দেশের বিভিন্ন স্থানে বসেছে পশুর হাট। পছন্দের পশুটি আল্লাহর রাহে কোরবানির জন্য আমাদের কত দৌড়ঝাঁপ, কষ্ট-ক্লেশ করতে হয়। আমাদের এত কষ্টের কোরবানি আল্লাহতায়ালা কি কবুল করবেন? তিনি কি বলবেন, ‘কদ সদ্দাকতার রুইয়া’। ‘বান্দা আমার! মকবুল কোরবানির যে স্বপ্নে তুমি বিভোর, আমাকে রাজি-খুশি করানোর জন্য তোমার যত চেষ্টা-প্রচেষ্টা, আজ তা সত্য হয়েছে।’ নাকি তিনি ফিরিয়ে দেবেন আমাদের কষ্টের কোরবানিটুকু। যেমন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন আদমপুত্র কাবিলের কোরবানি। যা ছিল দাম্ভিকতা ও আভিজাত্যের বড়াইয়ের দোষে দুষ্ট। আসুন চোখ বুলিয়ে নিই কোরআনে বর্ণিত দুই ভাইয়ের ঐতিহাসিক কোরবানির ঘটনা।
আল্লাহ বলেন, ‘ওয়াতলু নাবাআবনায় আদামা বিল হাক্কি’। ‘আদমের দুই পুত্রের কোরবানির ঘটনাটি আপনার (মুহাম্মদ) পেয়ারা উম্মতকে শুনিয়ে দিন।’ ‘ইজ কুররবা কুরবানান ফাতুকুব্বিলা মিন আহাদিহিমা ওয়ালাম ইউতাকাব্বাল মিনাল আখর’। ‘তারা যখন কোরবানি করেছে, আল্লাহ একজনের কোরবানি কবুল করলেন আরেকজনের কোরবানি কবুল করলেন না।’ প্রসিদ্ধ তাফসিরগ্রন্থ এবং হাদিসের কিতাবে ঘটনাটি এভাবে এসেছে : আদম (আ.)-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিল। (সে সময় মা হাওয়ার গর্ভ থেকে দুটি করে সন্তান জন্ম হতো। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে)। শরিয়তমতে, কাবিলের সঙ্গের বোন আকলিমাকে বিয়ে করবেন হাবিল আর হাবিলের সঙ্গের বোনকে বিয়ে করবেন কাবিল। আকলিমা ছিলেন অসম্ভব রূপবতী। কাবিল চাইতেন পরমাসুন্দরী আকলিমাই যেন তার জীবনসঙ্গী হন। বাবার কাছে গিয়ে কাবিল বললেন, ‘আব্বাজান! আমি আকলিমাকেই বিয়ে করব।’
আদম (আ.) বিষণ্ন মনে বললেন, ‘বাবা কাবিল! সে তো তোমার ভাই হাবিলের জন্য নির্ধারিত।’ পাশেই ছিলেন হাবিল। এবার দুই পুত্রকে উদ্দেশ করে দরদি পিতা বললেন, ‘তোমরা বরং আল্লাহর উদ্দেশে কোরবানি কর। যার কোরবানি কবুল হবে সে-ই না হয় আকলিমাকে বিয়ে করবে।’
সেকালে নিয়ম ছিল, কোরবানির বস্তু একটি খোলা প্রান্তরে রেখে আসতে হবে। আকাশ থেকে আগুন এসে যদি তা জ্বালিয়ে দেয় বুঝতে হবে কোরবানি কবুল হয়েছে। আর যদি কোরবানির সামগ্রী অক্ষত থাকে, তার মানে এ কোরবানি আল্লাহর কাছে গৃহীত হয়নি।
পেশায় হাবিল ছিলেন রাখাল। তিনি তার দুম্বার পাল থেকে সবচেয়ে সুঠাম দুম্বাটি রেখে এলেন কোরবানির জন্য। পাশেই কাবিল কিছু শস্য রেখে গেলেন। পেশায় কৃষক হওয়ায় এই ছিল তার সম্বল। পরদিন সকালে দেখা গেল হাবিলের কোরবানি কবুল হয়েছে। কাবিলের শস্য অক্ষত অবস্থায় রয়ে গেছে। এই দেখে দারুণ রেগে যান কাবিল। তিনি তার ভাইকে বলেন, ‘লাআকতুলান্নাকা’। ‘আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব হাবিল।’
হাবিল শান্ত চোখে ভাইয়ের দিকে তাকালেন। স্বভাবসুলভ মিষ্টি হেসে কাবিলকে বললেন, ‘ইন্নামা ইয়াতাকাব্বালুল্লাহু মিনাল মুত্তাকিন’। ‘ভাই কাবিল! তুমি কেন শুধু শুধু আমার ওপর রাগ করছ। আমরা দুজনই তো কোরবানি পেশ করেছি। আল্লাহ আমারটা কবুল করেছেন— এটাই কি আমার অপরাধ? ভাই! মন দিয়ে শোনো! আল্লাহ কেবল মুত্তাকিদের কোরবানিই কবুল করেন। তুমিও আল্লাহ-মাফিক জীবন গঠন কর। তোমার কোরবানিও দয়াময় আল্লাহ কবুল করবেন।’
‘আল্লাহ কেবল মুত্তাকিদের কোরবানিই কবুল করেন’— হাবিলের বলা এ কথার মধ্যেই আমাদের জন্য রয়েছে বড় শিক্ষা। আমরা যদি তাকওয়াবান— আল্লাহভীরু হতে না পারি, তবে যত সুন্দর, যত দামি পশুই কোরবানি করি না কেন, আল্লাহর কাছে তা কবুল হবে না। দুঃখজনক হলেও সত্য, আজকে মুসলমানের মধ্যে তাকওয়ার কোরবানির বড় অভাব। কে কত বড় পশু কোরবানি করবে, কার পশুর দাম কত বেশি, কে কয়টা কাগজের শিরোনাম হবে, কে কতটি চ্যানেলে দামি ক্রেতা হয়ে মুখ দেখাবে— এসব হয়ে পড়েছে কোরবানির উদ্দেশ্য। প্রচারের ভিড়ে, লৌকিকতার আড়ালে তাকওয়ার কোরবানি আজ মুখ লুকিয়ে কাঁদছে।
কথা ছিল, কোরবানির মাধ্যমে বান্দা ত্যাগের শিক্ষা নেবে, নিরন্ন-দুস্থ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চর্চা করবে। ধনী-গরিব বৈষম্যের শিকল ভাঙার প্রেরণা পাবে। বনের পশুর গলায় ছুরি চালিয়ে নিজের মনে লুকিয়ে থাকা পশুত্বের কোরবানি করবে। ভিতরে-বাইরে হয়ে উঠবে একজন প্রকৃত মানুষ। সৎ মানুষ, সাদা মনের মানুষ। হায়! পশুত্ব কোরবানির নামে মুসলমান হয়ে উঠছে আরও বড় পশু। আরও সুঠাম, আরও নির্মম মানুষ। তাই তো মুসলমান আজ শুধু ঘৃণিত জাতিই নয়, মৃতপ্রায় জাতিতেও পরিণত হয়েছে বিশ্ববাসীর কাছে। হে মুসলমান! সময় এসেছে জেগে ওঠার। নিজেকে প্রমাণ করার। আমরা ভীরু নই, কাপুরুষ নই। আমরা বীরের জাতি। ইতিহাস সাক্ষী! আমরা পশুকে করেছি মানুষ। তাই আসুন, কোরবানির পশুর গলায় ছুরি চালানোর আগে নিজের ভিতরের পশুটির গলায় ছুরি দিই। হয়ে উঠি প্রকৃত মুসলমান। সাদা মনের সৎ মানুষ। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন। আমিন।
লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।
www.selimazadi.com