বৃহস্পতিবার, ১২ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

আদর্শ রংপুর এখন অভিশাপ

সংস্কার হলে সিটির সৌন্দর্য বাড়বে, আসবে পর্যটক

নজরুল মৃধা, রংপুর

আদর্শ রংপুর এখন অভিশাপ

ছয় নদ-নদীর কারণে রংপুর সিটি করপোরেশন একটি আদর্শ নগরী। কিন্তু সঠিক পরিচর্যার অভাবে নদীগুলো এখন নগরবাসীর কাছে অভিশাপ হয়ে উঠছে। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার করা হলে রংপুর নগরীর সৌন্দর্য যেমন বাড়বে, তেমনি পর্যটন নগর হিসেবে এটি দেশের মধ্যে আদর্শ স্থান হয়ে উঠবে। আসবে পর্যটক। রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকা দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো  হলো- ঘাঘট নদ, শ্যামাসুন্দরী, ইছামতী, বুড়াইল, খোকসা ঘাঘট, আলাইকুমারী নদী। এই ছয়টি নদ-নদীতেই আছে অবৈধ দখল। কোনো নদীর পানির প্রবাহই স্বাভাবিক নেই। শ্যামাসুন্দরীকে কেউ কেউ খাল বললেও ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় এটিও একটি নদী। রাজা জানকীবল্লভ সেন এটি একবার খনন করেছিলেন। দখল ও দূষণে এসব নদী মরে যেতে বসেছে। একসময় এসব নদী খরস্রোতা থাকলেও এসব এখন অতীত। শ্যামাসুন্দরীর ১৭০ অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করা হলেও উচ্ছেদ অভিযান থমকে রয়েছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, নগরীর পূর্ব প্রান্তে সাতমাথা যাওয়ার পথে পড়ে খোকসা ঘাঘট। এই নদীটি এখন খালে পরিণত হয়েছে। কোথাও কোথাও এই নদীর অস্তিত্ব হারিয়ে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দা আসাদুজ্জামান বলেন, তিনি তার বাপ-দাদাদের কাছে শুনেছেন, খোকসা ঘাঘট একসময় খরস্রোতা নদী ছিল। এই নদীকে ঘিরে ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য। কালের পরিক্রমায় দখল ও দূষণের ফলে এই নদীর অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। সাতমাথা থেকে কিছুদূর এগোলে নগরীর পুরাতন শহর বলে খ্যাত মাহীগঞ্জে যাওয়ার পথেই ইছামতী নদী। এটি এখন নদীও নয়, খালও নয়। দখল করে স্থানীয় বাসিন্দারা এর দুই পাড়ে গড়ে তুলেছেন বসতভিটা। মাহীগঞ্জের বাসিন্দা মকবুল হোসেন বলেন, দ্বাদশ শতকে এই নদী দিয়ে মৎস্য আকৃতি বাহনে একজন আল্লাহর ওলি এসেছিলেন। মৎস্য আকৃতি বাহনে আসায় এ এলাকার নাম হয়েছে মাহীগঞ্জ। ইছামতী ঘিরে মাহীগঞ্জে একসময় নদীবন্দর ছিল। সেটি হারিয়ে গেছে অনেক আগেই। ইছামতীর যেটুকু অস্তিত্ব রয়েছে তাও দখল হয়ে যাচ্ছে। অনেক স্থানে ভরাট হয়ে গেছে। রংপুর নগরীর সাতমাথা হয়ে দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে বয়ে যাওয়া পার্কের মোড় এলাকায় খোকসা ঘাঘটের অবস্থান আরও করুণ। এটি নদী বলে চেনাই যায় না। এমনকি সিটি করপোরেশন যে ড্রেন নির্মাণ করেছে সেই ড্রেনের অর্ধেকই নদীতে। বর্জ্য, বিভিন্ন বাসাবাড়ির পয়োনিষ্কাশনের ফলে খোকসা পার্কের মোড়ের ওই স্থানে দুর্গন্ধে অস্বাস্থ্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ইস্রাফিল ইসলাম বলেন, এই নদীর দুই পাড়ে শত শত মানুষ ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস করছেন। এ ছাড়া অবৈধভাবে অনেকেই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।

 ফলে নদীর অস্তিত্ব যেটুকু রয়েছে তা দখল ও দূষণে মরে যাচ্ছে।

এদিকে রংপুর নগরীর প্রাণকেন্দ্র দিয়ে বয়ে যাওয়া শ্যামাসুন্দরীর ১৭০ জন অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদের কাজ থমকে আছে। হাল জরিপে এই ১৭০ জন অবৈধ দখলদারকে চিহ্নিত করা হয়। উচ্ছেদ শুরুর আগে তাদের স্থাপনা সরিয়ে নিতে নোটিস দিয়ে অবগত করা হয়। কিন্তু ১১ দখলদার আপত্তি দেওয়ায় উচ্ছেদ অভিযান আটকে রয়েছে। ফলে শ্যামাসুন্দরী আশীর্বাদের পরিবর্তে এখন অভিশাপে পরিণত হয়েছে।

জানা গেছে, রংপুর জেলায় নদ-নদীর সংখ্যা ৩৩টি। এর মধ্যে একটি নদীর অবস্থাও ভালো নেই। তিস্তা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, করতোয়া বড় নদী হলেও এগুলোর কোনোটিরই স্বাস্থ্য ভালো নয়। বুড়াইল নামে রংপুর জেলায় তিনটি আলাদা নদী আছে। ছোট আখিরা, নলেয়া, সোনামতী, কাফ্রিখাল, শালমারা, মরা তিস্তা, ঘিরনই, বুল্লাই, মানাস, বাইশাডারা, ধাইজান, খটখটিয়া নদীর অবস্থাও ভালো নয়।

নদীবিষয়ক গবেষক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, রংপুরের নদীগুলোর পাড়ে অনেক দখলদার আছে। যদি এখনই অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে পানির প্রবাহ স্বাভাবিক করার প্রয়োজনীয় পদেক্ষপ গ্রহণ করা না যায় তাহলে রংপুর শহরের জলাবদ্ধতা দূর হবে না। এ নদীগুলো রক্ষা করা না গেলে এ অঞ্চলের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ সবকিছুই হুমকির মধ্যে পড়বে। এগুলো রক্ষা করার জন্য এখনো সময় আছে। যথাসময়ে এ কাজ করা না গেলে পরবর্তী সময়ে করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর