নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলায় ২০০ বছরের পুরনো কাইকারটেক হাট বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সংস্কার না হওয়ায় ঐতিহ্য হারাচ্ছে হাটের। যদিও আগের নিয়মেই প্রতি রবিবার এখনো হাট বসে। হাটের দিন নেই আগের মতো সরগরম। ২০০ বছর আগে উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে কাইকারটেক হাটের যাত্রা শুরু হয়।
জানা গেছে, সোনারগাঁও উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে প্রায় ৫০ বিঘা জমি ঘিরে কাইকারটেক হাটের অবস্থান। জলপথ ও সড়ক পথে পণ্য আনা-নেওয়ার সুবিধার্থে নদীর তীরে হাটটি বসানো হয়। কিন্তু কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যেতে বসেছে হাটের যৌলুস। আগের মতো আসেন না ক্রেতা-বিক্রেতা।
এই হাটে সোনারগাঁও উপজেলা ছাড়াও পাশের নারায়ণগঞ্জের বন্দর, আড়াইহাজার, নরসিংদী, কুমিল্লার মেঘনা, দাউদকান্দি ও মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার বাসিন্দারা হাটে নানা পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করেন। ঈদুল আজহার সময় এখনো নারায়ণগঞ্জের সবচেয়ে বড় পশুর হাট এখানে বসে।
২০০ বছরের পুরোনো এই হাট এখনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। স্বাধীনতার পর সরকারিভাবে এ হাটের কোনো উন্নয়নকাজ করা হয়নি। সপ্তাহে প্রতি রবিবার হাটটি সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় নানা কিছুর পসরা সাজিয়ে বসে এই হাট। আপনি গেলেই দেখতে পাবেন সবাই বেশ উৎসবমুখর পরিবেশে মাছ ধরার বিভিন্ন সামগ্রী, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, কবুতর, খাল ও নদীর মাছ, কাস্তে, দা, বটি, কুড়াল, জামা-কাপড়, কলমের গাছসহ নিত্য ব্যবহার্য নানা কিছু বেচাকেনায় ব্যস্ত। মৌসুমী নানা ফল, যেমন-আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল ও খাবার জিনিস থেকে শুরু করে ঘরে বানানোর আসবাবপত্র সবই ওঠে এখানে।
ঐতিহ্যবাহী কাইকারটেক হাটের নৌকার কেনাবেচার ইতিহাস বহু বছরের পুরোনো। এ হাটের নৌকার খ্যাতি এলাকা ছাড়িয়ে আশপাশের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে গেছে। আর তাই বছরজুড়ে হাট বসলেও শুধু আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র ও আশ্বিন এই চার মাস কম দামে ভালো মানের নৌকা কেনার জন্য বিভিন্ন জেলা থেকে শত শত ক্রেতার আগমন ঘটে। বছরের মধ্যে বিশেষ করে এ ৪ মাস কাইকারটেক হাট প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর হয়ে ওঠে।
হাটে বিক্রি হওয়া মজার মজার খাবারের স্বাদ মুগ্ধ করে আগন্তুকদের। ঐতিহ্যবাহী এই কাইকারটেক হাট ইতিহাস-ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত হলেও এ হাটের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হলো বিশেষ এক ধরনের মিষ্টি। ওজন আর পরিমাপে অন্যান্য মিষ্টির তুলনায় এই মিষ্টি চার থেকে পাঁচগুণ বড়। এর ওজন এক থেকে দুই কেজি হয়ে থাকে। অনেকটা শিলপুতার মতো দেখতে এই মিষ্টির নাম দেওয়া হয়েছে ‘পুতা মিষ্টি’।
এ হাটের মতোই পুতা মিষ্টির ঐতিহ্যও অনেক পুরনো। রবিবার এই হাটে অনেকে শুধু এ মিষ্টির স্বাদ নেওয়ার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন অনেক মিষ্টিপ্রেমী। তবে এ মিষ্টি কবে, কে, কীভাবে তৈরি শুরু করে এ ব্যাপারে তেমন কোনো তথ্য দিতে পারেনি এখানকার মিষ্টি তৈরির কারিগর ও ব্যবসায়ীরা। ২০০-৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় পুতা মিষ্টি।
পুতা মিষ্টির বাইরে তালের রসা, কালোজাম, রসগোল্লা, জিলাপি, মোহনভোগ, লালভোগ, বালুশাহ্সহ নানা পদের মিষ্টি থেকে শুরু করে দই, পরোটা-ভাজি, ডালসহ নানা পদ এখানে পাওয়া যায়। শুধু মিষ্টি নয়, এখানে বিক্রি হয় টক দই ও আখের গুড় দিয়ে বানানো লাচ্ছি, বিশেষ ঝালমুড়ি, মুরালি, বুট, পেঁয়াজু, নিমকি, চানাচুর, মোয়াসহ নানা ধরনের লোকজ খাবার। এ ছাড়াও অনেক পদের মাছের শুঁটকিও এখানে খুব নামকরা। অনেকেই চ্যাপা ও ইলিশ শুঁটকি কিনতে এ হাটে আসেন।
মো. আলফাজ উদ্দিন কাঠ ব্যবসায়ী বলেন, ঐতিহাসিক কাইকারটেক হাট এখন আর আগের মতো নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ। রাস্তাঘাট ভাল না থাকায় দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসতে পারে না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দৃষ্টি আকর্ষণ যাতে এই হাটটি সুলভ করতে পারি।
সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আতিকুর রহমান বলেন, ২০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী কাইকারটেক হাটটির উন্নয়নমূলক কাজ শিগগির শুরু করা হবে।
কাইকারটেক হাটটি রক্ষার দাবি সর্বমহলের। হাটটি সংস্কার করা হলে ফিরে পাবে হারানো যৌলুস।
বিডি প্রতিদিন/এমআই