সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) গতকাল খুলনা প্রেস ক্লাবে “নেতৃত্বে নারী ও তরুণ: বাধা কোথায়?” শীর্ষক একটি সংলাপ ও কর্মশালার আয়োজন করে। উক্ত অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, তরুণ রাজনীতিবিদ, নারী নেতৃত্ব ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। এ সংলাপ ও কর্মশালার উদ্দেশ্য ছিল নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণে বাধা ও সম্ভাবনা বিষয়ক আলোচনার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বে লিঙ্গভিত্তিক মানদণ্ড নিয়ে আলোচনায় যুক্ত হওয়ার জন্য তরুণদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় তথ্য বিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল; বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী খুলনা মহানগরীর সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর হুসাইন হেলাল; ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ খুলনা মহানগরীর সভাপতি মুফতি আমানুল্লাহ; সিপিবি খুলনার সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. বাবুল হাওলাদার; এবং এনসিপি খুলনা জেলার সংগঠক ডা. আব্দুল্লাহ চৌধূরী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সিজিএস’র প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান। কর্মশালাটি সিজিএস’র “গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারী ও তরুণদের সম্পৃক্ততা” শীর্ষক চলমান প্রকল্পের অংশ, যা বাংলাদেশে অবস্থিত নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের সহায়তায় পরিচালিত হচ্ছে।
আলোচনার সূত্রপাত করে সঞ্চালক জিল্লুর রহমান প্যানেলিস্টদের সামনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরেন। তিনি জানতে চান, খুলনা অঞ্চলে নারীরা ও তরুণ সংগঠকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা সত্ত্বেও কেন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়ছেন এবং তাদের অগ্রগতির পথে সমাজ, পরিবার না দলীয় সংস্কৃতি, কোনটি সবচেয়ে বড় বাধা। জিল্লুর রহমান ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণআন্দোলনের পর সৃষ্ট প্রজন্মগত অনাস্থার বিষয়টি তুলে ধরেন এবং দলগুলোতে নেতৃত্বের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি না হওয়া এবং যোগ্যতার চেয়ে আনুগত্যকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার সংস্কৃতির ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বাধ্যতামূলক প্রার্থী কোটা এবং নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ব্যবস্থার কার্যকারিতার মতো সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনার জন্য প্যানেলিস্টদের প্রতি আহ্বান জানান। সবশেষে, তিনি অনলাইন হয়রানি মোকাবিলায় করণীয় এবং বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মের নেতৃত্বের মধ্যে কী ধরনের গুণাবলী থাকা উচিত, সে সম্পর্কে জানতে চান।
আজিজুল বারী হেলাল বলেন, প্রতিটি সমাজেই বাধা থাকে, কিন্তু স্বপ্ন পূরণের জন্য সবাইকে এগিয়ে যেতে হবে। তিনি গ্রেটা থুনবার্গের মতো তরুণ আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বদের উদাহরণ দিয়ে বলেন, নেতৃত্বের কোনো লিঙ্গ হয় না। তিনি বলেন, বাংলাদেশি রাজনীতিতে নেতৃত্বের প্রথম শর্ত হলো দেশপ্রেম, এরপর আসে সাহস; দক্ষতা ও শিক্ষা তার পরের বিষয়। তিনি বলেন, "নেতৃত্বে বয়স কোনো বাধা নয়, প্রয়োজন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এবং মানুষকে প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করার দক্ষতা।" তিনি আরও যোগ করেন, যারা মানুষের হৃদয় স্পর্শ করতে পারেন, তারাই প্রকৃত নেতা এবং পরিস্থিতিই প্রয়োজনে নেতা তৈরি করে।
অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর হুসাইন হেলাল বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠীকে 'জাতীয় সম্পদ' হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, পারিবারিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক, যেকোনো বাধাই প্রবল ইচ্ছাশক্তির কাছে নগণ্য। তিনি জুলাই অভ্যুত্থানের উদাহরণ টেনে বলেন, "কোনো তরুণের মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার ইচ্ছা থাকলে তাকে থামানো যায় না।" তিনি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রাখা তরুণ-তরুণীদের প্রশংসা করেন এবং তরুণদের প্রতি সরাসরি আহ্বান জানিয়ে বলেন, "যত বাধাই আসুক না কেন, তা ভেঙে ফেলার জন্য ইচ্ছাশক্তি তৈরি করতে হবে।"
অ্যাডভোকেট মো. বাবুল হাওলাদার নারী নেতৃত্বের প্রাথমিক বাধা হিসেবে পিতৃতন্ত্রকে চিহ্নিত করেন এবং বলেন যে, এই ব্যবস্থা শুধু পুরুষরাই নয়, নারীরাও টিকিয়ে রেখেছে। উদাহরণস্বরূপ, তিনি বলেন, একজন মা তার মেয়ের রাজনীতিতে আসাকে নিরুৎসাহিত করতে পারেন, এই ভেবে যে এতে তার মেয়ের ভালো বিয়ে হবে না। তিনি বলেন, "নারী-পুরুষের জন্য সমান সুযোগের ক্ষেত্র এখনো তৈরি হয়নি।" তিনি এই সুযোগের অভাবকে তরুণদের হতাশার সাথে যুক্ত করে বলেন, রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজেদের জন্য কোনো জায়গা দেখতে না পাওয়ায় অনেক তরুণ দেশ ছাড়তে চায়। তিনি 'লোক দেখানো অংশগ্রহণ' এবং প্রকৃত অন্তর্ভুক্তির মধ্যে পার্থক্য করার ওপর জোর দিয়ে বলেন, "এখন পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দলই তাদের মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণ কাঠামোতে ৩৩% নারী অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে পারেনি।"
ডা. আবদুল্লাহ চৌধুরী ৫ই আগস্টের আগের এবং পরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, অভ্যুত্থানের পর তরুণদের মধ্যে যে নতুন দেশপ্রেমের উন্মেষ ঘটেছিল, পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির পুনরাবৃত্তিতে তা ম্লান হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, "রাজনৈতিক দলগুলো তরুণদের সেই চেতনা ও প্রেরণা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। যদি এই নোংরা ভাষার রাজনীতি ও অপরাজনীতি চলতে থাকে, তবে নারী ও তরুণরা এখানে নিজেদের স্থান খুঁজে পাবে না।"
মুফতি আমানুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি নারী হওয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের অন্তর্ভুক্তি ছাড়া দেশের উন্নয়ন অসম্ভব। তিনি উল্লেখ করেন, "আমাদের দল ইসলামে নির্ধারিত দায়িত্ব পালনের সাপেক্ষে নেতৃত্ব ও অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণকে জরুরি বলে মনে করে।" এর পাশাপাশি তিনি প্রযুক্তি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, তরুণরা স্মার্টফোনে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করার কারণে শিক্ষা ও রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
প্যানেল আলোচনার পর, উপস্থিত তরুণ ও নারী প্রতিনিধিরা দিনব্যাপী একটি কর্মশালায় অংশ নেন। এই কর্মশালায় দলীয় আলোচনার মাধ্যমে রাজনীতিতে নারী ও তরুণদের প্রতিবন্ধকতাগুলো আরও গভীরভাবে চিহ্নিত করা হয় এবং এর বাস্তবসম্মত সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন