খুব সকালে ঘুম ভেঙে যায় ধ্রুবর। জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আসছে। চৈত্রের শেষ রাত জার লাগে। বাইরে তাকালেই ধ্রুব দেখে, ঘন কালো মেঘ জমেছে আকাশে। গাছপালার চুপচাপ। চাপচাপ মেঘ-ঘন হয়ে দানা বেঁধেছে।
বৃষ্টি হবে।
বৃষ্টি ধ্রুবর খুব প্রিয়।
বিছানায় এপাশ-ওপাশ গা গড়িয়ে ঝরঝরে হয়ে নিল সে। অমনি বলল, কিচির মিচির ডাক। একেবারে কানের পাশে কে যেন শব্দ করছে। ধ্রুব ইতিউতি খুঁজল। কে ডাকে? মাথার ওপর চকচকর দিয়ে একটা চড়ুই পাখি তখন নাকের ডগায় এসে বসল।
- কেমন আছো ভাইয়া?
- ওহ, তুমি তাহলে ডাকছিলে?
- হ্যাঁ, তোমার চুলের ঝোপে বসে একটা জিরিয়ে নিচ্ছিলাম সকালবেলা।
ধ্রুব ওর ঘুংরু চুলে বিলি কাটল বাম হাতের আঙুল দিয়ে। তারপর গিয়ে বসল মেঝেতে। সামনে একটা সাদা কাগজ। চারপাশে রং-তুলি। ধ্রুবর মনে পড়ল- গত রাতে ও একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করেছে। সাদা কাগজে ছড়িয়ে আছে ছাই রং। সাদা কাগজটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল ধ্রুব। কিসের ছবি আঁকতে চেয়েছিল ও? এই মুহূর্তে মনে পড়ল না কিছুই। আকাশ, নদী, পাহাড় না মেঘ- কোন ছবি?
চড়ুই পাখিটা তখন সাদা কাগজটার ধারে এসে বসেছে। জিরিজিরি চোখের পাপড়ি মেলে ও দেখছে- কত রকমের রং ছড়িয়ে আছে মেঝেতে। ঘন লাল, হালকা লাল, লাল-হলুদ মেশানো, কালো, হালকা কালো, সাদা-কালো, ছাই-কালো। রং আর রং। অনেক রকমের রং। আর ধ্রুবর তুলিটা কি সুন্দর। চড়ুইটা ভাবল- যেন ওর পালক কেটে ঝিরঝিরে তুলিটা তৈরি করা হয়েছে।
চড়ুটাই শিরশিরে কণ্ঠে টানতে চাইল,
- তুমি কি অনেক রং চেন?
ধ্রুব অল্প কথা বলে, হাতে তুলিটা নিয়ে সাদা কাগজে খসখস করে রং ঘষতে লাগল।
- অল্প কিছু রং তো চিনিই। তা না হলে ছবি আঁকব কীভাবে?
- এখন তুমি কিসের ছবি আঁকছো?
- তাতো জানি না।
ধ্রুব উদাসভাবে বাইরের আকাশের দিকে তাকালো। ঘন কালো মেঘের ওড়াউড়ি। হঠাৎ ঝুপ করে বৃষ্টি শুরু হলো। বড় বড় ফোঁটা।
বৃষ্টি ধ্রুবর খুব প্রিয়।
চড়ুইটা জানতে চাইল,
- ভাইয়া তুমি কি বৃষ্টির ছবি আঁকতে পার?
ধ্রুব কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর কপালের সামনের চুলে টান দিয়ে বলল,
- বৃষ্টির ছবি তো। আঁকতে চাই। কিন্তু বৃষ্টির রং পাব কোথায়?
- মানে?
অবাক হয়ে চড়ুইটা।
- মানে খুব সোজা। বৃষ্টি আঁকতে হলে বৃষ্টির রং জানা চাই।
- ঐতো বৃষ্টি ঝরছে। ওখান থেকে রং নিয়ে নাও।
হা হা করে হেসে উঠল ধ্রুব।
বৃষ্টি রং যদি এত সোজা হয় তাহলেই হয়েছে! বৃষ্টির রং কেমন? ভাবতে থাকে ধ্রুব। বৃষ্টির রং কি সাদা? নাকি ঘোলাটে? নাকি ফিকে আকাশি-রং?
মনটা খারাপ হয়ে যায় ধ্রুবর।
চড়ুইটা তখন বলে,
- আমি কি তোমাকে সাহায্য করতে পারি?
- কী সাহায্য?
- বৃষ্টির রং কি আমি নিয়ে আসতে পারি?
- কোত্থেকে?
- ভারি অবাক হয় ধ্রুব।
- জানি না কোত্থেকে আনব?
বলেই চড়ুইটা ফুড়ুত করে জানলা দিয়ে উড়ে যায়।
বৃষ্টিতে ভিজে দু-একটা পাক খেয়ে জবুথবু চড়ুইটা উড়তে থাকে ওপরে। অনেক ওপরে। বৃষ্টির বাড়ি কোথায়? বৃষ্টির কোথায় থাকে? চড়ুই খুঁজতে খুঁজতে একটা বড় বৃষ্টির ফোঁটার দেখা পেল।
বৃষ্টির ফোঁটাটা ঝুপ করে চড়ুইয়ের পাখায় এসে নামল। চড়ুইটা খুব আদুরে গলায় বলল,
বৃষ্টি ফোঁটা কেমন আছ?
নাচো, নাচো জোরসে নাচো।
বৃষ্টি ফোঁটা বলতে পার-
বৃষ্টির রং কোথায় পাব?
উড়াল দিয়ে কোথায় যাব?
বৃষ্টির ফোঁটা রিমঝিম করে হাসল।
বৃষ্টির রং যদি পেতে চাও,
বৃষ্টির কাছে যদি যেতে চাও-
তবে তুমি চলে যাও নদীটার কাছে
বৃষ্টির রং দ্যাখো সেইখানে আছে।
- সত্যি বলছ তুমি?
ঝলমল করে উঠল চড়ুই পাখি। বৃষ্টির ফোঁটা তোমাকে ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ। বৃষ্টির ফোঁটাকে সঙ্গে নিয়ে উড়াল দিল চড়ুই পাখি।
উড়তে, উড়তে ...
উড়তে, উড়তে ...
চড়ুই পাখি এল সোনালি নদীর কাছে। নদীল নাম সোনালি। ভারি সুন্দর, লক্ষ্মী এক নদী। শান্তস্বরে, কুলকুল বয়ে চলেছে। বৃষ্টির পানিতে নদীর শরীর ধুয়ে যাচ্ছে।
চড়ুইটা কিচিমিচি করে উড়ে উড়ে ঘুরল নদীর বুকে।
নদী তুমি লক্ষ্মী।
একটা জিনিস জানতে চাই
তোমার শুরু মানতে চাই।
বৃষ্টির রং কোথায় পাব?
উড়াল দিয়ে কোথায় যাব?
চিলচিলে নদীটা ঝিলমিল করে হেসে উঠল। ঢেউয়ের তরঙ্গে নদীটা দুলতে লাগল। নদীর হাসি দেখে মনে হলো- সত্যি, সত্যি নদীটার নাম সোনালি। নদী তখন বলল,
বৃষ্টির রং পাবে তুমি
নীল পাহাড়ের কাছে
পাহাড় চূড়ায় বৃষ্টি নামে
রং আছে তার কাছে।
আর দেরি নয়, এক্ষুণি যাও
বৃষ্টি যদি নামে
বৃষ্টির রং নিয়ে এসো
সোনালি নদীর নামে।
চড়ুই পাখি উড়াল দিল।
উড়তে উড়তে বেচারা হাঁপিয়ে উঠল। নীল পাহাড় অনেক দূরে, অনেক উঁচুতে আছে বৃষ্টিদের ঘরবাড়ি।
চড়ুই চলল আর চলল।
বৃষ্টির রং ওকে আনতেই হবে। ধ্রুব বৃষ্টির ছবি আঁকবে। সাদা পাতা আর তুলি সাজিয়ে বেচারা বসে আছে।
রং নিয়ে ফিরতেই হবে চড়ুইকে, বৃষ্টির রং ছাড়া কিভাবে ধ্রুব বৃষ্টির ছবি আঁকবে?
ধ্রুবর হঠাৎ করে ঘুম ভাঙলো।
বাইরে মেঘ ডাকছে। অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝরঝর, ঝরঝর- একটানা বৃষ্টির শব্দ। রাতে জানালাটা খোলা ছিল।
বৃষ্টি ছিটে এসে পড়েছে ঘরে।
ধ্রুব দেখল- রাতে ও সাদা পাতায় বৃষ্টির ছবি আঁকতে চেয়েছিল। তুলি দিয়ে ছাই রঙের পোঁচও দিয়েছিল দু-একটা।
কিন্তু বৃষ্টির রং যে ওর জানা নেই।
তারপর ঘুমিয়ে গিয়েছিল।
ঘুম থেকে জেগে উঠেই দ্যাখে- বাইরে তুমুল বৃষ্টি।
আর সাদা পাতাটা বৃষ্টির জলে ভিজে গেছে। বৃষ্টির জল আর ছাই ছাই রং-সব মিলিয়ে ক্যানভাসে অপূর্ব এক বৃষ্টির ছবি।
ধ্রুব ঘুম জড়ানো চোখে অবাক হয়ে ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর ওর ঘরের ঘুলঘুলিতে একটা চড়ুই বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু। শিরশির করে কাঁপছে চড়ুইটা। আর পাখা ফরফর করে গা থেকে জল ঝরিয়ে নিচ্ছে। আর ডাকছে -
কিচির মিচির। কিচির মিচির।