শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

এমপি রতনের প্রিয় চারজন এখন উল্টো গান গাইছেন

মাসুম হেলাল, সুনামগঞ্জ

আলোচিত-সমালোচিত সংসদ সদস্য (সুনামগঞ্জ-১) মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের একান্ত আস্থাভাজন চার ‘খলিফা’ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন তার বিরুদ্ধে উল্টো গান গাইছেন। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত তার সম্পদ অর্জনের তদন্ত ও বিদেশযাত্রার ওপর দুদকের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর একে একে তারাও হয়ে ওঠেন ‘দুর্নীতিবিরোধী’, দীর্ঘদিনের মধুর সম্পর্ক ত্যাগ করে অবস্থান নেন রতনের বিরুদ্ধে। কেউ কেউ হাত মেলান রতনের শত্রুপক্ষের সঙ্গেও। হঠাৎ তাদের ভোল পাল্টানোর বিষয়টি এখন চায়ের আড্ডার আলোচনার মুখরোচক বিষয়। প্রসঙ্গত, মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব খাটিয়ে ক্ষমতাধর হওয়া লোকেদের গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষ ‘খলিফা’ বলে উল্লেখ করেন। সংসদীয় এলাকায় মন্ত্রী-এমপিদের পর এরাই ক্ষমতার স্বাদ ভোগ-উপভোগ করেন। এলাকার উন্নয়ন পরিকল্পনা, উদ্যোগ গ্রহণ, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাদের মতামত বিশেষ গুরুত্ব পায়। আধিপত্য বিস্তার করেন থানা পুলিশ, প্রশাসনসহ প্রকল্প বাস্তবায়ন-সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোয়। সাধারণ মানুষ ও জনপ্রতিনিধির মাঝে শক্তপোক্ত দেয়াল সৃষ্টি করে রাখেন এসব খলিফা। সংসদ সদস্য রতনের চার খলিফার একজন নিজাম উদ্দিন। তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা তিনি। নিজাম ২০০৮ সাল থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ছিলেন এমপির একান্ত আস্থাভাজন। এমপির আনুকূল্য নিয়ে ‘কাঁচা পয়সার খনি’ খ্যাত ফাজিলপুর বালু-পাথর মহালে বছরের পর বছর রাজত্ব করেছেন ইউপি চেয়ারম্যান নিজাম। ব্যক্তিজীবনে অর্থনীতির ঊর্ধ্বমুখী সূচক ছুঁয়েছে আসমান পর্যন্ত। সবখানেই একচ্ছত্র আধিপত্য তার। তাহিরপুরে সরকারি বরাদ্দ কোথায় যাবে, কে পাবে; রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট কোথায় হবে, কোথায় হবে নাÑ এমপির পক্ষ হয়ে তার সবই নির্ধারণ করে দিতেন নিজাম। কিন্তু এমপি রতন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার পর থেকে তাদের ‘দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে গেছে বেঁকে’। আরেক খলিফা জেলা শ্রমিক লীগ সভাপতি সেলিম আহমদ। চেয়ারম্যান নিজামের ভাই তিনি। প্রসিদ্ধ সিলেট-বালু হিসেবে পরিচিত ফাজিলপুর বালু-পাথর মহালের অন্যতম ইজারাদার সেলিম। মহালটি সৃষ্টির পর থেকে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় সংসদ সদস্যের আস্থাভাজনরাই ভোগদখল করে এসেছেন ‘কাঁচা পয়সার খনি’ ফাজিলপুর। সেই ধারাবাহিকতায় এমপি রতনের স্নেহাশিস নিয়ে সেলিমও টানা দুই মেয়াদ এক বছর সময়জুড়ে ভোগদখল করেছেন ফাজিলপুর। সম্প্রসারিত হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। জেলা শহরে বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন। বড় ভাই নিজামের মতো রতনের একসময়ের চোখের মণি শ্রমিক লীগ নেতা সেলিমও এখন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত এমপি রতন থেকে নিরাপদ দূরত্বে। শ্রমিক লীগ নেতা সেলিম বলেন, ‘দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার পর এমপি সাহেব চেয়েছিলেন আমরা তার পক্ষে মিছিল-মিটিং করি। আমরা রাজনীতি করি, আমাদের ভবিষ্যৎ আছে। আমাদের পক্ষে সেটা করা সম্ভব হয়নি।’ খলিফা আর্ণিক। ইনি ছিলেন এমপির ব্যক্তিগত সহকারী। আর্ণিকের বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। সহকারী থাকার সময় ‘এমপির চাইতে এক হাত এগিয়ে থাকা’ আর্ণিক তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের জন্য পুরো নির্বাচনী এলাকায় ছিলেন আলোচনায়। তিনি এতটাই ক্ষমতাধর ছিলেন যে, তাকে লোক বলত ‘ছায়া সংসদ সদস্য’। টিআর, কাবিখা, কাবিটা, কর্মসৃজন, থোক বরাদ্দÑ এর সবই মনিটরিং করতেন আর্ণিক। অদৃশ্য কারণে সেই আর্ণিকও এখন রতনের ঘোর বিরোধী। চাউর আছে- রতনের বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত শুরুর পর তদন্তকারী সংস্থাকে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করছেন আর্ণিক। ধর্মপাশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শামীম আহমদ মুরাদ ছিলেন এমপি রতনের ‘ডান হাত’। এমপি রতনের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছিল দুদকের তদন্ত শুরুর বছরখানেক আগে। মুরাদও এমপির প্রভাব খাটিয়ে সর্বেসর্বা ছিলেন গোটা এলাকায়। সভা-সমাবেশে বসতেন এমপির পাশের চেয়ারে। উপজেলা নির্বাচনে নৌকা মার্কার প্রার্থী মুরাদ পরাজিত হন এমপির ছোট ভাই বিদ্রোহী প্রার্থী রুকনের কাছে। সেই থেকে শত্রুতা। অক্টোবরে অনুষ্ঠিত জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি সভায় কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে রতনকে এক হাত নেন মুরাদ। তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ এনে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দরখাস্ত করেন দুর্নীতি দমন কমিশনে। এসব বিষয়ে সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন বলেন, ‘রাজনীতিতে স্বার্থের কারণে যা যা করার অনেকে তাই করেন। একসময় যারা আমার পক্ষে ছিলেন তারা এখন বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, তারাও সেটা স্বার্থের কারণে করেছেন। তাদের শুধু চাই আর চাই। ১০ টাকা দিলে ৩০ টাকা দরকার, কী করার আছে। এসব নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর