বুধবার, ৩ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

সুপেয় পানির সংকট খুলনায়

লবণাক্ততা বৃদ্ধি, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পরিস্থিতি ভয়ংকর হচ্ছে

সামছুজ্জামান শাহীন, খুলনা

সুপেয় পানির সংকট খুলনায়

শুষ্ক মৌসুমে খুলনাসহ দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। তুলনামূলক কম বৃষ্টিপাতে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় গভীর নলকূপ থেকে পানি উঠছে না। সংরক্ষণের অভাবে শুকিয়ে গেছে খাবার পানির নিরাপদ উৎসগুলো। বিশ্লেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, চিংড়ি চাষ ও কৃষিজমি-জলাভূমি ভরাট করে অবকাঠামো নির্মাণে পরিস্থিতি ভয়ংকর হচ্ছে।

জানা যায়, খুলনার উপকূলে কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছায় খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হচ্ছে মাইলের পর মাইল। অপরিচ্ছন্ন ও দূষিত পানি ব্যবহারের ফলে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে উপকূলবাসী। এ ছাড়া নগরজুড়ে পানির সংকট মেটাতে আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনা ওয়াসা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাসের স্থানগুলো (বস্তি এলাকা) ওয়াসার পানি সংযোগ থেকে বঞ্চিত। নিরাপদ পানির অভাবে চরম বিপাকে পড়ছেন নিম্ন মধ্যবিত্তরা।

পানি বিষয়ক গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান অ্যাওসেড-এর নির্বাহী পরিচালক শামীম আরেফিন বলেন, খুলনার ২২ শতাংশ, বাগেরহাটে ১৫ শতাংশ এবং সাতক্ষীরার ১৩ শতাংশ মানুষ খাবার পানির সংকটে রয়েছে। সরকারিভাবে এই তথ্য দেওয়া হলেও বাস্তবের চিত্র আরও ভয়াবহ। লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় নষ্ট হচ্ছে মিষ্টি পানির আধার। অপরিকল্পিতভাবে ভুগর্ভস্থ পানি উত্তোলনে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় গভীর নলকূপে পানি উঠছে না। যেখানে সেখানে পুকুর দিঘি ভরাট করা হচ্ছে। এত সংকট আরও বাড়ছে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘পরিবর্তন খুলনা’র নির্বাহী পরিচালক নাজমুল হাসান ডেভিড বলেন, শুষ্ক মৌসুমে খুলনায় মানুষের পানির কষ্ট চলছে ৮-১০ বছর ধরে। প্রতি বছরই পানির কষ্ট বাড়ছে। সাবমারসিবল পাম্প বসিয়ে অথবা উচ্চমূল্যে অনেকে পানি কিনে খেতে পারেন। কিন্তু বস্তিবাসীর সে সুযোগ নেই। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে তাদেরকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। পানির জন্য তারা অপরিসীম কষ্টে ভুগছেন। জানা যায়, বর্তমানে খুলনা শহরের ১৫ লাখ মানুষের প্রতিদিন গড় পানির চাহিদা ২৪ কোটি লিটার। বর্তমানে খুলনা ওয়াসা ২১ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করছে। শুষ্ক মৌসুমে এই চাহিদা আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। নগরীর টুটপাড়া এলাকার বাসিন্দা মশিউর রহমান বলেন, বর্ষা মৌসুমে নলকূপগুলোতে পানি ওঠার কারণে নগরীতে পানির চাহিদা তেমন এটা থাকে না। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পানির সংকট বাড়তে থাকে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের তথ্য অনুযায়ী, শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর স্বাভাবিকের তুলনায় দুই-আড়াই ফুট নিচে নেমে যাওয়ায় গভীর নলকূপে পানি উঠছে না। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় বিভিন্ন স্থানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় খননকৃত পুকুরও শুকিয়ে গেছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর, খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আকমল হোসেন জানান, সাধারণত উপকূলীয় অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২৫-৩০ ফুটের মধ্যে থাকে। কিন্তু বর্তমানে পানির স্তর আরও দুই-আড়াই ফুট নিচে নেমে গেছে। ফলে পানির সংকট বাড়ছে।

এদিকে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের জরিপ মতে, খুলনাঞ্চলে মাটি-পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। সর্বশেষ গত এপ্রিলে খুলনার পাইকগাছায় মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ছিল ১১.২ ডিএস (লবণাক্ততা পরিমাপের একক) পারমিটার। এখানে শিবসা নদীতে পানির লবণাক্ততা ছিল ৩২.২ ডিএস পারমিটার।

মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, খুলনা বিভাগীয় কার্যালয় মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জিএম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ফসল উৎপাদনের জন্য মাটিতে ০-৪ ডিএস পারমিটার লবণাক্ততা সহনশীল। সেচের পানির জন্য ১-৩ ডিএস ও খাওয়ার পানির জন্য ১ ডিএস পারমিটার পর্যন্ত লবণাক্ততা সহনশীল।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কর্মকর্তারা বলছেন, এ অবস্থা উত্তরণে নিরাপদ পানির উৎস তৈরি ও সংরক্ষণ কাজ চলছে। দুই বছরে খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় সাত হাজার গভীর নলকূপ ও ৩২টি পুকুর খনন করা হয়েছে। একই সঙ্গে শহরাঞ্চলে পানি দূষণের ক্ষেত্র বন্ধ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে জোর দেওয়া হচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর