রবিবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

লাগামহীন কাগজের দাম বৃদ্ধিতে ক্ষুব্ধ প্রকাশকরা

অমর একুশে বইমেলা

মোস্তফা মতিহার

লাগামহীন কাগজের দাম বৃদ্ধিতে ক্ষুব্ধ প্রকাশকরা

অমর একুশে বইমেলার বাকি আর মাত্র দুই দিন। বইমেলায় শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি ও রংতুলির আঁচড়ে স্টল সাজানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রমিকরা। ছবিটি গতকাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে তোলা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

মহামারি করোনাভাইরাসের চোখ রাঙানিতে গত দুই বছর মেলা সঠিক সময়ে শুরু হয়নি। এবার প্রথা অনুযায়ী পয়লা ফেব্রুয়ারিতেই শুরু হচ্ছে অমর একুশে বইমেলা ২০২৩। ওই দিন বিকাল ৩টায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মেলার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর বিকাল ৫টায় সর্বস্তরের জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে মেলার সবগুলো প্রবেশদ্বার। গত ২২ জানুয়ারি লটারির মাধ্যমে বরাদ্দ পাওয়ার পর স্টল ও প্যাভিলিয়ন নির্মাণে ব্যস্ত প্রকাশকরা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিস্তীর্ণ প্রান্তর ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এখন মুখরিত নির্মাণ শ্রমিকদের ব্যস্ততা ও হাতুড়ি বাটালের ঠুকঠাক শব্দে। এর মধ্যে বেশির ভাগ স্টলের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। স্টল ও প্যাভিলিয়নে নান্দনিকতা ও শিল্প ফুটিয়ে তোলার লক্ষ্যে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বরাদ্দ পাওয়া প্রকাশকরা। কার চেয়ে কার স্টল ও প্যাভিলিয়ন কত নান্দনিক হয় সে রকম একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে মেলার দুই প্রাঙ্গণে। তবে, লাগামহীনভাবে কাগজের দাম বৃদ্ধিতে প্রকাশকরা এবারের মেলার সফলতা নিয়ে অনেকটা সন্দিহান। তারা বলেন, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলায় কাগজের (৮০ গ্রাম) দাম রিমপ্রতি ছিল ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা। সেটির বর্তমান দাম ৩ হাজার ৮০০ টাকা। এ ছাড়া আগের দিনের দামের সঙ্গে পরের দিনের দাম মেলে না। এমন ভারসাম্যহীনতায় সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন প্রকাশকরা। কাগজের দাম বৃদ্ধি এবারের মেলায় প্রকাশকদের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাগজের দাম বৃদ্ধি মেলায় কতটা প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রকাশকরা।

 

শাহাদাৎ হোসেন ( স্বত্বাধিকারী, অন্বেষা)

কাগজের দাম মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধিতে বইমেলার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন অন্বেষার স্বত্বাধিকারী শাহাদাৎ হোসেন। তিনি বলেন, ডিজিটাল যুগে বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ এমনিতেই কমে গেছে। এর ওপর কাগজের দাম লাগামহীন হওয়ায় বইমেলার ওপর অনেক বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বৈশ্বিক সমস্যার কারণে কাগজের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়াতে আমাদেরকেও বইয়ের দাম বাড়াতে হবে। তবে, কাগজের দাম যে হারে বেড়েছে তাতে আমরা বইয়ের দাম সেভাবে বাড়াতে পারব না। আমাদের পাঠকের সংখ্যা আরও কমে যাবে। দেশের প্রকাশনাশিল্পকে হুমকির কবল থেকে রক্ষা করার জন্য কাগজের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য সরকারের প্রতি বিনীত অনুরোধ জানান তিনি।

 

ওসমান গনি (প্রকাশক, আগামী)

কাগজের দাম বৃদ্ধিতে বইমেলায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। তবে, দীর্ঘদিনের সফলতায় ভাটা পড়বে বলে মনে করেন আগামী প্রকাশনীর ওসমান গনি। তিনি বলেন, সরকার যদি কাগজ আমদানিকে ট্যাক্স ফ্রি করে দেয় অথবা আমাদের ওপর ভ্যাট ট্যাক্স কমিয়ে দেয় তাহলে আমরা অন্তত প্রকাশনাশিল্পকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারব। কাগজের দামের লাগামহীন বৃদ্ধি যদি এখনই রোধ করা না যায় তাহলে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা কষ্টকর হবে। কাগজের দাম বৃদ্ধি দেশের প্রকাশনাশিল্পের জন্য অশনিসংকেত। আমরা যারা গবেষণাধর্মী ও উচ্চমার্গীয় বই বেশি প্রকাশ করে থাকি তারাই বেশি সমস্যায় পড়বেন। আমাদের গবেষণাধর্মী বইগুলো সারা বছর ধরেই বিক্রি হয়। বিশেষ করে আগামী প্রকাশনী যে ধরনের বই প্রকাশ করে সেই ধরনের বইয়ের খুব একটা কাটতি নেই। চটুল বইয়ের প্রকাশকদের চেয়ে আমরা উচ্চমার্গীয় বইয়ের প্রকাশকরা বেশি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবো।

 

মাযহারুল ইসলাম (প্রকাশক, অন্যপ্রকাশ)

কাগজের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি আমাদের প্রকাশকদের জন্য চরম দুঃসংবাদ বলে মন্তব্য করেছেন অন্যপ্রকাশের প্রকাশক মাযহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, কাগজের দাম মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেলেও এতে মেলায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। কারণ যারা বই কিনেন, তারা কিনবেনই। কাগজের দামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরা বইয়ের দাম বাড়াব না। জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই সামান্য দাম বৃদ্ধি করা হবে। যার কারণে মেলার ওপর ততটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলেই আমি মনে করছি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে সবকিছুর পাশাপাশি কাগজের দামও যেহেতু বেড়েছে অতএব বইয়ের দামও কিছুটা বাড়বে। তবে আমরা বইয়ের দাম পাঠকদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই রাখার চেষ্টা করব। বৈশি^ক দুর্যোগ শেষ হলে এই সমস্যার সমাধান হবে বলেই আশা করছি।

 

মঞ্জুর হোসেন (প্রকাশক, জোনাকী)

কাগজের দাম বৃদ্ধি প্রকাশনাশিল্পের জন্য হুমকি উল্লেখ করে প্রকাশনা সংস্থা জোনাকীর কর্ণধার মঞ্জুর হোসেন বলেন, প্রকাশনাশিল্পের সংকট ও বিপর্যয় শুধু আমাদেরই নয়, এর প্রভাব অনেক সুদূরপ্রসারী। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে লেখক ও পাঠক সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বইয়ের মূল্য বদলানো যায় না। একবার ছেপে ফেললে সেই সংস্করণের কপি শেষ না হওয়া পর্যন্ত একই দাম থাকে। যদি কাগজের মূল্য কমে যায়, তাতেও সমস্যা, বেড়ে গেলেও সমস্যা।

 

এ কে এম তারিকুল ইসলাম রনি (প্রকাশক, তাম্রলিপি)

করোনা মহামারির পর বৈশ্বিক  সমস্যার কারণে শুধু কাগজের দাম নয় সবকিছ্রু দামই  বেড়েছে। তবে কাগজের দাম যতটা বাড়ার কথা তার চেয়ে বহুগুণ বেশি বেড়েছে। সিন্ডিকেটের কারণেই কাগজের দাম এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সিন্ডিকেট বাজার দখল করেছে কিন্তু বদনাম হচ্ছে সরকারের। আমি আশা করব সরকার এই সিন্ডিকেট ভেঙে দেবে। সরকারের কাছে আমাদের আকুল আবেদন কাগজের বাজারকে সিন্ডিকেটমুক্ত করুন।

 

শরীফা বুলবুল (স্বত্বাধিকারী, বলাকা প্রকাশন)

একটা সিন্ডিকেট কাগজের দাম বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে ফেলেছে। কেউ তাদের ধরছে না। অথচ অন্য কোনো খাতে পণ্যের দাম এভাবে দ্বিগুণ হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন বলাকা প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী শরীফা বুলবুল। তিনি বলেন, প্রতিবছর বইমেলা আর পাঠ্যবই ছাপার সময় এলেই তারা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াতে থাকে। এবার সুযোগ পেয়ে সেটা দ্বিগুণ করে ফেলেছে। তারপর অজুহাত তোলে আন্তর্জাতিক বাজারের। এ অন্যায় কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। যে কোনো মূল্যে সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। কাগজের দাম বাড়ায় বইয়ের দাম বেড়ে যাবে, যে চাপটা পড়বে ক্রেতা-পাঠকের ওপর। বই বিক্রিও কমতে পারে। এতে পাঠকও কমে আসবে। অথচ সরকার বুদ্ধিবৃত্তিক সৃজনশীল সমাজ কিংবা প্রজন্ম গড়ে তুলতে যে উদ্যোগ নিচ্ছে বা টাকা ঢালছে, সিন্ডিকেটের দুষ্কর্মের কারণে এসব আয়োজন ভেস্তে যাবে। সে জন্য সরকারি নজরদারি থাকা উচিত।

 

শওকত হোসেন লিটু (স্বত্বাধিকারী, পারিজাত প্রকাশনী)

কাগজের অস্বাভাবিক ও নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে দেশের প্রকাশনা খাত বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে বলে মনে করেন পারিজাত প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী শওকত হোসেন লিটু। তিনি বলেন, এবার কাগজের সঙ্গে যোগ হয়েছে আমদানিনির্ভর প্লেটের দুষ্প্রাপ্যতা। জরুরি প্রকাশনায় উচ্চ মূল্য দিয়েও মিলছে না এসব উপকরণ। এই অস্বাভাবিকতা এখন চরম পর্যায়ে। বর্তমান বাজার মূল্যে ছাপাকেন্দ্রিক কোনো কাজকর্মই করা সম্ভব হচ্ছে না।

সর্বশেষ খবর