রবিবার, ৬ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

তরুণদের আগ্রহ বায়োফকে

শাইখ সিরাজ

তরুণদের আগ্রহ বায়োফকে

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বেশ কিছু রেস্তোরাঁ আছে, যারা খাবার তৈরির সবজি থেকে শুরু করে ফল-ফসল নিজেরাই উৎপাদন করে। বেল, বুক অ্যান্ড ক্যান্ডেল নামের এক রেস্তোরাঁ তাদের প্রয়োজনীয় সবজির শতকরা ৬০ ভাগই উৎপাদন করে হোটেলের ছাদে। শুধু নিউইয়র্কেই নয়, বিশে^র বিভিন্ন দেশে এমন রেস্তোরাঁ বহু রয়েছে। মানুষজনও একেবারে সতেজ ফল-ফসলের স্বাদ নিতে ভিড় জমাচ্ছে সেসব রেস্তোরাঁয়। কখনো বা নিজের হাতেই ফসল তুলে সেগুলো রাঁধতে দিচ্ছে গ্রাহক। সে এক অন্যরকম তৃপ্তি! চীনে অনেক রেস্টুরেন্টে চৌবাচ্চায় জ্যান্ত মাছ ছেড়ে দেওয়া থাকে, গ্রাহক সেখান থেকে বেছে পছন্দ করে একটা মাছ কিনে শেফের হাতে তুলে দেয়, সেই মাছ থেকে বিভিন্ন আইটেমের খাবার তৈরি হয়। মনে পড়ছে গত বছর চীনের জংশানের এক রেস্তোরাঁয় ‘ডাকহেড’ নামের এক মজার মাছ খেয়েছিলাম। মাছটির মুখটি হাঁসের ঠোঁটের মতো। তাই নাম ডাকহেড। রেস্তোরাঁর সামনে বিশাল এক চৌবাচ্চায় জ্যান্ত মাছ রাখা। ছোট্ট জাল দিয়ে ইচ্ছামতো মাছ ধরে শেফের হাতে তুলে দিয়ে মিনিট দশেক বসলেই একই মাছের বিভিন্ন পদের খাবার তৈরি করে আপনার সামনে দেবে শেফ। সেখানকার লোকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছিলাম এসব মাছ তারা উৎপাদন করে আরএএস (রিসার্কুলেটিং অ্যাকুয়া সিস্টেম) পদ্ধতির চাষে। ঘরের ভিতর মাছের কারখানা যাকে বলে। বাংলাদেশেও এমন রেস্তোরাঁ দেখেছি কক্সবাজারে। রেডিয়ান্ট ফিশ ওয়ার্ল্ডে চৌবাচ্চায় জিইয়ে রাখা হয় মাছ। সেখান থেকে কোনো একটা পছন্দ করে বাবুর্চির হাতে তুলে দিলেই আপনি পেতে পারেন তাজা মাছ ভাজার স্বাদ। রেডিয়ান্ট ফিশ ওয়ার্ল্ডের স্বত্বাধিকারী সিদ্দিক মিয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় সেই আশির দশকে। সেই সময়টায় মাছ চাষের একটা জোয়ার তৈরি হয় সারা দেশে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘হাকিম আলীর মাছের খামার’ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে শিক্ষিত বেকার তরুণরা মাছ চাষ শুরু করেন। সিদ্দিক মিয়াও তাদেরই একজন, মাছ চাষেই পাল্টে গেছে তার দিন। বলা চলে সিদ্দিক মিয়াদের হাত ধরেই দেশে ঘটে গেছে রুপালি বিপ্লব। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশে^ চতুর্থ। তবে দেশে নতুন রুপালি বিপ্লবের আভাস পাচ্ছি। আরএএস প্রযুক্তির পাশাপাশি বায়োফক পদ্ধতির প্রতি তরুণরা ঝুঁকছে। প্রতিদিন শত শত ইমেইল, অফিসে ফোনের পর ফোন বায়োফক সম্পর্কে আগ্রহী মানুষের। কেউ কেউ ফোন করে বলেন, ‘স্যার! আমি বায়োফক শুরু করেছি, আপনি একটু দেখে যান।’ শুনেছি ইন্দোনেশিয়ায় ঘরে ঘরে বায়োফক। বলা যায় মাছের কুটিরশিল্প। আমাদের দেশেও এমনটা হবে। ছোট্ট পরিসরে একটা ট্যাংকে চাষ করা যায় হাজার হাজার মাছ। হয়তো প্রতিটি রেস্টুরেন্টে থাকবে বায়োফকের চৌবাচ্চা। সেখান থেকেই তাজা মাছ তুলে সরাসরি চলে যাবে রান্নার হাঁড়ি হয়ে গ্রাহকের প্লেটে।

যাই হোক, বলছিলাম বায়োফকের প্রতি তরুণদের আগ্রহ বাড়ছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের আগ্রহ বেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের রুবাইয়াৎ হাসান শরীফ নামে এক তরুণের বায়োফক খামার দেখতে রওনা হলাম এক সকালে। গিয়ে দেখি এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। পার্ক কিংবা পিকনিক স্পটে কার্যকর আধুনিক কৃষি অনুশীলনের নজির গড়ে তুলেছেন উদ্যোক্তা রুবাইয়াৎ হাসান শরীফ। ঠিক কৃষি পর্যটন নয়, তবে বাগানবাড়ির বিস্তীর্ণ জায়গা ফেলে না রেখে বাণিজ্যিকভাবে কাজে লাগাতে চাচ্ছেন তিনি। কথা হলো রুবাইয়াতের সঙ্গে। জানালেন, বছরখানেক আগেও কৃষির ধারেকাছে ছিলেন না তিনি। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চাকরিই জীবনযাপনের তৃপ্তির যথেষ্ট জোগান দিচ্ছিল। এখন চাকরির পাশাপাশি উৎপাদনমুখী এই সৃজনশীল কাজে হয়ে উঠেছেন দারুণ মনোযোগী। এর পেছনের কারণটি কী? রুবাইয়াৎ জানালেন, টেলিভিশনে দেখা লাভজনক মাছ চাষের আধুনিক উদ্যোগগুলোই সবচেয়ে বেশি উদ্বুদ্ধ করেছে। কৃষি উদ্যোগের ক্ষেত্রে এখন সবচেয়ে আকর্ষণীয় এক উদ্যোগ হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তির মাছ চাষ। এ ক্ষেত্রে বায়োফক পদ্ধতিটির প্রতিই নতুন উদ্যোক্তারা অনেক বেশি আগ্রহী। বিশেষ করে যারা অর্থ ব্যবস্থাপনায় দক্ষ তাদের হিসাব বলছে, এ পদ্ধতি দ্রুতই দেখাতে পারে লাভের মুখ। সম্প্রতি আপনারা হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে দেখেছেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের দুই তরুণের বাড়ির উঠানে বায়োফক প্রকল্প। কয়েক মাসেই বিনিয়োগের অর্থ তুলে আনার ব্যাপারে আশাবাদী তারা। ঠিক একই আত্মবিশ^াস রুবাইয়াৎ হাসান শরীফেরও। রড নির্মিত স্ট্রাকচারে পলি-প্লাস্টিকের ঘের দিয়ে তৈরি চারটি ট্যাংকে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে বায়োফক পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করেন তিনি। পরীক্ষা করে দেখলেন ব্যাপারটা লাভজনক। তবে প্লাস্টিকের ট্যাংকের চেয়ে সিমেন্টের তৈরি স্ট্রাকচার বেশি কার্যকর। কারণ হিসেবে তিনি জানালেন, এলাকায় ইঁদুরের উৎপাত আছে, ইঁদুর পলি-প্লাস্টিক কেটে দিলে মুহূর্তে লাখ টাকা লোকসান। আর একটা সমস্যার কথাও তিনি জানালেন, প্লাস্টিকের ভাঁজে আটকে থাকা অ্যামোনিয়া মাছের ক্ষতি করে। সবদিক থেকে সিমেন্টের চৌবাচ্চাই তার নিরাপদ বলে মনে হয়েছে। রুবাইয়াৎ এখন ছয়টি ট্যাংকে মাছ চাষ করছেন। প্রতিটি ট্যাংক নির্মাণে তার খরচ হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। ছয়টি ট্যাংক, অ্যারেটর, জেনারেটর, পাম্প, রেণু পোনা সব মিলে বিনিয়োগ ৬ লাখ টাকার মতো। প্রতিটি ট্যাংকে পানি আছে সাড়ে ৭ হাজার লিটার। প্রতি ১ হাজার লিটার পানিতে ১০০ কেজি মাছ উৎপাদনের লক্ষ্য তার। সবকিছু ঠিক থাকলেই দুটি হার্ভেস্টে তিনি তুলে আনতে পারবেন তার সমস্ত বিনিয়োগ। বরাবরই দেখেছি, ফসল কৃষির বাইরে কৃষির উপখাত যেমন হাঁস-মুরগি পালন, গরু-ছাগলের খামার বা মাছ চাষের মতো উদ্যোগ এমন একটি রাজ্য, যার সদর দরজা দিয়ে ঢুকলে শুধু এগিয়ে যেতেই ইচ্ছা করে।  ফসল কৃষির মাঝে উচ্চমূল্যের ফল-ফসল চাষ করছে যারা তারাও বেশ লাভ পাচ্ছেন। কিন্তু যে কৃষক শুধু ধান চাষের ওপর নির্ভরশীল দিন শেষে তার লাভ আর থাকে না। তাই অনেক কৃষক ধান চাষ থেকে সরে এসে নতুন কৃষির সন্ধান করছেন। প্রযুক্তির আধুনিক কৃষিতে পাচ্ছেন সম্ভাবনার ডাক। তারা নতুন কৃষির স্বপ্ন দেখছেন। রুবাইয়াৎ এই কয়েক মাসেই কৃষি নিয়ে দেখতে শুরু করেছেন নানা স্বপ্ন। আগামী বছরেই এখানে বসাবেন ৩০টি ট্যাংক।

রুবাইয়াৎ তার উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল চিন্তাও কাজে লাগিয়েছেন। খাবারের হিসাব পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি বিভিন্ন মাছের প্রজাতিরও পরীক্ষা চালিয়েছেন। ক্যাট ফিশ জাতীয় মাছের পাশাপাশি রুই, কাতলাও চাষ করছেন। বায়োফক পদ্ধতির মাছ চাষে খুব বেশি প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এ পদ্ধতির চাষে পোনার মৃত্যুহারও কম। এ বিষয়গুলোও পর্যবেক্ষণে রয়েছে রুবাইয়াতের। তিনি জানালেন, পোনামৃত্যুর হার শতকরা ১০ ভাগেরও কম। বায়োফক পদ্ধতির সুবিধা মাছের খাবার কম লাগে, ফকই মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রুবাইয়াৎ জানালেন, শতকরা ৮০ ভাগ খাবারই ফক থেকে আসে, বাকি ২০ ভাগ তিনি ট্যাংকে ছিটিয়ে দেন। এ ক্ষেত্রে খাবারটাও দিতে হয় বিশেষভাবে। লক্ষ্য রাখতে হয় খাবারে ৩০ থেকে ৪০ ভাগ যেন প্রোটিন থাকে। না হলে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। বায়োফকে পানি খুব একটা পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে গেলে পানি পরিবর্তন করে দেন। সেজন্য ট্যাংকগুলোর সঙ্গে পাইপ দিয়ে একটা সংযোগ রেখেছেন পুকুরে। এতে তার ফকের খাবারটা অপচয় হয় না।

সচেতন খামারি, উদ্যোক্তাসহ অনেকেই বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন বলে বিশ^াস করি। এই বায়োফক বা রাস পদ্ধতিটি আসার পেছনে বড় কারণটি কী? কারণটি হচ্ছে, একই স্থানে মাছ চাষের কারণে মাছের বর্জ্য পানিতে মিশে অত্যধিক অ্যামোনিয়া তৈরি হয়। যা থেকে একসময় মাছের উৎপাদন যেমন ব্যাহত হয়, অনেক সময় খামারই উজাড় হয়ে যায়। ঠিক এ জায়গা থেকেই বিশেষজ্ঞরা ভেবেছেন, পানিকে নিয়মিত সঞ্চালন ও দূষণমুক্ত করা গেলে তা মাছ চাষের জন্য হতে পারে অনেক বেশি কার্যকর। প্রাথমিক এই জায়গাটির ওপর ভিত্তি করেই একে একে এসেছে রাস কিংবা বায়োফকের মতো পদ্ধতি। এই বায়োফক পদ্ধতির মূল জায়গাটিই হচ্ছে মাছের বর্জ্য থেকে প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্যের উৎপাদন। রুবাইয়াৎ হাসান শরীফের মতো অনেক শিক্ষিত সচেতন উদ্যোক্তাই এখন আসছেন প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক খামার গড়তে। প্রাথমিক উদ্যোগ নিয়েই ব্যাপক উৎসাহের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছেন তারা। শিক্ষিত এসব নতুন উদ্যোক্তার হাত ধরে কৃষি এখন দারুণ এক সম্ভাবনার পথে এগিয়ে চলেছে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে শিক্ষিত সচেতন মানুষের মধ্যে কৃষির প্রতি এই অনুরাগটিই আমাদের আগামীর একটি সমৃদ্ধ সম্ভাবনার কথা জানান দেয়। বিশ্বাস করি, তরুণ উদ্যোক্তারা তাদের স্বপ্ন ও উদ্যোগের পথে সফল হবে। তারা ব্যবহারিক জ্ঞানের মধ্য দিয়ে আরও নতুন সম্ভাবনা বয়ে আনবে আমাদের কৃষি খাতের জন্য।

 

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর