রবিবার, ৬ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

রাতের ঢাকায় রসনাবিলাস

জিন্নাতুন নূর

রাতের ঢাকায় রসনাবিলাস

রাতের আকাশে মিটিমিটি তারা। এর সঙ্গে বইছিল হালকা মৃদু বাতাস। তন্দুরি চিকেনের অর্ডার দিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠেছিলেন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী রনি আহমেদ ও তার কলেজ বন্ধুরা। ঢাকার পুরানা পল্টনের বায়তুল ভিউ টাওয়ারের ১৩ তলায় ভবনের ওপরে অবস্থিত বার্ড আই নামের রূপটপ রেস্টুরেন্টের ছাদে বসে ছিল এই দলটি। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, ঢাকার বিভিন্ন সুউচ্চ ভবন এবং ব্যস্ততম সড়কে চলা গাড়ি দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি রেস্টুরেন্টটিতে বসে এই গার্মেন্ট ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, সাপ্তাহিক ছুটির দিনের রাতে তিনি ও তার বন্ধুরা ঢাকার বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে আড্ডা জমান। সঙ্গে চলে ভরপুর খাওয়া-দাওয়া। একসময় বিয়ে, জন্মদিন ও কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান কিংবা বিশেষ দিনে পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও প্রিয়জনকে নিয়ে মানুষ রেস্টুরেন্টে খেতে গেলেও রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাদ্যগ্রহণের এই গত্বাঁধা ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। বিনোদনের তেমন ব্যবস্থা না থাকায় রাজধানীবাসী নতুন নতুন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ব্যতিক্রমী খাবার গ্রহণের মাধ্যমে এক ধরনের বিনোদন খুঁজে পাচ্ছেন। বিশেষ করে রেস্টুরেন্টগুলোর দৃষ্টিনন্দন সাজ, গ্রাহকের জন্য সরাসরি গানের আয়োজন এবং সরাসরি রেঁধে তাজা খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থায় রাতের ঢাকায় রসনাবিলাসে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে। এর ফলে ঢাকার অভিজাত এলাকা ছাড়াও অলিগলিতে গড়ে উঠেছে রেস্টুরেন্ট ও ফাস্ট ফুডের দোকান। আবার কিছু তরুণ ভ্যানগাড়ি নিয়ে সন্ধ্যা নামতেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে কম দামে ফাস্ট ফুড আইটেম বিক্রি করছে। এমনকি রাত জেগে কাজ করার অভ্যাস আছে যাদের তাদের জন্যও রাজধানীতে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট। এসব রেস্টুরেন্টে গভীর রাত পর্যন্ত গ্রাহকসেবা দেওয়া হচ্ছে। আর পুরান ঢাকার চাংখার পুলে মামুন বিরানিসহ বেশ কয়েকটি দোকানে প্রায় রাতভরই খাবার বিক্রি হচ্ছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রাজধানীর ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোড, বনানী ১১ নম্বর, মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়াম সংলগ্ন রাস্তা এবং উত্তরার কয়েকটি সেক্টরে গড়ে ওঠা আধুনিক রেস্টুরেন্টগুলোতে সন্ধ্যা নামতেই খাদ্যরসিকরা ভিড় করছেন। বৃদ্ধ থেকে শিশু সব বয়সী নারী-পুরুষই যাচ্ছেন সেখানে। তবে তরুণ-তরুণীদের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। আবার ঢাকার মিরপুর ডিওএইচএস, কালশী এবং ভাটারা এলাকায় ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট মালিকরা একত্রিত হয়ে বড় ফুড কোর্ট দিয়েছেন। এরই একটি ভাটারার মেট্রো ফুড কোর্ট। দিনে খোলা থাকলেও রাতে এই ফুড কোর্টে সহজে বসার জায়গা পাওয়া যায় না। গ্রিল, কাবাব, পাস্তা, পিজা, জুস, চাইনিজ আইটেম এখানে সরাসরি বানিয়ে পরিবেশন করা হয়। লোহার কনটেইনারে তৈরি ব্যতিক্রমী ফুড কোর্টটিতে ক্লাস শেষে সন্ধ্যার দিকে বন্ধুদের নিয়ে খাবার খেতে ও আড্ডা দিতে শিক্ষার্থীরা দলবেঁধে হাজির হন। আবার রাজধানীর অন্য এলাকা থেকেও ভোজনরসিকরা এখানে আসেন।

রাতে ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডের দৃশ্য বদলে যায় সেখানে গড়ে ওঠা রেস্টুরেন্টের রঙিন আলোকসজ্জায়। ক্যাফে দ্রুম, নসটালজিক ক্যাফে, ক্রিম অ্যান্ড ফাজ, গ্লোরিয়া জিন্স কফি, পিজা হাট, হান্ডি, কেএফসিসহ অর্ধশতাধিক ক্যাফে ও রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে এই সড়কে। সন্ধ্যার পরপর জমজমাট হয়ে ওঠে খাবার দোকানগুলো। ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার বাসিন্দারা গভীর রাতেও পরিবারের সদস্য ও বন্ধুকে নিয়ে চলে যান এসব রেস্তোরাঁয়। রাত ১২টার পরও ধানমন্ডি ও গুলশানে গ্লোরিয়া জিন্স কফি বাংলাদেশ-এর শাখায় গ্রাহকের উপস্থিতি দেখা যায়। রাত ১টা পর্যন্ত খোলা থাকায় কর্মজীবীদের কেউ কেউ প্রিয় মানুষটির সঙ্গে সুন্দর কিছু সময় কাটানোর জন্য এক কাপ কফি খাওয়ার বাহানায় হয়তো হাজির হন এই কফিশপে।

রাজীবুল-রাইসা দম্পতির জীবনধারণের মধ্য দিয়ে আরও স্পষ্ট হয় রাতের ঢাকার রসনাবিলাসের চিত্র। বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা রাজীবুল হকের স্ত্রী রাইসা আহমেদ কাজ করেন একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। দুজনই কর্মজীবী হওয়ায় পাঁচ বছরের মেয়ে অবন্তীকে খুব একটা সময় দিতে পারেন না। এ জন্য সাপ্তাহিক ছুটির রাতে এবং মাসে দুই বার কর্মদিবসেও  স্ত্রীর কাজের চাপ কমাতে নগরীর বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খাান। রাজীবুল জানান, নগরীতে বেড়ানোর তেমন স্থান নেই। এজন্য আমার স্ত্রী-কন্যা প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন খাবার দোকান খুঁজে বের করে। ছুটির দিনে তিনজনে মিলে সেখানে খেতে যাই। আবার স্ত্রীর কাজের চাপ কখনো বেশি থাকলে আমি আগে থেকেই রাতে বাইরে খাবার খাওয়ার প্ল্যান করি। অফিস থেকে ফিরে বিশ্রাম নিয়ে নিজেই গাড়ি চালিয়ে দুজনকে নিয়ে বের হই। এতে বিভিন্ন মজার খাবারের স্বাদ নেওয়া যায় আবার পরিবারের সদস্যরাও খুশি থাকে। রাজীবুলের মতে, বিশ্বায়নের এই যুগে ঢাকাবাসীর জীবনধারায় এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। রাতে বাইরে খাবার খেতে যাওয়াকেও তিনি এক ধরনের পরিবর্তন বলে মনে করেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর