পানি ১৯২ কোটি ৫০ লাখ টাকার মূলধন সংগ্রহের আবেদন করেছে। যাদের কাগজপত্র ভুয়া বলে এসইসি সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট ব্যাংকার ও ২০১০ সালে শেয়ারবাজার কারসাজি তদন্তে গঠিত কমিটির প্রধান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বিভিন্ন ইস্যু ম্যানেজার কোম্পানি অনেক ক্ষেত্রে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করে। এভাবে অনেক প্রতিষ্ঠানই আইপিও অনুমোদন পায়। ২০১০ সালের পর অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তবে এখন কারসাজির সুযোগ রয়ে গেছে। এ জন্য প্রত্যক্ষ পরিদর্শন ছাড়া কোনো কোম্পানির অনুমোদন দেওয়া উচিত নয়।
ডিএসইর সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমান বলেন, আর্থিক ভিত্তিহীন কোম্পানি বাজারে আসছে। এসব কোম্পানি কয়েক দিন পরই ওটিসিতে চলে যাবে বিনিয়োগকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে। ভালো কোম্পানির জন্য বিশেষ সুবিধা দিয়ে বাজারে নিয়ে আসতে হবে। নইলে যেসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হচ্ছে, তা শেয়ারবাজারে বড় পতন ঘটাতে পারে।
শিরোনাম
- ৮ অস্কারজয়ী স্টুডিও এক ছবিতে, বাজেট শুনে প্রোডিউসাররাও অবাক
- ‘ক্ষমা চাইলেন পরেশ’
- হাসপাতালে স্বস্তিকা
- পাবনায় বাস-ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ৩
- চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস খাদে, নিহত ২
- আবুধাবিতে সাড়ে ৮৩ কোটি টাকার লটারি জিতলেন প্রবাসী বাংলাদেশি
- দৈনিক কোটি টাকার চাঁদাবাজি
- আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি বেড়েছে ২১০০ কোটি টাকা
- এবার নির্বাচনে সেনাবাহিনীই ভরসা
- পিআর : দেশ কতটা প্রস্তুত
- বাবার হাত ছেড়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়িচাপায় সন্তানের মৃত্যু
- বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় এসিড নিক্ষেপ, দুই নারী ও শিশু দগ্ধ
- এনএসডিএ'র নির্বাহী চেয়ারম্যান হলেন রেহানা পারভীন
- নারী পাচারে টোপ ‘ভালো চাকরি’
- মুগদায় ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনি, হাসপাতালে তরুণের মৃত্যু
- মাতুয়াইলে ১০ তলার ছাদ থেকে পড়ে শিশুর মৃত্যু
- জুলাইয়ের বিপ্লবী ছাত্র-জনতা মব নয় : মাহফুজ আলম
- জাপানে ভূমিকম্পের মধ্যে সমুদ্রে ‘অদ্ভুত গর্জন’ শোনার দাবি
- ফ্যাসিস্টদের পুশইন করুন, বিচার করতে প্রস্তুত আমরা : নাহিদ
- শাকিবের আগামী ঈদের সিনেমা চূড়ান্ত
শেয়ারবাজারে ভুয়া কোম্পানির ছড়াছড়ি
আলী রিয়াজ
প্রিন্ট ভার্সন

এই বিভাগের আরও খবর