ফরিদপুরের ভাংগা উপজেলার পুখুরিয়ায় রাশিদা আক্তার (৩০) নামের এক গৃহবধুর উপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে মারাত্বক ভাবে আহত করা হয়েছে।
নির্যাতনকারীরা তাকে শুধু রড, লাঠি দিয়ে পিটিয়েই শান্ত হয়নি। মধ্যযুগীয় কায়দায় চুল কেটে এবং গোপনাঙ্গে রুটি বানানোর বেলুন দিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে ঐ গৃহবধুকে। মঙ্গলবার বিকালে রাশিদার স্বামীর প্রথম পক্ষের স্ত্রী, তার দুই মেয়ে ও মেয়ের জামাই এ ঘটনা ঘটায়।
বর্তমানে আশংকাজনক অবস্থায় রাশিদা আক্তার ভাংগা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালের বেডে যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছেন। বিষয়টি নিয়ে গ্রাম্য মাতব্বরদের মাধ্যমে ভয়ভীতি দেখিয়ে মিটমাট করার চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে। এদিকে এ ঘটনায় আজ দুপুরে ভাংগা থানায় একটি মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ মিজানুর রহমান।
স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, ভাংগার বাহ্মনকান্দার মৃত আঃ খালেক বেপারীর মেয়ে রাশিদা আক্তারকে ১ মাস আগে বিয়ে করে একই গ্রামের কামরুজ্জামান শেখ। কামরুজ্জামানের আগের স্ত্রী থাকলেও সে রাশিদাকে বিয়ে করার পর বেশকিছু দিন অন্যত্র ছিল। গত কয়েকদিন আগে কামরুজ্জামান তার নতুন স্ত্রী রাশিদাকে নিয়ে পুখুরিয়া বাজারস্থ রেবা বেগমের বাড়ীতে ভাড়াটিয়া হিসাবে ওঠে।
মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে কামরুজ্জামানের প্রথম পক্ষের স্ত্রী, তার দুই মেয়ে ও মেয়ে জামাই ঐ ভাড়াটিয়ার বাড়ীতে গিয়ে হামলা চালায়। এসময় তারা ঘরের ভেতর থেকে কামরুজ্জামানকে টেনে হেঁচড়ে বাইরে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে তারা ঘরের ভেতরের দরজা আটকিয়ে রাশিদা আক্তারের উপর হামলা চালায়।
লোহার রড, কাঠের লাঠি দিয়ে শরীরের সর্বত্র বেদমভাবে পেটাতে থাকে। এক পর্যায়ে কামরুজ্জামানের প্রথম পক্ষের স্ত্রী ও দুই মেয়ে রাশিদার মাথার সব চুল কেটে দেয়। অমানুষিক নির্যাতনের এক পর্যায়ে রাশিদার গোপনাঙ্গে রুটি বানানোর বেলুন দিয়ে খুচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে তারা।
এসময় রাশিদার চিৎকারে আশ পাশের লোকজন এগিয়ে এলেও তারা ঘরের ভেতর ঢুকতে পারেনি। একপর্যায়ে রাশিদাকে কুপিয়ে আহত করা হয়। স্থানীয়রা ঘরের দরজা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে মুমূর্ষ অবস্থায় রাশিদাকে উদ্ধার করে ভাংগা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে।
বর্তমানে সারা শরীরে প্রচন্ড যন্ত্রনা নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন রাশিদা। রাশিদার মা আনোয়ারা বেগম জানান, তার একটি মাত্র মেয়ে। পাষণ্ডরা রাশিদাকে যেভাবে মেরেছে তা মানুষ হয়ে মানুষকে মারতে পারেনা। কথা বলার এক পর্যায়ে আনোয়ারা বেগম রাশিদার কাটা চুল নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন।
রাশিদার ভাই মোঃ মানিক জানান, আমার বোনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে ও কুপিয়ে আহত করা হয়েছে। আমার বোন এখন আর দাঁড়াতে পারেনা। তাকে এমনভাবে মারা হয়েছে যে, শরীরের কোন জায়গাই বাকি রাখেনি। শরীরের এমন স্থানে আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে যে তা মুখে বলাও যায়না। এ বিষয়টি নিয়ে গ্রাম্য মাতব্বররা নানা ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। আমরা গরীব মানুষ। কয়েকবার থানায় গিয়েও মামলা করতে পারিনি। নানা কথা বলে আমাদের শান্তনা দেয়া হচ্ছে।
রাশিদার স্বামী কামরুজ্জামান শেখ বলেন, প্রথম পক্ষের স্ত্রী, ছেলে-মেয়েদের নানা রকম অত্যাচার সইতে না পেরে রাশিদাকে বিয়ে করি। তাকে বিয়ে করার পরই বেশ কিছু দিন অন্যত্র ছিলাম। তিনদিন আগে গ্রামে এসেছি। আমার প্রথম পক্ষের স্ত্রী, দুই মেয়ে ও জামাই এবং ছেলে মিলে আমাকে ঘরের বাইরে এনে বেদমভাবে প্রহার করে। আর আমার দ্বিতীয় স্ত্রী রাশিদাকে ঘরের মধ্যে আটকে রেখে সারা শরীরে পিটিয়ে আহত করে। তারা রাশিদার মাথার চুল কেটে দেয়। এ বর্বর ঘটনার বিচার আমি চাই।
বাড়ীর মালিক রেবা বেগম জানান, বিকেলের দিকে ৭/৮ জন বাড়ীতে এসে হামলা চালায়। তারা রাশিদাকে ঘরের মধ্যে আটকে রেখে নির্যাতন করে। এমন নির্মম নির্যাতন আমি জীবনে দেখিনি। তারা মেয়েটির শরীরের গুপ্ত স্থানে আঘাত করে থেতলে দিয়েছে। মাথার চুল কেটে দিয়েছে। আমরা ঠেকাতে গেলে আমাদের খুন করে ফেলবে বলে হুমকি দিয়েছে।
এদিকে বুধবার দুপুরে ভাংগা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, রাশিদা আক্তার কেবিনের ৪৪ নং রুমের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন। রাশিদার দুই হাত ও পা সহ শরীরের সর্বত্র মারধরের কারণে ফুলে নীল হয়ে রয়েছে। মাথায় সেলাই দেয়া হয়েছে ৭টি।
এব্যাপারে কান্নাজড়িত কন্ঠে রাশিদা বলেন, আমাকে নির্মমভাবে পেটানো হয়েছে। শরীরের উপর ওঠে লাফিয়েছে কয়েকজন। ওড়না দিয়ে মুখ বেঁধে মাথার চুল কেটে দেয়া হয়েছে। শরীরের কয়েকটি জায়গায় রুটি বানানোর বেলুন দিয়ে খোঁচানো হয়েছে। যন্ত্রনায় আমি তাদের কাছে প্রাণভিক্ষা ও স্বামীকে ছেড়ে দেবো বললেও তারা আমার কথা না শুনে আরো বেশী নির্যাতন চালিয়েছে।
কান্নাজড়িত কন্ঠে রাশিদা এ ঘটনার বিচার চেয়েছে।
ভাংগা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. রাশিদুল হাসান জানান, আগের চেয়ে রাশিদার অবস্থা বর্তমানে কিছুটা ভালো। তবে বিভিন্ন স্থানে আঘাতের কারনে শরীর ফুলে গেছে।
এদিকে নির্মম বর্বরতার শিকার রাশিদা বেগমের উপর হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী করেছেন স্থানীয় এলাকাবাসী।
স্থানীয়দের অভিযোগ, গ্রাম্য কয়েকজন মাতব্বর ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে উঠে পড়ে লেগেছে। তারা পুলিশকে ম্যানেজ করে রাশিদা ও তার ভাইকে মিমাংসার জন্য হুমকি দিচ্ছে। যার কারনে পুলিশ মামলা নিতে গরিমশি করছে।
ভাংগা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ মিজানুর রহমান জানান, ঘটনাটি অত্যান্ত দুঃখজনক। এ ঘটনায় রাশিদার স্বামী কামরুজ্জামান বাদি হয়ে ৪ জনকে আসামী করে একটি মামলা করেছে। বুধবার দুপুরে মামলাটি গ্রহন করা হয়েছে। আসামীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
বিডি-প্রতিদিন/২৭ এপ্রিল ২০১৬/ হিমেল-১৭