আঁকাবাঁকা গ্রামীণ মেঠোপথ। দুই পাশে ফসলের সবুজ ক্ষেত আর গাছগাছালি। দূরের সবুজে ঘেরা গ্রামে গৃহস্থের বাড়ি। কিংবা বিশাল জনসমাবেশে তর্জনী উঠিয়ে ভাষণ দিচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই সমাবেশে বাংলাদেশের পতাকা হাতে শ্লোগানে মুখর ছাত্র-জনতা। এ সবই আসলে নানা ছবির বিবরণ।
আলো ছড়ানো এমন সব দৃশ্য চিত্র রং আর তুলিতে যিনি জীবন্ত করে তুলেছেন তিনি হলেন বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী তরুণ গোলাম রাব্বানী (২৬)। নিজের চেষ্টা আর পরিশ্রম থাকলে যে কোনো কাজেই সফলতা আসে, রাব্বানী তারই উদাহরণ। জন্ম থেকেই সমাজের আর দশটা ছেলে-মেয়ের চেয়ে আলাদা হলেও তিনি প্রতিবন্ধিতা জয় করে হয়ে উঠেছেন চিত্রশিল্পী। তার রং আর তুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে জীবন্ত হয়ে ওঠে জীবনের নানান টুকরো গল্প।
গোলাম রাব্বানীর বাড়ি নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার মহেষপুর গ্রামে। মহেশপুর গ্রামের ক্ষুদ্র কৃষক সাইদুর রহমান ও সেলিনা বিবির ছেলে রাব্বানী। তারা দুই ভাই ও দুই বোন। জন্ম ১৯৯৬ সালের ১ জানুয়ারি। প্রতিবন্ধী হলেও তিনি রং আর তুলি হাতে অনন্য। প্রতিভার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য বর্তমানে রাজশাহী আর্ট কলেজে পড়াশোনা করছেন তিনি। নিরলস চেষ্টায় ইতিমধ্যে প্রশংসা কুড়িয়েছে তার আঁকা ছবিগুলো। তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, সমাজের অবহেলিত মানুষের ছবি ও প্রাকৃতিক দৃশ্য এঁকে পেয়েছেন অনেক পুরষ্কার।
রাব্বানীর মা সেলিনা বিবি বলেন, জন্ম থেকেই বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। নানা জায়গায় চিকিৎসা করেও কাজ হয়নি। অন্যদের চেয়ে আলাদা হওয়ায় ছোটবেলায় অন্য শিশুরা তার সঙ্গে কেউ খেলত না। এজন্য তার অনেক মন খারাপ হতো। তার খেলার সঙ্গী ছিল খাতা আর পেনসিল। নিজের মনের খেয়ালে আঁকিবুঁকি করতো। ছবি আঁকায় বুদ হয়ে থাকতো।
বাবা সাইদুর রহমান বলেন, লেখাপড়া শেখানোর জন্য প্রথমে তাকে মহেশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু কানে শুনতে না পারা ও কথা বলতে না পারার কারণে অন্য শিশুদের সঙ্গে পড়ালেখায় তাল মেলাতে পারতো না। পরে এক চিকিৎসকের পরামর্শে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের স্কুল রাজশাহী হাইকেয়ার স্কুলে তাকে ভর্তি করানো হয়। সেখানে এক বছর পড়াশোনার পর তাকে আবারও গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। এলাকার স্কুল থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ভালো ফলাফল করে পাশ করার পর উচ্চ মাধ্যমিকে পড়তে রাজশাহী আর্ট কলেজে ভর্তি হয়। ওই কলেজে ভর্তি হয়ে প্রথম বছরেই আন্তঃকলেজ প্রতিযোগিতায় ছবি আঁকায় দ্বিতীয় পুরস্কার পায় রাব্বানী। বর্তমানে সেই কলেজেই ড্রয়িং ও পেইন্টিং বিভাগে তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিবন্ধী হলেও কারও ওপর নির্ভরশীল না হয়ে ছবি আঁকা ও লেখাপড়ার পাশাপাশি রাব্বানী জীবনমুখী অনেক কাজ শিখেছে। ইলেক্ট্রিকের কাজে সে খুবই পারদর্শী। এছাড়া মোটরসাইকেলসহ অনেক ধরনের যন্ত্রপাতি নিজেই মেরামত করতে পারে। এখন বাবা হিসেবে আমার আশা, সে যেন কারও ওপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজ যোগ্যতায় আত্মনির্ভরশীল হতে পারে। তবে রাব্বানীর পরিবারের অভাব তার এই প্রতিভা বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃষ্ঠপোষকতা ও আরও উন্নত প্রশিক্ষণ পেলে তিনি এই প্রতিভাকে আরও শাণিত করতে পারবেন।
রাব্বানীর শিক্ষক রাজশাহী আর্ট কলেজের ড্রয়িং ও পেইন্টিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার বলেন, রাব্বানী অনন্য প্রতিভার অধিকারী। প্রতিবন্ধী হলেও নিজ আগ্রহে সে তার প্রতিভাকে বিকশিত করে চলেছে। শিক্ষক হিসেবে আমরা তার প্রতিভার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য পরিচর্যা করে যাচ্ছি। ছবি আঁকায় ওর প্রচণ্ড আগ্রহ দেখে বোঝা যায় সঠিক পরিচর্যা ও সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে সে একজন ভালো চিত্রশিল্পী হবে।
জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নূর মোহাম্মদ বলেন, রাব্বানী খুব সুন্দর ছবি আঁকেন। তার প্রতিভা বিকাশে আমরা পাশে থাকতে চাই। ইতিমধ্যে তাকে প্রতিবন্ধী ভাতার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর্থিক সহযোগিতার আবেদন করলে তাকে আরও সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি।
বিডি প্রতিদিন/এমআই