আমদানি-রপ্তানিতে বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কমে গেছে বৈদেশিক মুদ্রা আয়। ফলে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় তীব্র আকার ধারণ করেছে ডলার সংকট।
মহামারী করোনার প্রকোপ কমে আসার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে জরুরি পণ্য আমদানি ব্যাহত হচ্ছে পর্যাপ্ত ডলারের সরবরাহ না থাকায়। এমন পরিস্থিতিতে দেশে নিত্যপণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক ও পর্যাপ্ত মজুদ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে খাদ্যপণ্য, সার ও জ্বালানি আমদানির এলসি খোলা নিশ্চিত করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। বেসরকারি উদ্যোগে খাদ্য আমদানিতে কোনও ব্যাংক ডলার সংকটের কারণে এলসি না খুললে বিকল্প ব্যবস্থার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরকে।
রবিবার গণভবনে দেশের সার্বিক আর্থিক পরিস্থিতি ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি পর্যালোচনা করতে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করে এসব নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
বৈঠকে বেসরকারি খাতের জন্য তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি, বৈধপথে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, বিলাসপণ্য আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধি, খাদ্য, সার ও জ্বালানিতে ভর্তুকি নিয়ে আলোচনা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান, আবু হেনা মোহাম্মদ রহমাতুল মুনিম, বাণিজ্য, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ, অর্থ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব এবং শিল্প, কৃষি, খাদ্য, বিদ্যুৎ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, পরিসংখ্যান ও তথ্য বিভাগের সচিব ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী খাদ্যশস্যের মজুদ ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে নির্দেশ দিয়েছেন। বেসরকারি উদ্যোগে খাদ্য আমদানিতে কোনো ব্যাংক ডলার সংকটের কারণে এলসি না খুললে বিকল্প ব্যবস্থাও করতে বলেছেন গভর্নরকে।’
ডলার সংকটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা ছাড়া দেশের ব্যাংকগুলো সব ধরনের এলসি খোলা বন্ধ করে দিয়েছে। এতে বেসরকারি উদ্যোগে আমদানি এক প্রকার বন্ধ হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে মানুষের নিত্যপণ্য, কৃষির জন্য সার ও জ্বালানি এবং শিল্প খাতের জন্য এলএনজি আমদানিতে প্রয়োজনীয় এলসি খোলার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আমদানি-রপ্তানিতে বড় ব্যবধানের কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬০ কোটি ডলারেরও বেশি। বিলাস পণ্যসহ বিভিন্ন খাতে আমদানি নিরুৎসাহিত করার পরও দায় মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ধারাবাহিকভাবে ডলার সরবরাহ করতে হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। সরকারি আমদানির দায় মেটাতে চলতি অর্থবছরের চার মাসেই ব্যাংকগুলোকে ৫০০ কোটি সরবরাহ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে সংকট মেটাতে ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৭৬২ কোটি ডলার সরবরাহ করেছিল সংস্থাটি।
ধারাবাহিকভাবে ডলারের জোগান দিতে গিয়ে ১৬ মাসের ব্যবধানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ হাজার ৫৭২ কোটি বা ৩৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে। চলতি সপ্তাহে আকুর বিল পরিশোধ হলে রিজার্ভ ৩৪ বিলিয়নে নেমে আসবে। গত বছর আগস্টে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সচিবদের বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, আমদানি-রপ্তানি ও আর্থিক পরিস্থিতির একটি বিস্তারিত চিত্র বৈঠকে উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। একইভাবে প্রত্যেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগের তথ্য তুলে ধরেন সংশ্লিষ্ট সচিবরা।
বৈঠক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখতে, নিত্যপণ্যের এলসি খোলা চালু রাখতে হবে। বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখার জন্য খাদ্যপণ্য, সার ও জ্বালানি আমদানিতে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া করা হবে না।
একই সঙ্গে চাল, গম, সার ও জ্বালানি আমদানিতে বরাদ্দের চেয়ে বেশি ব্যয় হওয়ার বিষয়টিও আলোচনা হয়েছে বৈঠকে। চলতি অর্থবছরে সরকার এসব খাতে ৮২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিল। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেই বরাদ্দের চেয়ে বেশি ব্যয় হওয়ার বিষয়টি কীভাবে সমন্বয় করা যায় তার উপায় খুঁজতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। বাজেট বাস্তবায়নে ঘাটতি মেটানোর জন্য কী কী করা যাবে আর কী কী করা যাবে না সেসব বিষয় নির্দিষ্ট করতে মন্ত্রণালয়গুলোকে বলেছেন সরকারপ্রধান।
বৈঠক সূত্র জানায়, ডলারের মজুদ ধরে রাখতে বিলাসপণ্য আমদানি নিরুৎসাহী করতে ট্যাক্স বাড়ানোর যে প্রস্তাব দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, সেটা বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। দামি গাড়ি ও ফল আমদানির বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। কারণ দেশে অনেক ফল উৎপাদন হয়। বিদেশি ফলে যদি আরেকটু ডিউটি আমদানি শুল্ক আরোপ করা যায়, তাহলে আমদানি কমবে। দেশি ফলের চাহিদা বাড়বে। কিছুদিন আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৩৪০টি পণ্যের ডিউটি বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল, সেটা কার্যকর করার বিষয়টি বিবেচনা করতে বলেছেন বাণিজ্য সচিব।
বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, ডলারের সংকট জানুয়ারি মাসে কেটে যাবে। তখন হয়তো ডলারের দাম ১০৫ থেকে ১০৭ টাকায় নেমে আসতে পারে। তবে ৮৬ টাকায় ডলার আর পাওয়া যাবে না। এছাড়াও বর্তমানে আমদানি খাতে ডলারের দাম ১০৫ ও রপ্তানি বিলের ক্ষেত্রে ৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিনিময়ের এ হার আরও কমিয়ে আনার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এটার যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, রপ্তানিকারকরা ভর্তুকি পান এবং স্বল্প সুদে ঋণ পান। অবশ্য আমদানি-রপ্তানিতে ডলারের বিনিময় হারের ব্যবধান ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা হবে বলে বৈঠকে আশ্বস্ত করেন গভর্নর।
এছাড়াও রেমিট্যান্স কীভাবে বাড়ানো যায় সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। করোনার কারণে বিমান যাতায়াত বন্ধ থাকার কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বেশি এসেছে। বিমান চলাচল শুরুর পর অনেকেই বিদেশে গেলে আত্মীয়স্বজনরা ডলার দিয়ে দিচ্ছেন। যদিও সেটা আমাদের দেশেই আসছে। হুন্ডির মাধ্যমে যে লেনদেনটা হচ্ছে সেটা বন্ধ করা খুব কঠিন। যে চক্রটা হুন্ডির ব্যবসা করছে, তাদের যদি ধরা যায় তাহলে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আরও বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
অর্থপাচার ঠেকাতে ওভার ইনভয়েসিং এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোরভাবে পরীক্ষা করছে। প্রত্যেকটা এলসি পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে আন্তর্জাতিক লেনদেনের সঙ্গে মিল আছে কি না। মিল থাকলে অর্থ ছাড় করা হচ্ছে বলেও প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন গভর্নর।
বৈঠকে ব্যবসায়ীদের জন্য বেশি দামে জ্বালানি বিশেষ করে এলএনজি আমদানি করবে সরকার। তবে আমদানি মূল্যে ব্যবসায়ীদের গ্যাস দেওয়া হবে নাকি কিছু ভর্তুকি দেওয়া হবে সেটা চূড়ান্ত করেই আমদানি শুরু হবে। দাম পুনর্নির্ধারণ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই বলে জানিয়েছেন জ্বালানি সচিব।
এর আগে গত ২৬ অক্টোবর শিল্প খাতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং ব্যাংকগুলোতে ঋণপত্র (এলসি) খোলা সহজ করতে প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা চান দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা। বেশি দামে হলেও প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি চান তারা। ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, দাম নয়, নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি এখন বেশি প্রয়োজন। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক বাজারের সমান দামে জ্বালানি কিনতে প্রস্তুত আছেন তারা।
বৈঠকের বিষয়ে এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিলাম, গ্যাসের চাপের অভাবে উৎপাদন কম হচ্ছে। ব্যাংকগুলোতে ঋণপত্র বা এলসি খুলতে ব্যবসায়ীদের সমস্যা হচ্ছে। ভোগ্যপণ্য আমদানি করতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের বড় বড় এলসি খুলতে হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা জটিল পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন। ব্যাংকগুলো বড় বড় এলসি করতে চায় না।’
বৈঠক সূত্র জানায়, রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ এই মুহূর্তে খুব বেশি নেই। ইউরোপ-আমেরিকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে রপ্তানি বাড়বে না। তারপরও সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে খুব বেশি বাড়বে বলে মনে করছে না সরকার।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ২ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ১৫ লাখ ৭৩ হাজার ৪৮৫ টন খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে চাল ১৩ লাখ ৫৮ হাজার ৭৫ টন, গম ২ লাখ ৫ হাজার ৬৭৪ টন, ধান ১৪ হাজার ৯৭৯ টন।
ইউরিয়া সারের মজুদ ৬ লাখ ৪১ হাজার টন, টিএসপি ৪ লাখ ১৫ হাজার টন, ডিএপি ৯ লাখ ৪ হাজার টন, এমওপি ২ লাখ ৪৬ হাজার টন। সারের বর্তমান মজুদের বিপরীতে সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত সারের চাহিদা হলো ইউরিয়া ৩ লাখ ৫০ হাজার টন, টিএসপি ৯৬ হাজার টন, ডিএপি ২ লাখ ১৯ হাজার টন, এমওপি ১ লাখ ২১ হাজার টন। গত বছর একই সময়ের তুলনায়ও সারের বর্তমান মজুদ বেশি। গত বছর এ সময়ে ইউরিয়া সারের মজুদ ছিল ৫ লাখ ৯৯ হাজার টন, টিএসপি ২ লাখ ১৩ হাজার টন, ডিএপি ৬ লাখ ৭৩ হাজার টন এবং এমওপি ১ লাখ ৮১ হাজার টন। সৌজন্যে: দেশ রূপান্তর
বিডি প্রতিদিন/কালাম