শুক্রবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত বাংলাদেশ গড়ার প্রস্তাব গৃহীত

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বিশেষ আলোচনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত বাংলাদেশ গড়ার প্রস্তাব গৃহীত

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে গতকাল ২০৪১ সালের মধ্যে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণ ও বৈষম্যহীন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা তথা বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রস্তাব গ্রহণ করেছে জাতীয় সংসদ। এর আগে প্রস্তাবের ওপর বিশেষ আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকারি দল, সরকারের শরিক দল, সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও বিএনপির এমপিরা বক্তব্য রাখেন। তারা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু মানে স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে আজও পাকিস্তানিদের দাসত্ব করতে হতো। দেশ স্বাধীন না হলে পদ্মা সেতু হতো না। কর্ণফুলী টানেল হতো না। আমরা এমপি হতাম না। এত লোক সচিব হতো না। আজ সবকিছুতে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। আজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অদম্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিশ্বে তিনি বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে আসীন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ রচনার সফলতা এখানেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টও বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নের উদাহরণ’ হিসেবে উল্লেখ করেন। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ ধর্মীয় সম্প্রীতি ও নিরপেক্ষতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। একাদশ জাতীয় সংসদের ১৫তম অধিবেশনে গতকাল স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বিশেষ আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা এসব কথা বলেন। গত বুধবার সংসদে বিশেষ আলোচনার প্রস্তাব উত্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা। সংসদের অভিমত এই যে, ২০২১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে ‘সুবর্ণজয়ন্তী’  উদযাপন বাঙালির জাতীয় জীবনে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশ আজ এক ‘উন্নয়ন বিস্ময়’। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ মহান শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ পাকসেনাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।’ এতে আরও বলা হয়, ‘সংসদীয় গণতন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের মধ্য দিয়ে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার সফল বাস্তবায়ন ও প্রত্যাশা পূরণে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের এই ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণে তারুণ্যদীপ্ত বাংলাদেশ সব চ্যালেঞ্জ উত্তরণ ঘটিয়ে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণ ও বৈষম্যহীন, উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলারূপে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হোক এই হোক আমাদের প্রত্যয়।’ স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সকাল সাড়ে ১০টায় সংসদে আনীত প্রস্তাবের ওপর আলোচনা শুরু হয়। মাঝে দেড় ঘণ্টার বিরতি দিয়ে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত আলোচনা চলে। গত দুই দিনে সরকার ও বিরোধী দলের মোট ৫৯ জন সংসদ সদস্য ১০ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট আলোচনা করেন। পরে স্পিকার প্রস্তাবটি ভোটে দিলে তা সর্বসম্মতিক্রমে সংসদে গৃহীত হয়। আলোচনায় অংশ নেন প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মাহমুদ আলী, চিফ হইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী, এম তাজুল ইসলাম, ডা. দীপু মনি, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক, শাহরিয়ার আলম, বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান, সরকারি দলের আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, সাবেক চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, হুইপ ইকবালুর রহিম, নাহিদ ইজহার খান, অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত, এ কে এম রহমতুল্লাহ, বিরোধী দল জাতীয় পার্টির আনিসুল ইসলাম মাহমুদ,   সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, ফখরুল ইমাম, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সরকারি দলের মোতাহার হোসেন, নুরুল ইসলাম নাহিদ, বেনজীর আহমেদ, বিএনপির হারুনুর রশিদ, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা প্রমুখ। এ সময় মন্ত্রী-সিনিয়র এমপিরা বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দোসর এবং পাকিস্তানের দালালদের দেশবিরোধী চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের বিষদাঁত ভেঙে দিতে অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল শক্তির ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার দিন থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি। তখন থেকেই আন্দোলন শুরু করেন। মাতৃভাষার আন্দোলন থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত করতে দীর্ঘ সংগ্রাম করেছেন। বিরোধীদলীয় উপনেতা ও জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, জাতির পিতা জাতির গৌরবের, তাঁকে দলীয় নেতার বৃত্তে আটকে রাখবেন না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতার সার্বজনীন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার আহ্বান জানান। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা না করলে ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হতো।

বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে আজও পাকিস্তানিদের দাসত্ব করতে হতো : আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা ও সিনিয়র সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে আজও পাকিস্তানিদের দাসত্ব করতে হতো। এখন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করছেন। শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু মানে স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে এখনো পাকিস্তানিদের গোলাম হয়ে থাকতে হতো। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ওনারা (বিএনপি নেতারা) বলছেন ওনাদের নেত্রীকে এখনই বিদেশে পাঠাতে হবে। চিকিৎসা করাতে হবে বিদেশে। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা খুব খারাপ। খালেদা জিয়া তিন তিনবার হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন এবং সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন। আমি তাদের বলেছি, বিদেশ থেকে ডাক্তার এনে চিকিৎসা করাতে পারেন। ওনারা সেই লাইনে হাঁটবেন না। তিনি বলেন, বিএনপি (সংসদ সদস্যরা) স্বাস্থ্যের অব্যবস্থার কথা বলেছেন। ওনারা ২৬ বছর শাসন করেছেন, আমি শাসন করেছেন বলব, সেবা করেন নাই। কী করেছিলেন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে, মানুষ বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাবেন না? জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘আজকে বুদ্ধিজীবীরা গণতন্ত্রের কথা বলেন। টকশোতে গেলে গণতন্ত্রের কথা শুনতে হয়। যেদিন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো, সেদিন গণতন্ত্র কোথায় গেল?

 শিশু রাসেলকে যখন হত্যা করা হলো, তখন কোথায় গণতন্ত্র ছিল? এসব ধান্দাবাজরা এখনো আছেন।’ তিনি বলেন, ‘দেশ স্বাধীন না হলে পদ্মা সেতু হতো না। কর্ণফুলী টানেল হতো না। আমরা এমপি হতাম না। এত লোক সচিব হতো না।’

জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, বঙ্গবন্ধু কয়েকবার দেশ স্বাধীন করেছেন। প্রথমবার যুদ্ধ ঘোষণা করে। দ্বিতীয়বার বিভিন্ন দেশে ঘুরে স্বীকৃতি আদায় করে। আর তৃতীয়বার যখন ইন্দিরা গান্ধীকে বললেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতের সেনা তুলে নেওয়ার জন্য। তবে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে ‘এসব প্রতিষ্ঠান কার্যকর করার দাবি জানান। তিনি বলেন, আমরা বিভাজিত জাতি চাই না। আমরা শাহবাগ-হেফাজত চাই না। এক জাতি চাই। অন্তর্ভুক্তিমূলক  বৈষম্যহীন জাতি চাই।’

জাপার এমপি ফখরুল ইমাম বলেন, ‘আমরা আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ পেয়েছি। সেই প্রদীপ হলেন শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বে দেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলছে। তিনি বলেন, ‘উন্নত দেশ হতে হলে মানুষের উন্নতির ব্যবস্থার দরকার। এক জরিপে দেখা যায়, দেশের ২ কোটি ৩৪ লাখ মানুষ এখনো অনুন্নত ও অস্বাস্থ্যকর পায়খানা ব্যবহার করে। দেড় শতাংশ মানুষ খোলা জায়গায় মল ত্যাগ করেন।’ তিনি লোহার হাতে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার দ্রব্যমূল্যে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক চাকা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান

বিএনপি দলীয় এমপি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, গণতন্ত্রকে মূলমন্ত্র ধরে একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হয়েছে। সেই দেশে গত এক যুগে চালু হয়েছে- আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র, সীমিত গণতন্ত্র। তিনি বলেন, বেশি উন্নয়ন, কম গণতন্ত্র; উন্নয়নের গণতন্ত্র নামক অদ্ভুত সব স্লোগান। ঠিক যেমন আইয়ুবের বুনিয়াদি গণতন্ত্র। সামরিক স্বৈরশাসকরা ক্ষমতায় থাকার বয়ান হিসেবে উন্নয়নকে বেছে নিয়েছিল। বর্তমান সরকারও একদমই তাই। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে এখন অর্থনৈতিক বৈষম্য অকল্পনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য হিসাব করলে আজকের স্লোগান হবে, সোনার বাংলা নরক কেন। তিনি আরও বলেন, ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ এটা ছিল আওয়ামী লীগের ১৯৭০ সালের নির্বাচনী পোস্টারের স্লেøাগান। সেখানে দুই পাকিস্তানের অর্থনৈতিক  বৈষম্যের কথা তুলে ধরা হয়েছিল। সেই নির্বাচনে বিজয়ীর পরে ক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতে হস্তান্তর না করায় আমরা পেলাম স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে সব নাগরিকদের জন্য আইনের শাসনের অঙ্গীকার করা হয়েছিল। আজ দেশে সরকারি দলের কিছু নেতা-কর্মী, কিছু ব্যবসায়ী, কিছু দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা অর্থাৎ সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ মানুষের সঙ্গে বাকি ৯০ শতাংশ মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর