ঈদের ছুটি ঘিরে জমজমাট হয়ে উঠেছে দেশের প্রায় সব পর্যটন অঞ্চল। বেশির ভাগ পর্যটন স্পটে তিল ধারণের জায়গাও মিলছে না। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
কক্সবাজার : কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত এখন পর্যটকে ভরপুর। গতকাল সকাল থেকে সৈকতের কলাতলী, সুগন্ধা, সি-গাল ও লাবণী পয়েন্টে পর্যটকের উপচে পড়া ভিড় ছিল। শহরের সৈকত ছাড়াও হিমছড়ি, ইনানী, পাটোয়ারটেক ও শামলাপুর সৈকতে পর্যটকের পদচারণ ছিল।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার রিজিয়নের সুপার মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘পর্যটকদের নিরাপদ ভ্রমণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সহযোগিতা করছে। কোনো পর্যটক যেন ঘুরতে এসে ক্ষতিগ্রস্ত না হন সেদিকে বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে। সমুদ্রসৈকতে প্রশাসনের একাধিক টিম কাজ করে যাচ্ছে।’
চট্টগ্রাম : জমে উঠেছে চট্টগ্রামের বিনোদন কেন্দ্রগুলো। নগরের ফয়’স লেক, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা, চট্টগ্রাম শিশু পার্ক, পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত, পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়ে থাকা সীতাকুন্ডের গুলিয়াখালী বিচ, আনোয়ারার পারকি সমুদ্রসৈকতে দর্শনার্থীর ভিড় লেগে আছে ঈদের দিন থেকেই। ফয়’স লেক সি ওয়ার্ল্ড ছাড়াও চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায়ও ছিল ভিড়। এ ছাড়া শিশু পার্ক, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত পারকি বিচ, পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত, চট্টগ্রাম নেভাল, কাজীর দেউড়ি শিশু পার্ক, মিরসরাই মহামায়া লেকসহ পর্যটন কেন্দ্রগুলোয় ছিল উপচে পড়া ভিড়।
বরিশাল : বরিশালের বিনোদন কেন্দ্রগুলোয় এখনও রয়েছে ঈদের আমেজ। ঈদের তৃতীয় দিনেও বিনোদন কেন্দ্রগুলোয় ছিল উপচে পড়া ভিড়। পরিবার, বন্ধু ও স্বজনদের নিয়ে ঈদের আনন্দ পরিপূর্ণ করতে বিনোদন কেন্দ্রগুলোয় প্রাণের উচ্ছ্বাস লক্ষ করা গেছে। গতকাল বিকালে নগরীর প্লানেট ওয়ার্ল্ড শিশু পার্ক, কীর্তনখোলা নদীর তীরবর্তী মুক্তিযোদ্ধা পার্ক ও ত্রিশ গোডাউন বধ্যভূমি, বঙ্গবন্ধু উদ্যান, আমতলা স্বাধীনতা পার্ক, দুর্গাসাগর, দপদপিয়া সেতুসহ বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন বয়সের দর্শনার্থীর ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। নগরীর আধুনিক রেস্তোরাঁগুলোয়ও ভিড় দেখা গেছে।
পটুয়াখালী ও কলাপাড়া : পদ্মা সেতু চালুর পর ঈদুল ফিতরের ছুটিতে পর্যটকের পদচারণে মুখরিত রয়েছে সাগরকন্যা কুয়াকাটা। আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতেছেন পর্যটকরা। কেউ সাগরের নোনা জলে ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শরীর ভিজিয়ে সাঁতার কাটছেন। কেউ প্রিয়জনের সঙ্গে সেলফি তুলছেন। কেউ কেউ নাচ-গানে মেতে উঠেছেন।
তিন নদীর মোহনা, লেম্বুর বন, শুঁটকিপল্লী, ঝাউবাগান, গঙ্গামতীসহ সব পর্যটক স্পটে রয়েছে পর্যটকের বাড়তি আনাগোনা। সবকিছু মিলিয়ে প্রাণচাঞ্চল্যে ফিরেছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো। আগামী বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার পর্যটকের চাপ আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। পর্যটকের সবচেয়ে বেশি ভিড় দেখা গেছে কুয়াকাটা জিরো পয়েন্টের পূর্ব-পশ্চিম পাশে অস্থায়ীভাবে বসা ফিশ ফ্রাই দোকানগুলোয়। এসব দোকানে লবস্টার, রূপচাঁদা, কোরাল, তাইরা, টুনা, চিংড়ি, কাঁকড়া, ইলিশসহ বিভিন্ন মাছের পসরা সাজিয়ে রেখেছেন বিক্রেতারা। ফিশ ফ্রাই ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিটি ভাজা মাছের দোকানে বিকাল ৪টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত বিক্রি চলে।
রাজশাহী : ঈদের ছুটিতে রাজশাহী নগরীর বিনোদন কেন্দ্রগুলোয় মানুষের ঢল নেমেছে। গতকালও নগরীর শহীদ জিয়া শিশু পার্ক, বড়কুঠি পদ্মার পাড়, সীমান্ত নোঙরসহ বিনোদন কেন্দ্রে দর্শনার্থীর উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। সবচেয়ে বেশি ভিড় দেখা গেছে জিয়া শিশু পার্ক, নোঙর ও পদ্মা গার্ডেনে। লালন শাহ পার্কের আঁকাবাঁকা সিঁড়ির সাজানো-গোছানো গ্যালারিতে বসে অনেকে উপভোগ করেছেন পদ্মা নদীর সৌন্দর্য। পাশেই নোঙরের সবুজ গালিচায় কাটিয়েছেন সময়।
মেহেরপুর : স্থানীয় দর্শনার্থী ছাড়াও মাইক, ব্যান্ড ও ভেঁপু বাজিয়ে চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মানুষের ভিড় জমেছে মুজিবনগরে। মুখর হয়ে উঠেছে মুজিবনগর কমপ্লেক্স। মুজিবনগর আম্রকানন জুড়ে গড়ে ওঠা কমপ্লেক্সে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরভিত্তিক বাংলাদেশের মানচিত্র, স্মৃতিসৌধ, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন ম্যুরাল, ছয় স্তরবিশিষ্ট গোলাপবাগান, শাপলা চত্বরসহ বিভিন্ন স্থাপনা ঘুরে ঘুরে দেখছেন দর্শনার্থীরা। তবে দীর্ঘদিন ধরে মুজিবনগরের নতুন কোনো পরিবর্তন না থাকায় কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আবার রাস্তার বিভিন্ন স্থানে সব ধরনের গাড়ি আটকে চাঁদা তোলা হলেও প্রশাসন বাধা দিচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জয়পুরহাট : জয়পুরহাট জেলা শহরে শিশু উদ্যান ও হাউজিং এস্টেট পার্ক, পাঁচবিবি উপজেলা শহরে পৌর পার্ক ছাড়াও লোকমা জমিদারবাড়ি, পাথরঘাটায় হজরত নাসির উদ্দিন শাহ বা নিমাই সন্ন্যাসীর প্রাচীন কীর্তি, কালাই উপজেলার ঐতিহাসিক নান্দাইল দিঘি ও ক্ষেতলাল উপজেলার প্রাচীন আচরাঙা দিঘি- জয়পুরহাটের এ ছয়টি ছোট বড় বিনোদন কেন্দ্রে ঈদের তৃতীয় দিন পর্যন্ত ছিল উপচে পড়া ভিড়। উৎসবে যোগ দিতে গতকালও শিশু-কিশোরসহ জয়পুরহাটের বিনোদন কেন্দ্রগুলোয় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন হাজার হাজার নারী-পুরুষ। প্রচন্ড খরতাপ সত্ত্বেও বাঁধভাঙা ভিড়ে মুখরিত ছিল জয়পুরহাটের বিনোদন কেন্দ্রগুলো।
গাজীপুর : এবারের ঈদে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে দর্শনার্থীর উপচে পড়া ভিড় ছিল। পার্কের প্রধান ফটকের বাইরে টিকিট কাউন্টার এবং কোর সাফারি পার্কের সামনে টিকিটের জন্য পর্যটকের দীর্ঘ লাইন পড়ে গেছে। বিভিন্ন বয়সী নরনারী ও শিশুর পদচারণে সাফারি পার্ক মুখরিত ছিল।
শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) : ছুটিতে পর্যটকের ঢল নেমেছে চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গলে। টানা তিন দিনের ছুটিতে পর্যটকে মুখরিত শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র। পর্যটকরা ছুটে বেড়াচ্ছেন এক স্পট থেকে অন্য স্পটে। পর্যটকদের আগমনে ঠাঁই ছিল না কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। ভিড় ছিল রমেশের সাত কালারের চা কেবিনে। পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে আসা শিশুরা ইতিহাস জেনেছে ‘বধ্যভূমি ৭১’-এ। এ ছাড়া শ্রীমঙ্গলের প্রবেশপথ মুছাইয়ে দৃষ্টিনন্দন চা কন্যা ভাস্কর্য পর্যটকদের আকৃষ্ট করেছে। পর্যটকরা ঘুরে বেড়িয়েছেন পাহাড়ি এলাকায় গড়ে ওঠা লেবু, আনারস, পান, রাবার ও কাঁঠাল বাগান। দেখেছেন এখানকার আদিবাসীদের বৈচিত্র্যময় জীবন ও সংস্কৃতি। ভিড় ছিল বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনে। সবুজ চা বাগানের অরণ্যে ছিল ফটো তোলার প্রতিযোগিতা। অনেকেই চা বাগানে দাঁড়িয়ে ফেলফি তুলে পোস্ট দেন নিজের টাইমলাইনে।
মানিকগঞ্জ : মানিকগঞ্জে বিনোদন কেন্দ্র না থাকায় লোকজন বিভিন্ন সেতুতে সময় কাটাচ্ছে। ঈদের দিন থেকেই শহরের বেউথা কালীগঙ্গা সেতু, সাটুরিয়ার তিল্লী সেতু, বালিরটেক সেতুসহ বিভিন্ন সেতুতে লোকজন ভিড় করছেন প্রশান্তির আশায়। দুপুরের পর থেকেই এসব সেতু দর্শনার্থীর পদচারণে মুখরিত হয়ে ওঠে। সরেজমিনে দেখা গেছে, নারী-পুরুষ-শিশুসহ সব বয়সের লোকজন সেতুতে সময় কাটাচ্ছেন।
টাঙ্গাইল : আনন্দ উপভোগ করতে টাঙ্গাইলের নাগরপুরের কেদারপুর ধলেশ্বরী নদীর ওপর নির্মিত শেখ হাসিনা সেতুতে ঢল নেমেছে বিনোদনপ্রেমীর। ফলে হাজার হাজার মানুষের স্রোতে মুখরিত রয়েছে এ সেতুটি। এখানে বসেছে হরেকরকম পণ্যের মেলাও।
লালমনিরহাট : উত্তরের সাগরকন্যা খ্যাত তিস্তা ঘিরে উপচে পড়া ভিড় জমেছে। তিস্তার বুকে যেটুকু পানি আছে তাতেই নৌকায় চড়ে সমুদ্রের সাধ মেটাচ্ছেন এ অঞ্চলের লাখো মানুষ। গতকাল ঈদের ছুটির তৃতীয় দিনে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ব্যারাজ এলাকায় দর্শনার্থীর ভিড় ছিল। বিভিন্ন স্থান থেকে কেউ এসেছেন মোটরবাইকে, কেউ অটোরিকশায়, আবার কেউ মাইক্রোবাসে চেপে। তিস্তা ব্যারাজ, তিনবিঘা করিডোর ও মহিপুর শেখ হাসিনা সেতুতে ঈদের ছুটির চার দিন চলবে আনন্দ-উৎসব।
হিলি (দিনাজপুর) : দর্শনার্থীর পদচারণে মুখরিত হয়ে উঠেছে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার জাতীয় উদ্যান ও ঐতিহাসিক আশুরার বিল। প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি শালবন ও বিলের সৌন্দর্য পরিবার-পরিজন নিয়ে উপভোগ করছেন দর্শনার্থীরা। তেমনি বিল ও বনের মাঝে অবস্থিত উত্তরবঙ্গের দীর্ঘতম আঁকাবাঁকা জেড আকৃতির শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব কাঠের সেতু দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন দেশের বিভিন্ন স্থানের ভ্রমণপিপাসুরা।
বাগেরহাট : বাগেরহাটে ঈদের ছুটিতে দুটি ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড সুন্দরবন ও ষাটগম্বুজ মসজিদ, শরণখোলার রায়েন্দা-বলেশ্বর রিভার ভিউ ইকো পার্ক ও হযরত খানজাহান (রহ.) দরগা-দিঘির পর্যটন স্পটে পর্যটকের ঢল নেমেছে। শরণখোলার রায়েন্দা-বলেশ্বর রিভার ভিউ ইকো পার্কে পর্যটকের উপচে পড়া ভিড় লেগেই রয়েছে। ঈদের লম্বা ছুটিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ একাধিক ভিভিআইপিও ঘুরে দেখেছেন সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্য।
সিলেট : সিলেটে ঈদের দিন বিকালে চা বাগানগুলোয় স্থানীয় পর্যটক ভিড় করেন। এবারও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ঈদের দিনের আনন্দ আরও রাঙিয়ে নিতে ঈদের দিন শনিবার বিকালে সিলেটের মালনীছড়া, লাক্কাতুড়া, তারাপুরসহ বিভিন্ন বাগানে পর্যটকের ভিড় জমে। কেউ কেউ আবার ঈদের দিন বিকালে জাফলং, সাদাপাথরসহ দূরের পর্যটন কেন্দ্রগুলোয়ও ছুটে যান। তবে সংখ্যায় খুব বেশি নয়। তাই মূলত ঈদের পর দিন থেকে সিলেটে জমে ওঠে পর্যটন কেন্দ্রগুলো। সিলেটের অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগে বিভিন্ন জেলা থেকে ছুটে আসেন পর্যটক। ঈদের ছুটিতে লাখো পর্যটকের সমাগম ঘটে সিলেটে। পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদের ছুটি কাটাতে কেউ আসেন দুই দিনের জন্য, কেউ আসেন তিন দিন সময় হাতে নিয়ে। অনেকে সিলেট ভ্রমণ শেষ করে চলে যান মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের পর্যটন কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখতে।
এবার ঈদের পরদিন সিলেটে বৃষ্টি থাকায় পর্যটক আগমনে বিঘ্ন ঘটে। যারা পরিবার নিয়ে সিলেটে বেড়াতে আসতে চেয়েছিলেন তারা অনেকেই রবিবারের বুকিং বাতিল করে দেন। এতে ঈদের পর্যটন ব্যবসা হোঁচট খায়। সিলেট হোটেল মোটেল অ্যান্ড গেস্টহাউস ওনার্স গ্রুপের সভাপতি এ টি এম শোয়েব জানান, গতকাল পর্যটক আসা শুরু করলেও তা আশাব্যঞ্জক নয়। এর জন্য প্রতিকূল আবহাওয়ার পাশাপাশি সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলোর উন্নয়ন না হওয়াকে দায়ী করেন তিনি।