তখন আমি সাতক্ষীরার শ্যামনগরের সুন্দরবনের কাছাকাছি এক গ্রামে বাস করতাম। সেখান থেকে শ্যামনগর প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে। যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম বাইসাইকেল। চাইলে কৃষকের গরুর গাড়িতে করে শ্যামনগরে যাওয়া যায়। কিন্তু রাস্তা খারাপ থাকায় আমি সাইকেলে যাতায়াত করতাম। তাছাড়া, সাইকেলে আমি বেশ দ্রুত যেতে পারতাম। আমাকে প্রায় প্রতিদিনই শ্যামনগরে যেতে হতো। সেখানে গিয়ে মেইল করা এবং একটি পত্রিকা কিনতাম। দোকানে বসে কয়েকবার চা পান করতাম এবং দোকানদারের সঙ্গে বসে গল্প করতাম। আমার গ্রামে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা ৬টা বেজে যেত। যে রাস্তা দিয়ে ফিরতাম তার চারপাশে ঘন বন এবং রাস্তাটি বেশ শান্ত থাকত। শীতের সময়ে যেহেতু আগেই সন্ধ্যা নামত তাই আমাকে সাইকেলের বাতি ব্যবহার করতে হতো।
এক সন্ধ্যায় গ্রামের প্রায় অর্ধেক দূরত্ব অতিক্রম করেছি। তখন রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছোট ছেলে আমাকে থামাল। ওই সময়ে বনের পাশে কোনো শিশুর থাকার কথা নয়। কারণ বনের বাঘ, শিয়াল, সাপ ও বানর বাস করত। আমি সাইকেল থেকে নেমে ছেলেটির কাছে গেলাম। যদিও সে আমাকে না দেখার ভান করল।
আমি জানতে চাইলাম-
‘তুমি এখানে কী করছ?’
‘আমি অপেক্ষা করছি।’
‘কার জন্য অপেক্ষা করছ? তোমার বাবা-মা?’
‘না, আমার বোনের জন্য অপেক্ষা করছি।’
‘ঠিক আছে, আমি তো রাস্তায় তাকে দেখিনি।’
‘সে হয়তো আরও সামনের দিকে গেছে।’
‘তাহলে তুমি আমার সঙ্গে চলো। দুজন মিলে তাকে খুঁজে বের করব।’
ছেলেটি মাথা নাড়ল এবং সাইকেলের সামনে উঠে বসল। আমি তার কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এর মধ্যে ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে এসেছে। ছেলেটি সামনের দিকে তাকিয়ে ছিল, আমি তার মুখ দেখতে পারছিলাম না। আমাকে বাতাসের বিরুদ্ধে সাইকেল চালাতে হচ্ছে। অনেক ঠান্ডা, আমি কাঁপছি। কিন্তু ছেলেটিকে একদম স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। হঠাৎ সাইকেলের বাতি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটি শিশুর ওপর পড়ল। শিশুটি ছিল একটি মেয়ে। সে ছেলেটির চেয়ে একটু বড়। মাথায় লম্বা চুল এবং চুলে মুখের বেশির ভাগ অংশ ঢাকা পড়েছিল।
আমি বললাম-
‘এই যে তোমার বোন।’
আমার কথায় মেয়েটি কোনো সাড়া দিল না।
ছেলেটি বলল-
‘চলুন ওকেও আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাই।’
সে ছেলেটির কথায় মাথা নাড়ানো ছাড়া আর কিছুই করেনি। মেয়েটি সাইকেলের ক্যারিয়ারে উঠে বসল। ওরা দুজন আমাকে সাইকেলের প্যাডেল করতে নিষেধ করল। কিন্তু সাইকেল চলছে তো চলছেই।
আমি লক্ষ করলাম ছেলেটির মাথা আমার মুখের অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে। আর মেয়েটির শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত এবং ভারী মনে হচ্ছিল। যেন সে কোনো মাঠে দৌড়াচ্ছে। ঠান্ডা বাতাস সত্ত্বেও আমি ঘামতে শুরু করি। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
আমি বললাম-
‘আমাদের একটু বিশ্রাম নেওয়া দরকার।’
ওরা দুজন একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল, ‘না, বিশ্রামের দরকার নেই!’
আমি যখন তাদের দাবি উপেক্ষা করে সাইকেল থামানোর কথা ভাবছিলাম, তখন লক্ষ করলাম হ্যান্ডেলবারের ওপর থাকা ছেলেটির হাত লম্বা, কালো এবং রোমশ হয়ে গেছে।
আমার হাত কাঁপছে এবং সাইকেলটি ঘুরে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে।
আমি বললাম, ‘তোমরা সাবধানে থেকো।’
তখন ওরা একসঙ্গে চিৎকার করে বলল, ‘আমরা ঠিক আছি। কিন্তু আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’
তাদের কণ্ঠস্বর খুব ভয়ঙ্কর ছিল এবং মোটেও শিশুদের মতো মনে হলো না। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে আরও ভয় পেলাম। মেয়েটির চেহারা বিশাল আকার ধারণ করেছে। তার হাত ও পায়ে লম্বা লম্বা পশম। তার চুল সাইকেল থেকে ঝুলে মাটিতে পড়েছে। আমি দেখলাম সামনে একটি পুকুর।
ওরা তখন আদেশ দিল, ‘থামো! পুকুরের কাছে থামো!’
কিন্তু আমি কিছু করার আগেই সাইকেলের সামনের চাকা একটি পাথরে আঘাত করে এবং সাইকেলটি উল্টে যায়। তারপর আমি মাটিতে পড়ে গেলাম। তখন শক্ত কিছু আমার মাথার পেছনে আঘাত করল। তারপর আমার সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল।
যখন আমার জ্ঞান ফিরল তখন চাঁদ উঠেছে। চারদিকে ফুটফুটে জোছনার আলো। জোছনার আলো পাশের পুকুরের পানিতে জ্বলজ্বল করছে। আমার পাশে কোনো শিশু নেই। এমনকি আমার সাইকেলটিও নেই। আমি মাটি থেকে উঠে জামা থেকে ধুলো ঝাড়তে শুরু করি। তারপর পুকুরের পানিতে শব্দ শুনতে পেলাম। আমি আবার পুকুরের দিকে তাকালাম। সেখানে দুটি মহিষ ও আমার সাইকেলটি খেলছে। আর মহিষ দুটি ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সাইকেল হাতল দুটি হাত হয়ে গেছে বাতিটি রক্তাক্ত চোখের মতো লাল হয়ে আছে।