সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে গবাদি পশুর রোগ অ্যানথ্রাক্স ফের ছড়িয়ে পড়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে উপজেলার চরকৈজুরী ও গোপালপুর গ্রামের ২৪জন নারী-পুরুষ-শিশু অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হয়েছে। অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত একটি গরু ও ছাগলের মাংস কাটা ছেড়া ও রান্নাবান্না করে খাওয়ার পর এদের শরীরের অ্যানথ্রাক্স রোগ দেখা দেয়।
এদিকে, বার বার অ্যানথ্রাক্স রোগ দেখা দেওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে মাংস খাওয়া নিয়ে এক ধরনের ভীতি সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মতে, প্রাণী সম্পদ ও স্বাস্থ্য বিভাগের উদাসীনতা এবং গাফিলতির কারণে বার বার এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে। তবে প্রাণী সম্পদ বিভাগ বলছে, জনসচেতনতার অভাবই এর জন্য মূলত দায়ী। যার কারণে অসুস্থ গরুর জবাইয়ের পর সেই গরুর মাংস খেয়ে মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আর স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, সঠিক সময়ে গবাদিপশুগুলোকে ভ্যাকসিন না দেওয়াই এর মুল কারণ।
জানা যায়, গত ৮ আগস্ট চরকৈজুরি গ্রমের দেলবার প্রামানিকের একটি অসুস্থ গরু কম দামে ক্রয় করে কয়েকজন গ্রামবাসী। এরপর গরুটি জবাই করে গ্রামের প্রায় ৫০টি পরিবার তা ভাগাভাগি করে নেন। এই মাংস কাটাকাটি ও নাড়া-চাড়ার সাথে জড়িতদের প্রথমে হাত-পা-চোখসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে কালো ক্ষত ও ঘায়ের মতো দেখা দেয়। পরে স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে গিয়ে ওষুধ খাবার পর ভাল না হওয়ায় তিনজন সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালে যান। পরে হাসপাতালের চিকিৎসকরা এটিকে অ্যানথ্রাক্স বলে শনাক্ত করেন।
এছাড়াও একই গ্রামের আরো একটি অসুস্থ ছাগল জবাই করে ১০টি পরিবার ভাগাভাগি করে নেন। পরে শাহজাদপুর উপজেলা কমপ্লেক্সের মেডিকেল টিম ওই গ্রামে ছুটে যান। এ দুটি পশুর মাংস কাটাকাটি ও রান্না কাজে জড়িত ২৪ জন নারী-পুরুষ শিশুকে অ্যানথ্রাক্স রোগীকে শনাক্ত করেন।
এদিকে, একই বছরে তিন দফায় গবাদি পশুর রোগ মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ায় জেলার সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মতে, প্রাণী সম্পদ বিভাগ সঠিক সময় গবাদিপশুকে ভ্যাকসিনের আওতায় না আনায় বার বার এ রোগের প্রার্দুভাব ঘটছে। এর আগে একই গ্রামে ৩১জন অ্যানথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হয়েছিল।
গরুর মালিক দেলবার জানান, যে গরুটি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, সেটিকে ভ্যাকসিন দেয়া ছিল না। তাছাড়া অসুস্থ গরু যে জবাই করা যাবে না, এ বিষয়ে প্রাণী সম্পদ বিভাগ বা অন্য কেউ আমাদের জানায়নি। শুধু দেলবার নয়, যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের প্রায় সবাই একই কথা বলেন। তারা জানান, অসুস্থ গরুর মাংস খেলে যে এমন রোগ হয় এটি তাদের জানা ছিল না। কেউ বিষয়টি অবহিত করেনি।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, যখন অ্যানথ্রাক্স দেখা দেয় তখনই শুধু স্বাস্থ্য ও প্রাণী সম্পদ বিভাগের লোকজনকে মাঠে দেখা যায়। এর আগে কাউকে দেখা যায় না। কোন পোস্টার বা মাইকিং করা হয়নি। যদিও বা মাইকিং করা হয় তা নামমাত্র।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম বার বার এ রোগের জন্য প্রাণী সম্পদ বিভাগকে দায়ী করে বলেন, গবাদি পশুর জন্য বিখ্যাত শাহজাদপুর উপজেলায় প্রায় সাড়ে ছয় লক্ষাধিক মানুষ রয়েছে। প্রাণী সম্পদ বিভাগের ছোট্ট একটি অফিসের জনাকয়েক কর্মকর্তা-কর্মচারি দিয়ে জনসচেনতা সম্ভব নয়। রোগটি সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য ব্যাপক জনসচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন।
শাহজাদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা জাফরুল হোসেন জানান, গরু থেকে অ্যানথ্রাক্স মানুষে ছড়িয়ে পড়ে। কারণ যখন একটি গরু ঘাস খায় তখন ঘাসের মাটিও খায়। ওই সময় মাটিতে মিশে থাকা অ্যানথ্রাক্সের জীবানুও খেয়ে ফেলে। ফলে সহজেই গরুতে অ্যানথ্রাক্স ছড়িয়ে পড়ে। তাই অ্যানথ্রাক্স নির্মূলের জন্য সব গবাদিপশুকে বাধ্যতামূলক ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে হবে। তবে বেশির ভাগ মানুষের চামড়ায় অ্যানথ্র্যাক্স আক্রান্ত হয়। আর নিয়মিত সিপ্রোফ্লোক্সাসিন ট্যাবলেট (১০মিলিগ্রাম) ৭দিন চিকিৎসকের পরামর্শে খেলে এটি ভাল হয়।
শাহজাদপুর উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা আব্দুস সামাদ জানান, জনসচেনতাই মুলত এর জন্য দায়ী। দেখা যায়, অসুস্থ গরু জবাই করা যাবে এটি ভুলে যায়। তারা লোভের বশীভূত হয়ে গরুটি জবাই করে অল্পদামে মাংস ভাগাভাগি করে নেন। এতে গরুর মালিকও লাভবান হন ক্রেতারাও লাভবান হন। অ্যানথ্রাক্স থেকে মুক্তি পেতে হলে গরুর মালিক ও জনগনকে এই প্রবণতা থেকে সরে আসতে হবে।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ২৯ জুলাই শাহজাদপুর উপজেলার কায়েমপুর গ্রামে প্রথম এই রোগ দেখা দেয়। ওই সময় প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। এরপর থেকে প্রতিবছরই শাহজাদপুর ছাড়াও উল্লাপাড়া, বেলকুচি ও কামারখন্দসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে।
বিডি প্রতিদিন/ ২৩ আগস্ট ২০১৬/ সালাহ উদ্দীন