রাজবাড়ীর ব্যস্ততম রেলগেট এলাকায় সাহায্যের কথা বলে এক ধরনের ড্রাগ ব্যবহার করে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। অভিনব এই ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন প্রিয়া আক্তার (২৫) নামে এক কলেজ শিক্ষার্থী। গত ১১ অক্টোবর বিকাল ৪ টার দিকে রাজবাড়ীর ১নং রেলগেট এলাকায় এই ঘটনা ঘটে।
শনিবার সকালে প্রিয়া আক্তারের মা ছালমা বেগম (৪৫) বাদী হয়ে রাজবাড়ী সদর থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন। সেদিনের ঘটনার বিষয়ে প্রিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিকাল সাড়ে ৪ টার দিকে ১নং রেলগেটের সামনে একটা ছেলে (২৫) এসে আমার কাছে তার মায়ের অসুস্থতার কথা বলে সাহায্য চান। আমি তাকে কোনো পাত্তা না দিলে ঠিক ওই সময় আরও একজন লোক (৩২) এসে হাজির হয়। তিনি বলেন, ‘আপা এই ছেলেটা গরীব, আসেন আমি আর আপনি সাহায্য করি।’ পরে আমি যখন বললাম যে আমি কোনো সাহায্য করতে পারবো না, তখন তারা আমার মুখের সামনে মেডিসিনের মত কি যেন একটা ধরলো। তখন আমার জবান বন্ধ হয়ে গেল, আমি সবকিছু দেখতে পারছি, শুনতে পারছি, কিন্তু কথা বলতে পারছিলাম না। তারপর তারা আমাকে তাদের সাথে যেতে বলে। আমিও হেঁটে হেঁটে তাদের সাথে যাই, সালমা হোটেলের সামনে দিয়ে নিয়ে গেছে। যখন আমি বলছি যে আপনারা আমাকে কেন ডাকছেন, তখন তারা আমাকে আবার ওই মেডিসিন দিয়ে বশ করে।
প্রিয়া বলেন, ঐ মেডিসিন থেকে খুব বাজে একটা গন্ধ বের হচ্ছিল। তারপর আমি আবার বোবা হয়ে যাই, তখন পুলিশ সুপারের বাসভবনের কাছ দিয়ে নিয়ে জেলা স্কুলের সামনে নিয়ে যায় আমাকে। কিছুই বুঝতে পারিনি যে আমার সাথে কি ঘটনা ঘটছে। তারপর তারা আমার মোবাইল, গলার চেইন, হাতের আংটি ও ৩ হাজার টাকা নিয়ে চলে যায়। তবে আমার জ্ঞান ছিল বাট আমার মাথায় কিছুই কাজ করছিলো না। আমিও তাদের কথা মতো সব কছু দিয়ে দেই। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না যে, কি হচ্ছে আমার সাথে এগুলো। ওদের আর কোনো টার্গেট ছিল কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওদের মূল টার্গেট ছিনতাই।
প্রিয়ার ছিনতাইয়ের ঘটনার বণর্না অনুযায়ী ধারণা করা হচ্ছে এটি স্কোপোলামাইন (Scopolamine) বা ‘ডেভিলস ব্রেথ’ নামে এক ভয়ঙ্কর মাদক। এ মাদকটি মূলত প্রতারক চক্রের সদস্যরা প্রতারণার কাজে ব্যবহার করে। এই ড্রাগ ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের মানসিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সর্বস্ব হাতিয়ে নেয় প্রতারকরা।
এটি হেলুসিনেটিক ড্রাগ। এই ড্রাগটি ৬ থেকে ১২ ইঞ্চি দূরত্ব থেকে শ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে। যার প্রতিক্রিয়া থাকে প্রায় ২০ থেকে ৬০ মিনিট। আবার এই মাদক খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ালে এর প্রতিক্রিয়া থাকে দু-তিনদিন। এ মাদক গ্রহণে ভুক্তভোগী সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এই সুযোগটি লুফে নেয় প্রতারকরা।
এর আগে গত ৬ সেপ্টেম্বর এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন ফরিদপুরে গোয়ালচামট গৌর গোপাল আঙিনা এলাকার বাসিন্দা মো. ইদ্রিস তালুকদার (৭৫) ও তার স্ত্রী আলেয়া বেগম। তারা সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ব্যাংক থেকে পেনশনের টাকা তোলেন। বাড়ি ফিরতে শহরের ইমাম স্কয়ার থেকে একটি অটোরিকশায় ওঠেন। বাহনটিতে চালক ছাড়া আরও দুজন যাত্রী ছিল।
অটোরিকশায় উঠে ইদ্রিস বসেন চালকের পাশে। আলেয়া বেগম বসেন পেছনের সিটে। কিছুক্ষণ পর পেছনের সিটের যাত্রীরা আলেয়া বেগমকে অটোরিকশায় পড়ে থাকা একটি কাগজ দেখান। জিজ্ঞেস করেন কাগজটি তার কিনা। আলেয়া চোখ কম দেখেন বলে জানালে ওই দুই যাত্রীদের একজন কাগজটি তার মুখের সামনে ধরেন। তারপরই আলেয়া ওই দুজনের কথা মতো তার গলার চেন, কানের দুল ও হাতের আংটি খুলে তাদের দিয়ে দেন।
তারা ইদ্রিসকেও বিমোহিত করে তাদের সঙ্গে থাকা প্রয়োজনীয় সবকিছু লুট করে মিয়া পাড়া সড়কের কাছে নামিয়ে দেন। এ সময় তাদের হাতে একটি ভাঁজ করা কাগজ ধরিয়ে দেন তারা। পরে দেখা যায় সেটিতে সোনালী রংয়ের প্লাস্টিক জাতীয় কিছু রয়েছে। বাড়ি ফেরার পরও বেশ খানিকক্ষণ তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলেন আলেয়া বেগম। বেশ কিছু সময় তার ছেলে তাদের সেবা করে পূর্বাবস্থায় নিয়ে আসেন। পরে বাবা-মায়ের কথা শুনে তিনি বুঝতে পারেন, প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েছিলেন তারা। তাদের কাছ থেকে সবকিছু লুট করে নেওয়া হয়েছে।
এদিকে এমন ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পেলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। মোস্তাফিজুর রহমান সোহান নামে একজন জানান, এর আগে নাহিদ বাবু ও মো. শরিফুলের কাছ থেকে টাকা নিয়ে গেছে। রাজবাড়ীতে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে বলে জানান একাধিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী।
মিথুন বিশ্বাস নামে একজন বলেন, ব্যস্তমত এই এলাকায় সিসি ক্যামেরা থাকার কথা। প্রশাসনের উচিত সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অপরাধীদের গ্রেফতার করা।
রাজবাড়ীর সদর হাসপাতালের কনসালটেন্ট (অ্যানেস্থেসিয়া) ডা. মো. জিয়াউল হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, স্কোপোলামিন নামক ড্রাগ মূলত তরল (লিকুইড) ও শুকনো (পাউডার) এই দুই ধরনের হয়। অজ্ঞান করতে এ ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এটা অধিক মাত্রায় ব্যবহার করলে মাইন্ড কন্ট্রোলে চলে যায়। তখন সবকিছু আর নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। অন্যকেউ যা নির্দেশ দিবে তাই করবেন ভুক্তভোগী।
রাজবাড়ীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এন্ড অবস) মো. রেজাউল করিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়েছি। বিষয়টি নিয়ে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ কাজ শুরু করেছে। ইতিমধ্যে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এর আগে এমন কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি। এটি স্কোপোলামাইন হতে পারে। ধারনা করা হচ্ছে ছিনতাইকারীরা স্থানীয় নয়, বাইরে থেকে এসেছে। এ বিষয়ে সবার মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। অপরিচিতদের সাথে কথা বলতে সাবধানতা বজায় রাখতে হবে।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল