বিশাল কাদেরিয়া বাহিনীর সফল প্রশাসক আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিম একই রকম সফল বেসামরিক প্রশাসক আনোয়ারুল আলম শহীদ। আনোয়ারুল আলম শহীদ বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা একজন। তার বাবা ইছাপুরের করিম মুন্সী টাঙ্গাইল শান্তি কমিটির সদস্য আর তিনি ছিলেন কাদেরিয়া বাহিনীর। বঙ্গবন্ধুর হত্যার সময় রক্ষীবাহিনী থেকে সবার আগে মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য জানিয়েছিলেন। তারপর নানা জায়গায় চাকরি করে অবসর নিয়ে এখন আওয়ামী লীগ। তিনি একটি বই লিখেছেন যেখানে আমার নাম খুবই কম আছে। বলতে গেলে তিনিই কাদেরিয়া বাহিনী গঠন করেছিলেন। একেবারেই বুঝতে পারিনি, তার যদি অত ভূমিকাই থাকত তাহলে শহীদ বাহিনী না হয়ে কাদেরিয়া বাহিনী হবে কেন? তিনি শত্রুর সামনে একটিও গুলি করেননি। জনাব এনায়েত করিম খুব বেশি লেখাপড়া জানেন কিনা জানি না। তার ছোট ভাই দু-তিনজন এমএ পাস। কিন্তু তিনি নন। অনেকটা আমার মতো। ১৩ তারিখ সন্ধ্যায় সোনার বাংলায় এসে ‘আমার মুক্তিযুদ্ধ-এনায়েত করিম’ দুই খানা বই দিয়েছেন। একটা আমার জন্য একটা আমার স্ত্রী নাসরীনের জন্য। আমি আমার জীবনে কোনো বই এভাবে একবারে শেষ করেছি বা করতে পেরেছি বলে মনে হয় না। ১৪১ পৃষ্ঠার বই ছবিসহ ১৬৮ পৃষ্ঠা। অসাধারণ। বইটি পড়ে মনে হলো কমবেশি সবারই লেখা উচিত। অসীম সাহসী যোদ্ধা বীরবিক্রম আবদুস সবুর খান। যুদ্ধ এবং নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনীতে তার কোনো তুলনা হয় না। তিনিও একটি বই লিখেছেন ‘যুদ্ধে যুদ্ধে নয় মাস-আবদুস সবুর খান বীরবিক্রম’। বইটা নিষ্ঠার সঙ্গে পড়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও সহজে পড়তে পারিনি। সবুর খানের ভাষায় লেখা হলেও আমার পড়তে অসুবিধা হতো না। কিন্তু টাঙ্গাইলের কোনো এক বই ব্যবসায়ী ব্যবসায়িক স্বার্থে বইটি ছেপেছেন এবং তার ছেলে বিপ্লব যতটা সম্ভব সাহায্য করেছে এবং তার কথা ঢুকিয়ে দিয়েছে। তাতে বইয়ের মান তেমন বৃদ্ধি পায়নি। মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইল সবটুকু নিজে মাঠে থেকে প্রত্যক্ষ করেছি। সবুরের ‘যুদ্ধে যুদ্ধে নয় মাস’ বইটিতে সে তার ভূমিকার হাজার ভাগের এক ভাগও তুলে ধরতে পারেনি। আর তার ভূমিকা তুলে ধরতে না পারা সবুরের ক্ষতির চেয়ে কাদেরিয়া বাহিনীর ক্ষতি, মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতি। কারণ সবুর বীরবিক্রম, জাহাজমারা হাবিব বীরবিক্রম, আবুল কালাম আজাদ বীরবিক্রম। যদিও আবুল কালাম বীরবিক্রমকে যুদ্ধের জন্য নয়, মুক্তিযুদ্ধের অনন্য ঐতিহাসিক কারণে খেতাব দেওয়া হয়েছে। এনায়েত করিমের বই পড়তে পড়তে দেখলাম আবুল কালাম আজাদ বীরবিক্রমও নাকি ‘স্মৃতিপটে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ নামে বই লিখেছে। আমাকে দেয়নি তাই পড়তে পারিনি। তবে এনায়েত করিমের বই পড়ে সত্যিই অভিভূত হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ জড়িত সব যোদ্ধা যদি এভাবে নিজে যা দেখেছে যা করেছে তা লিখত এমনকি অনেক বেশি করেও লিখত তাও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এমন বিকৃত হতো না, যতটা অবাধে এখন বিকৃত হচ্ছে। আমি আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিমকে ‘আমার মুক্তিযুদ্ধ’ লেখার জন্য অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাই। একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হীরেন স্যার এবং সোহরাব আলী খান আরজুকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিয়ে এনায়েত করিমের হাতে দেওয়া এবং এনায়েত করিমের আমার কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার ঘটনাটি বাদ পড়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের গোড়ার দিকের কথা বলতে গিয়ে ’৫৭-এর কাগমারী সম্মেলন তুলে ধরা সত্যিই খুব ভালো হয়েছে। কিন্তু কী করে যে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের কথা একেবারে বাদ পড়ে গেছে। অন্যদিকে প্রকৃত নেতা লতিফ সিদ্দিকী এবং শাজাহান সিরাজের প্রসঙ্গটা তেমনভাবে আসেনি। কিন্তু সবদিক বিবেচনায় বইটি অসাধারণ। স্বাধীনতার পরপরই রংপুরের প্রবীণ বিপ্লবী সুনীল কুমার গুহ প্রায় দুই বছর এনায়েত করিমের বাড়িতে থেকে ‘বাঘা সিদ্দিকী’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। যার ভাষা অন্যরকম। তবু সেখানে মুক্তিযুদ্ধের স্বাদ ছিল। অন্যটি লিখেছিলেন ব্রিটিশ ভারতের প্রবীণ মুসলিম সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বের। তখন লেখার গুরুত্ব বুঝতাম না। তাই তেমন আগ্রহ ছিল না। এনায়েত করিমের লেখাটি পড়ে আমার মনে হয়েছে হাজার কথার যেমন এক কাজ তেমনি প্রকৃত লেখা হাজার কাজ থেকে শ্রেয়। আমি সবাইকে বইটি পড়তে অনুরোধ জানাব। যারা পড়বেন তাদের অবশ্যই ভালো লাগবে এবং ভালো হবে।
আজ কদিন থেকেই মনটা বেশ উতালা। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষাজ্ঞানের এমন অভাব যা আগে কখনো চিন্তাও করিনি। অথচ ৭ অথবা ৮ তারিখ ভারতের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে চট করে বললেন, ‘আমাদের ভারত-বাংলাদেশের এত চমৎকার সম্পর্ক কিছু মানুষ তেক্ত করতে চাচ্ছে। মনে রাখবেন আমাদের সম্পর্ক কেউ তেক্ত করতে পারবে না।’ আমি স্তম্ভিত হয়েছিলাম পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে এ মোমেনের ভাই প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ‘রাবিশ রাবিশ’ বলে মাঝেমধ্যেই দেশবাসীকে বিরক্ত করতেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তেমনটাই করেছেন। সম্পর্ক ‘তেক্ত’ করা আর তিক্ত করা এক নয়। স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের বখাটেরা ত্যক্ত-বিরক্ত করে, তিক্ত করে না। রাষ্ট্রের সম্পর্ক ‘তেক্ত’ হয় না, তিক্ত হয়। যাক, এখন সব চলে। গত পরশু পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেভাবে ভারত থেকে লোক ফেরানো নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন তা অনেকের জানা। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে কতটা মুনশিয়ানা আর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাঁচা কথা ভাবলেই ভিরমি খেতে হয়। এভাবে কত দিন চলবে? একটা রাষ্ট্রের কূটনৈতিক কৌশল দৃঢ় এবং উন্নত না হলে বিশ্বদরবারে সেই দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি খুবই দুষ্কর। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ১১ হাজারের মতো ভুলেভরা রাজাকার-আলবদর-শান্তি কমিটির নামের তালিকা প্রকাশ করেছে। দেখা যাক, আরও কত কী প্রকাশ করে। প্রখ্যাত লেখক গাফ্ফার চৌধুরী দেশে এসেছেন জানা ছিল না। তিনি বলেছেন, রাজাকারের তালিকা প্রকাশের আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে যেসব রাজাকার আছে তাদের তালিকা তৈরি করা দরকার। কথাটা ইচ্ছা হলেই ছুড়ে ফেলা যাবে না। গাফ্ফার চৌধুরীর মহান বিজয় দিবসের আগের দিনের কথায় যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। তাই ইচ্ছা করে ফেলে দিলে চলবে না। এই এক দিনেই শুনছি, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছায়ায় মায়ায় জড়িয়ে পড়া অনেক রাজাকারের ছেলেমেয়ে যারা আওয়ামী লীগে জড়িত তাদের নাম বাদ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। বাদ দেওয়ার পরও টাঙ্গাইলেই তিন-চার নেতার বাবারা যে প্রত্যক্ষ স্বাধীনতাবিরোধী শান্তি কমিটি রাজাকার আলবদর আলশামসের সদস্য ছিলেন তা তালিকায় এসেছে। এবারের পর্বে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু লিখতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু আমার স্ত্রী বললেন, ‘তুমি মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই দু-চার কথা লিখ।’ এনায়েত করিমের বইতেই পড়লাম ১৫ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর সকালের নাশতা খাওয়ানো। সেখান থেকেই শুরু করি। ভারতীয় মিত্রবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল নাগরা সেদিন টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসে ছিলেন, আমি ছিলাম ওয়াপদা ডাকবাংলোয়। হঠাৎ নাগরার টেলিফোন পাই, ‘ডিয়ার টাইগার, তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। অসুবিধা হলে না করবে।’ বললাম, বলুন না, কী বলতে চান। সুবিধা-অসুবিধা তো পরের কথা। জেনারেল নাগরা কিছুটা আমতা আমতা করে বললেন, ‘কাল সকালের নাশতা যদি তুমি দিতে পারো তাহলে আমাদের জন্য সুবিধা হয়।’
একটা বাহিনীর জন্য এটা কত বড় সৌভাগ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতায় যারা হানাদারদের পদানত করেছে, ঢাকা দখল করেছে সেই মিত্রবাহিনীর ১৬ ডিসেম্বর সকালের নাশতা জুগিয়েছে কাদেরিয়া বাহিনী। আজ বৈরী পরিবেশে অনেক কিছু ঢাকা পড়ে থাকলেও ভাবীকাল প্রতিটি জিনিস পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার করবে। নিয়াজি যখন আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে তখন মিত্রবাহিনীর পেটে ছিল কাদেরিয়া বাহিনীর নাশতা। সে এক বিশাল কা-। প্রায় ৪০০ মানুষ। রাত ১০টা থেকে সকাল পর্যন্ত ২৪ হাজার রুটি, ৩০ হাজার পরোটা, ডাল, মাংস, হালুয়া ও প্রায় ৩০ হাজার লিটার চা তৈরি করা হয়। টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসের সামনে থেকে সকাল ৬টায় জেনারেল নাগরার সঙ্গে যখন মৌচাকে হেলিকপ্টার থেকে নামি সে সময় কিছু নাশতা সঙ্গে নিয়ে আসা হয়েছিল। নাশতা নামিয়ে আমাদের মিরপুর রোডের হেমায়েতপুরে নামিয়ে দিয়ে তিন-চারবারে কখনো হেমায়েতপুর, কখনো মৌচাকে নাশতা নামিয়ে দেয়। ঢাকা দখলের সর্বশেষ যুদ্ধ হয়েছিল পশ্চিমে জাহাঙ্গীরনগর, পুবে কড্ডা সেতুতে। ১৫ ডিসেম্বর সারা রাত সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশে প্রবল যুদ্ধ হয়েছিল। প্রায় ২০০ হানাদার নিহত, ২০০-এর ওপর আহত হওয়ার পর পাকিস্তান হানাদাররা আত্মসমর্পণ করেছিল। এ যুদ্ধে ১৫-১৬ জন মিত্রবাহিনীর সদস্য শহীদ হন; যার ১২ জন ভারতীয়, বাকিরা কাদেরিয়া বাহিনীর। আমরা হেমায়েতপুরে নেমে ছোট্ট একটা সেতুর পাশে দাঁড়িয়ে নিয়াজিকে আত্মসমর্পণের পত্র দিয়েছিলাম। আমরা যেখান থেকে আত্মসমর্পণের পত্র পাঠিয়েছিলাম মূল রাস্তার সে সেতুটি যদিও এখনো অক্ষত আছে কিন্তু আমরা হেলিকপ্টার থেকে যেখানে নেমেছিলাম সে জায়গা এখন আর ফাঁকা নেই, ঘরদুয়ারে ভরে গেছে। আমরা যখন আমিনবাজারে হানাদার বাহিনীর প্রথম আত্মসমর্পণ গ্রহণ করেছিলাম এখন সে জায়গা আর চিনবার মতো নেই। সেদিন সেখানে ছিল কৃষ্ণচূড়া, এখন ডানে পেট্রল পাম্প, বাঁয়ে স্কুল। দুই দিন পর এর কোনো চিহ্ন থাকবে না। মিরপুরে যে প্রশস্ত ব্রিজ তার দক্ষিণে এখনো ছোট্ট সরু একটি ব্রিজ রয়েছে যেটা স্বাধীনতা সেতু হতে পারত। একদিকে আমার প্রতি হিংসা অন্যদিকে ভারতীয় যে তিন মহান সেনাপতি প্রথম ঢাকা প্রবেশ করেছিলেন এবং নিয়াজির ঘরে আত্মসমর্পণ পর্বের সূচনা করেছিলেন সেই জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার সানসিং বাবাজি, ব্রিগেডিয়ার ক্লের একজনকেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তেমন সম্মানের আসন দেয়নি। কারণ অনেক প-িত জেনারেল মনে করতেন ঢাকা দখল অসম্ভব। তারা চারদিক থেকে ঢাকা ঘিরে রাখতে চেয়েছিলেন। যদি সম্ভব হয় আগরতলা থেকে আসা মিত্রবাহিনীর কলাম ঢাকা দখল নেবে। উত্তর দিক থেকে ধেয়ে আসা ভাঙাচোরা কলাম কী করে ঢাকা দখল করে নেয়? ভারতীয় যুদ্ধবিশারদদের সব পরিকল্পনা তছনছ হয়ে যাওয়া উত্তর দিক থেকে আসা জেনারেল নাগরা, সানসিং, ক্লের একটা প্রতিহিংসার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জেনারেল জ্যাকবের বই পড়লে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যায়। আমরা নিয়াজির ঘরে বাঘের খাঁচায় যখন আত্মসমর্পণের কথা বলছিলাম তখন জেনারেল জ্যাকব ছিলেন যশোরে। আমরা সব কথাবার্তা ঠিক করে ফেরার দু-তিন ঘণ্টা পর তিনি একা এক হেলিকপ্টারে ঢাকায় আসেন। তিনি তার বইয়ের এক জায়গায় লিখেছেন আত্মসমর্পণের দলিল রচনা তিনি করেছেন। একটা মেজর জেনারেল আর কত বড় হতে পারেন এইচকিউ থেকে তৈরি করা কোনো খসড়া বা চুক্তির দাঁড়ি-কমা কাটার ক্ষমতা একজন মেজর জেনারেলের থাকে না আর মূল চুক্তি তো দূরের কথা। অথচ জ্যাকব নাকি মূল চুক্তিই তৈরি করেছেন। তিনি লিখেছেন, জেনারেল নাগরা নিয়াজির সঙ্গে অশালীন কথাবার্তা বলেছিলেন। তিনি এও লিখেছেন, তখনকার ইন্টারকম হোটেল থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার জন্য মেজর জেনারেল নাগরার কাছে গাড়ি চেয়েছিলেন। সে গাড়ির ব্যবস্থা নাকি তিনি করেননি। দুজন মেজর জেনারেলের ক্ষমতা! একজন যোদ্ধাদের সঙ্গে পায়ে হেঁটে, গাড়িতে, হেলিকপ্টারে নানাভাবে ঢাকায় এসেছিলেন আরেকজন যশোর থেকে নিরাপদে ঢাকায় এসেছেন। তাই জেলাস তো থাকবেই। ভারতীয় যোদ্ধাদের মধ্যে সর্বোচ্চ খেতাব পাওয়ার কথা তাকে নানাভাবে ষড়যন্ত্র করে যোগ্য সম্মান তো দেওয়া হয়ইনি বরং নানাভাবে বদনাম করা হয়েছে। মিরপুর স্বাধীনতা সেতুকে রক্ষা করা হয়নি। ১৪ ডিভিশন হেডকোয়ার্টারে যেখানে নিয়াজি আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে স্যালুট দিয়ে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে ছিল ঘৃণাভরে নিয়াজির হাত প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। বলেছিলাম, নারীর ইজ্জত হরণকারী, ৩০ লাখ মানুষের ঘাতক নিয়াজির সঙ্গে হাত মেলাতে পারব না। সে অধিকার আমাকে কেউ দেয়নি। আমি ঘাতকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আল্লাহর কাছে দায়ী হতে পারব না। পাকিস্তান হানাদাররা মুক্তিযুদ্ধে আমাদের কাছে পরাজিত নতজানু হয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল। এসবের যেখানে যে স্মৃতি থাকা উচিত ছিল কেন যেন কোথাও সেসব স্মৃতি রইল না। জানি, সেদিন গাফ্ফার চৌধুরী যা বলেছেন ওই কথাই আমি বললে নেত্রীর আশপাশে অনেক লোক জ্বলে উঠত। কিন্তু কথাটি সত্য। যদি তাড়াতাড়ি নেত্রী এর প্রতিকার করেন ফল তিনিই পাবেন, দেশও পাবে। জানি না, আওয়ামী লীগ নেত্রী এবারের টাঙ্গাইলের হানাদারমুক্ত দিবসের কোনো খবর রাখেন কিনা। জেলার মানুষ খুবই বিরক্ত। মুক্তিযুদ্ধ আওয়ামী লীগ বিএনপি জাতীয় পার্টির নয়। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের এবং বাঙালি জাতির। সেটাকে সেভাবে থাকতে দিলেই ভালো হতো। যাদের জন্ম হয়নি তারাই মুক্তিযোদ্ধাদের রাস্তাঘাটে ফেলে রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে প্যারেড করিয়ে সালামি নেয় আর ইদানীং মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু সম্মানী দেওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই সরকারি গোলাম হয়ে গেছে। মাসিক ১০-১২ হাজার টাকার আশায় তারা তাদের সম্মানের দিকে তাকান না। আর এও সত্য, পেটের জ্বালা তাদের সম্মানের দিকে তাকাতে দেয় না। অনেক কিছুর স্থায়িত্ব আছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো স্থায়িত্ব নেই। কাউকে পছন্দ না হলে যে কেউ বললেই কাদের সিদ্দিকী ভুয়া। সব শেষ। যুদ্ধ করা, বঙ্গবন্ধুর হাতে অস্ত্র দেওয়া এসবের কোনো মানে হবে না। তাই হতদরিদ্র মুক্তিযোদ্ধারা মুখ ফুটে কিছু বলতেও সাহস পায় না। কবে চলে যাব জানি না এসবের প্রতিকার দেখে যেতে পারলে ভালো লাগত। একটা নিরাপদ বাংলাদেশ প্রত্যাশা ছিল। কেন কোন পাপে যে তা পেলাম না বুঝতে পারছি না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শুধু আপনাকে দায়ী করছি না, যেহেতু আপনার করার আছে আমাদের করার নেই তাই আপনাকে বলছি, মিরপুরের লোহার ব্রিজটি স্বাধীনতা সেতু হিসেবে থাকলে কী হবে। ১৬ ডিসেম্বর জেনারেলদের সঙ্গে একমাত্র বাঙালি আমি ছিলাম। সেটা স্বীকার করলে যদি বাঙালির ক্ষতি হয় নাইবা করলেন। কিন্তু ফোরটিন ডিভিশন হেডকোয়ার্টারে প্রমাণস্বরূপ একটা স্মৃতিসৌধ থাকলে বলা যেত বাঘ নামধারী ইঁদুরের সেনাপতি এখানে নতজানু হয়ে পরাজয় স্বীকার করেছিল। আমি জানি, আমার মনে হয় আমি না হয়ে সামরিক বাহিনীর কোনো অফিসার যদি ঢাকা দখলের মিত্রবাহিনীর সেনাপতিদের সঙ্গে থাকতেন তাহলে ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তান হানাদারদের আত্মসমর্পণের স্মৃতিস্তম্ভ থাকত। মিরপুর সেতু হতো স্বাধীনতা সেতু। হেয়ায়েতপুরে সেতুর পাশে দাঁড়িয়ে হানাদার নিয়াজিকে আমরা যে আত্মসমর্পণের পত্র দিয়েছিলাম সে জায়গায় বিজয় চত্বর হিসেবে চিহ্নিত হতো। বাংলাদেশের একমাত্র টাঙ্গাইলের পুংলী-চিনামুড়া-ভুক্তা-বরুলিয়ায় ছত্রীবাহিনী অবতরণ করেছিল তার বিশাল স্মৃতিস্তম্ভ থাকত। দু-একবার ভারতীয় সৈন্যরা তখনকার ক্যাপ্টেন এখন যারা জেনারেল তারা দু-একবার এসেছেন সরকার না চাওয়ায় আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। একসময় আমার বাহিনীর হাত ধরে ঢাকা দখলের গৌরব অর্জন করেছিল সেই বাহিনীর সদস্যরা ইদানীং ভয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ পর্যন্ত করে না। আল্লাহর কি অপার লীলা, উত্তরাঞ্চল কমান্ডের জিওসি ছিলেন মেজর জেনারেল গিল। বকশীগঞ্জের কাছে ৩ বা ৪ ডিসেম্বর মাইনের আঘাতে তার জিপ টুকরো টুকরো হয়ে যায়। জেনারেল গিলের দুই পা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার বদলে আসেন জেনারেল নাগরা। সব অফিসার এবং সৈন্য ছিল তার কাছে নতুন। এই এলোমেলো নতুন দুই ব্রিগেড সৈন্য নিয়ে তিনি গারো পাহাড় থেকে নেমে এসেছিলেন। তার কোনো আশা-ভরসাই ছিল না শত্রুকবলিত ঢাকা দেখবেন। কিন্তু তিনি ঢাকা মুক্তির ঘণ্টা বাজিয়ে ছিলেন। ভারতীয় যুদ্ধবিশারদরা ডিসেম্বরে প্রচুর বরফ পড়লে চীন সীমান্ত থেকে একটি মাউন্টেন ডিভিশন তুলে আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেবার তেমন বরফ না পড়ায় তিব্বত সীমান্ত থেকে মাউন্টেন ডিভিশন তুলে আনা সম্ভব হয়নি। রাজপুত ও বিহার রেজিমেন্টের কয়েকটি কোম্পানি জোড়াতালি দিয়ে একটি অপূর্ণ ব্রিগেড তৈরি করে সানসিংকে দেওয়া হয়। অন্যদিকে ব্রিগেডিয়ার ক্লেরের একটি পূর্ণাঙ্গ ব্রিগেড ও মাঝপথে এক ব্যাটালিয়ন প্যারাট্রুপার্স আকাশ থেকে নেমে উত্তরের কলামের শক্তি বৃদ্ধি করে। তুরার পাদদেশ থেকে নেমে ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছতে ভারতীয় বাহিনীর তিন-চারটি বড় অস্ত্র প্যারাট্রুপার্সে নামার সময়ই নষ্ট হয়েছিল। আর ঘাটাইলের মোগলপাড়া ও সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচ- লড়াইয়ে ২০-২২ জন ভারতীয় সৈন্য শহীদ হন। তা ছাড়া ভারতীয় বাহিনীর গায়ে ফুলের আঁচড়ও লাগেনি। ঘাটাইলের মোগলপাড়ায় আমাদের গুলিতে মিত্রবাহিনীর সাত-আট জন সদস্য শহীদ হন এবং মিত্রবাহিনীর গুলিতে আমাদের চার-পাঁচ জন শহীদ হন। অন্যদিকে নিয়াজির কাছে আমরা যে দূত পাঠিয়েছিলাম তাদের জন্য গাড়িতে সাদা পতাকা ছিল না। সাদা জামা ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। হানাদাররা আত্মসমর্পণ করবে হানাদারদের পক্ষে জেনারেল জামশেদ তখনই আসছে এই খুশির খবরে দ্রুত ছুটে আসায় কখন তাদের সাদা জামা উড়ে গিয়েছিল দূতেরা বুঝতে পারেনি। মিরপুরের আমিনবাজারে তাই আমাদের চার দূতের তিনজন শহীদ হন। এসব ঐতিহাসিক ঘটনাকে টিকিয়ে রাখতে সভ্য জাতি হিসেবে আমাদের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। আমরা তা নিতে পারিনি। যা ভাবীকাল আমাদের মারাত্মক দুর্বলতা হিসেবে বিবেচনা করবে।
লেখক : রাজনীতিক।
www.ksjleague.com