শেরপুরে ভাতের অভাবে এক কিশোরী গলায় দড়ি দিয়ে আত্নহত্যা করেছেন। হতভাগ্য ঐ কিশোরীর নাম কণিকা (১২)। কণিকা শেরপুর সদর উপজেলার গাজীর খামার ইউনিয়নের চককোমড়ি গ্রামের জনৈক কোরবান আলীর মেয়ে। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত শেষে আজ সন্ধ্যায় পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। খবরের লেখা পর্যন্ত লাশ সৎকারের কাজ চলছিল।
এলাকাবাসী, কণিকার আত্নীয়-স্বজন ও কণিকার বাবা কোরবান আলী জানিয়েছে, দীর্ঘ অভাবে ক্ষুধার কারণেই কণিকা আত্নহত্যার পথ বেছে নেয়। মৃত্যুর আগে কণিকার সাথে কারও কথা কাটাকাটি বা ঝগড়া হয়নি। অত্যন্ত শান্ত ও চাপা স্বভাবে মেয়ে ছিল কণিকা। সংসারে এত অভাব থাকলেও অভাবের কথা কখনও প্রতিবেশীদের সাথে বলত না।
কণিকার বাবা কোরবান আলী জানিয়েছে আমার অক্ষমতার জন্য ওদের ঠিক মত ভরণপোষণ করতে পারিনি। ভাতের ক্ষুধা সব সময় মেয়েটির চোখে-মুখে লেগেই থাকতো। ৬০ টাকা কেজি চাল প্রয়োজনীয় চাল কিনতে পারতাম বলে অল্প চালের রান্না হত। আমাকে ও ছেলেকে খাওয়ানোর পর মেয়েটি খেত। কিছু বললে কথা বলতো না। ২-৩ বার এলাকার মেম্বারের কাছে গিয়েছিলাম ভিজিএফ এর কার্ড চাইতে, মেম্বার কার্ড দেয়নি। সরকারের ১০ টাকা কেজি চাল চাইতে গিয়েছি তাও ভাগ্যে জুটেনি। চেয়ারম্যান কখনও খোজ নেয়নি। সরকারি কোন রকম সহযোগিতা কখনও পাইনি। ৬ মাস আগে নান্টুঘোষ বাজারে নৈশ প্রহরির চাকরি নিয়ে ছিলাম।একটি গাছের খোলা আকাশের নীচে কণিকা আর ছেলে আকাশকে বুকে নিয়ে রাতে ঘুমাতাম। এলাকাবাসির অভিযোগ কোরবানের মত এমন হতদরিদ্র লোক এই তল্লাটে নেই। কিন্তু কোন সরকারি সহযোগীতা সে কখনও পায়নি।
কণিকার বাবা বিলে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালায়। যেদিন মাছ না পাওয়া যায়, আবহাওয়া বা শরীর খারাপ থাকলে সেদিন না খেয়েই কণিকাদের থাকতে হয়। কণিকা ক’দিন স্কুলেও গিয়েছিল। অভাব, সৎ মা আর এই বয়সেই বাবা ও ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। অভাবের তারনায় মোটামোটি চিকিৎসা ছাড়াই ৮ বছর আগে কণিকা ও তার ভাই আকাশকেকে রেখে মা মমতা ইহলোক ত্যাগ করেন। তারপরে বাবা কোরবান আলী আরেকটি বিয়ে করেন। সৎ মায়ের দিকে কণিকার আরও দুই ভাই-বোন আছে। কষ্ট আর অভাবের সংসার হওয়ায় কণিকার সৎ মা মাস খানেক আগে স্বামীর বাড়ী ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে যান। জানা গেছে অভাবের কারণে সদ্য জন্ম নেওয়া কণিকার সৎ ছোট ভাইকে সৎ মা অন্যের কাছে দত্তক দিয়েছেন। বাবা ও ভাইকে নিয়ে ছোট্ট একটি ভাঙ্গা ঘরের ছোট্ট একটি চকিতে কণিকারা থাকত।
প্রতিবেশী সিদ্দিক আলী, আজিজুর রহমান ও অসংখ্য মহিলারা জানিয়েছে, অভাব আর ক্ষুধা কণিকাদের নৃত্য সঙ্গি। ২-৩ দিন ধরে তারা খুদ আর বাবার ধরা চিংড়ি মাছ ভাজি খেয়ে দিন কাটাতো। ঘটনার দিন রাতে অর্ধ পেটে খেয়ে বাবা ও ছোট ভাইকে নিয়ে কণিকারা ঘুমায়। ভোরের দিকে বাবা বিলে মাছ ধরতে যায়। ঘরে কোন চালডাল ছিল না তবে ভাই আকাশের কাছে থাকা ৫ টাকা নিয়ে কাচা মরিচ কিনবে বলে ভাইকে বলেছিল। ভাই টাকা দিয়ে খেলতে চলে গেলে ফাঁসিতে ঝুলে ওই কিশোরি আত্নহত্যা করে। সকাল ৯ টার দিকে ভাই ঘরে খেতে এসে দেখে কণিকার ঝুলে আছে। সরজমিনের গিয়ে দেখা গেছে কণিকার এই মৃত্যু নিয়ে এলাকায় শোকে ছায়া নেমে আসে। বাবার আজাহারিতে এলাকায় বাতাস ভারি হয়ে ওঠেছে। বাবা চিৎকার করে বলছে আমার মেয়েটি ভাতের অভাবে অভিমান করে এই পথ বেছে নিল, এই জীবন দিয়ে আর কি হবে। এমন কথা বলে কোরবান আলী বার বার মূর্ছা যাচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে এলাকার ইউপি সদস্য আজগর আলীর সাথে কথা হলে তিনি জানান, অভাবের কারণেই কণিকা আত্নহত্যা করেছে। কণিকার বাবা কোরবান আলী আমার কাছে একবার এসেছিল কার্ড চাইতে। আমি বলেছি আবার কার্ড আসলে পরের বার দিব।
গাজীর খামার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আওলাদুল ইসলাম আওলাদ জানিয়েছে, কোরবান আমার কাছে কখনও আসেনি বা তার অবস্থার কথা কেউ বলেনি। তবে মারা যাওয়ার পর লাশ ময়নাতদন্ত ও লাশ আনা নেওয়ার খরচ আমি বহন করেছি। শেরপুর সদর থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে, ঘটনাটি পুলিশ তদন্ত করে দেখছে বলে শেরপুর সদর থানার ওসি নজরুল ইসলাম জানিয়েছে।
বিডি প্রতিদিন/এ মজুমদার