বাংলাদেশের অর্থনীতি সামগ্রিকভাবে এখনো স্থিতিশীল ও ইতিবাচক অবস্থায় রয়েছে। তবে বিদ্যমান ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা দেশের প্রবৃদ্ধির ধারাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক একাশিত এক প্রতিবেদনে এমন আশঙ্কার কথা তুলে ধরা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনীতি নানা চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে স্থিতিশীল জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
বহির্বাণিজ্য খাতের ইতিবাচক প্রবণতা, অভ্যন্তরীণ চাহিদার শক্তিশালী অবস্থা, মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমে আসা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে উন্নতি—এসবই অর্থনীতিকে স্বস্তির বার্তা দিচ্ছে। অনুকূল আবহাওয়া এবং আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কম থাকায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করছে।
তবে এই ইতিবাচক ধারা টিকিয়ে রাখার পথে বেশ কিছু ঝুঁকি রয়েছে। বিশেষ করে চলমান আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ।
প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সংঘাত, মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ পরিস্থিতি, লোহিত সাগর ও মালাক্কা প্রণালির বাণিজ্যপথে অস্থিরতা এবং যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য দ্বন্দ্ব বাংলাদেশের রপ্তানি ও আমদানি উভয় ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বোঝানো হয়েছে, এসব ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি তেল ও খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, যা মূল্যস্ফীতি আবারও ঊর্ধ্বমুখী করতে পারে। একই সঙ্গে বৈদেশিক বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানির অর্ডার এবং রেমিট্যান্সপ্রবাহেও অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশাবাদী যে ব্যাংকিং খাতের চলমান সংস্কার, বিশেষ করে একীভূতকরণ (মার্জার) প্রক্রিয়া এবং আর্থিক খাতের পুনর্গঠন অর্থনীতিকে আরো টেকসই করতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি মুদ্রাস্ফীতির নিম্নমুখী প্রবণতা অব্যাহত থাকলে নীতিমালা সুদের হারও সমন্বয় করা হতে পারে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে ব্যবসার কোনো পরিবেশ নেই। তাঁরা খুবই চাপের মুখে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের (বিইএফ) সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘এখন বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশ নেই। ব্যবসায়ীরা নতুন করে বিনিয়োগ করছেন না।
তাই ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি শ্লথ হয়ে গেছে। আর এ কারণেই রপ্তানি কমেছে, আবার ডলারের চাহিদাও কমেছে। যেহেতু রপ্তানির সঙ্গে আমদানি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাই কেন আমদানি কমছে তা সহজেই অনুমান করা যায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘নতুন বিনিয়োগ না থাকার কারণে ক্রমেই বাড়ছে কর্মসংস্থান সংকট। তাই যত দ্রুত সম্ভব দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। তখন দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীরা অন্তত চার থেকে পাঁচ বছরের নিশ্চয়তা পাবেন; বিনিয়োগের সাহস পাবেন।’
বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এখন সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা। বিনিয়োগকারীরা সব সময় স্থিতিশীলতা খোঁজেন। এর বাইরে যেসব সমস্যা আছে, যেমন—জ্বালানি, কাস্টমস, যাতায়াত, ডলারকেন্দ্রিক সমস্যার সমাধান খোঁজা সম্ভব। কিন্তু রাজনৈতিক সহিংসতা ও সড়ক অবরোধ দেখলেই বিনিয়োগকারীরা পিছিয়ে যান।’
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সাম্প্রতিক মন্তব্য ‘নো ভায়োলেন্স’ এই সতর্কতাই স্মরণ করিয়ে দেয়। তাঁরা বলেন, আমরা দ্রুত মুনাফার খোঁজে থাকা বিনিয়োগকারী। একই সঙ্গে খামখেয়ালিও। যদি আমাদের বাজারে ধরে রাখতে চান, তাহলে সহিংসতা করবেন না। দয়া করে কোনো সহিংসতা নয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নানা সংকট পেরিয়ে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি এখনো টিকে আছে ইতিবাচক ধারায়। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩.৯৭ শতাংশ, যা সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দেয়। যদিও ২০২৫ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৩.৩৫ শতাংশে, তার পরও দেশের শিল্প খাত ৪.৩৪ শতাংশ হারে বেড়েছে, যা আগের বছরের ৩.৬১ শতাংশ থেকে বেশি। এটি অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অন্যদিকে কৃষি খাতের দুর্বল পারফরম্যান্স ও সেবা খাতে মাঝারি প্রবৃদ্ধি সামগ্রিক অর্থনৈতিক গতি কিছুটা ধীর করেছে। তবু বহির্বাণিজ্য ও রেমিট্যান্সপ্রবাহ অর্থনীতিতে প্রাণ ফিরিয়েছে। ২০২৫ অর্থবছরে রপ্তানি বেড়েছে ৭.৭২ শতাংশ, আমদানি ১.৭৫ শতাংশ এবং প্রবাস আয় (রেমিট্যান্স) বেড়েছে ২৬.৮৩ শতাংশ হারে। রেমিট্যান্সপ্রবাহ দাঁড়িয়েছে ৩০.৩৩ বিলিয়ন ডলারে, যা চলতি হিসাবে (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট) উদ্বৃত্ত তৈরি করেছে। ফলে ২০২৪ সালের ঘাটতির বদলে ২০২৫ অর্থবছরে ৩.৩৯ বিলিয়ন ডলারের সার্বিক উদ্বৃত্ত অর্জিত হয়েছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১.৭৭ বিলিয়ন ডলারে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার বেশি।
মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রেও ইতিবাচক অগ্রগতি দেখা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর মুদ্রানীতি অব্যাহত রাখার ফলে ২০২৫ সালের জুনে সাধারণ মূল্যস্ফীতি (সিপিআই) কমে দাঁড়িয়েছে ৮.৪৮ শতাংশে—গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ৭.৩৯ শতাংশে নামায় মানুষের জীবনযাত্রায় স্বস্তি ফিরেছে। জ্বালানির দাম কমায় অ-খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিও কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।