বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

ধর্ষণের শিকাররা মুখ লুকোয় কেন?

তসলিমা নাসরিন

ধর্ষণের শিকাররা মুখ লুকোয় কেন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ছাত্রীটির নাম কি? নাম কেন বলা হচ্ছে না? তার চেহারাও কেন দেখানো হচ্ছে না? আমরা কিন্তু ধর্ষকের চেহারা দেখে ফেলেছি, তার নাম যে মজনু তাও জেনে ফেলেছি। ধর্ষণের শিকারকে কেন মুখ লুকোতে হবে? ধর্ষকরা তো দিব্যি নাম ধাম সাকিন জানিয়ে দেয়, ক্যামেরার দিকে তাকাতে তাদের তো লজ্জাবোধ হয় না! তাহলে কি ঘটনা এই যে সমাজের ভয় একজন ধর্ষিতার আছে, কিন্তু একজন ধর্ষকের নেই? কেন নেই? এককালে না হোক, আজকাল তো ধর্ষকদের পুরুষেরাও মেনে নেয় না। তারা ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে নিজেরা যে ধর্ষক নয়, তা প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়, বলতে থাকে সব পুরুষ ধর্ষক নয়, ধর্ষকের জন্য কঠিন কঠিন শাস্তির প্রস্তাব দিতে থাকে, ফাঁসি, পুরুষাঙ্গ কর্তন, কত কী। তাহলে কেন আজও এই একবিংশ শতাব্দীতেও মেয়েরা নিজের পরিচয় লুকোতে বাধ্য হয়?

আমরা জানি কেন লুকোয় পরিচয়। কারণ যতই মানুষ ধর্ষণের বিরুদ্ধে বলুক, যতই ধর্ষককে গালি দিক, মানুষ আজও মেয়েকেই দোষী বলে মনে করে। মেয়েটি কী পোশাক পরেছিল? কোনও ছোট পোশাক? মেয়েটি যদি কোনও ছোট পোশাক না পরে থাকে, তবেও দোষ, কেন হিজাব পরেনি, যদি হিজাব পরে থাকে, তবে দোষ কেন বোরখা পরেনি। মেয়েটি বান্ধবীর বাড়িতে যাচ্ছিল, কেন একা যাচ্ছিল, একা গেলে তো এরকম হবেই। কেন কোনও পুরুষ আত্মীয় ছিল না সঙ্গে? কেন সন্ধেয় যাচ্ছিল, দিনের বেলায় তো যেতে পারতো! দোষের শেষ নেই। ধর্ষণকে পুরুষের অধিকার বলে যারা বিশ্বাস করে, তারা পদে পদে মেয়েদের দোষ খুঁজে বেড়াবে বলার জন্য অন্য মেয়েরা তো ধর্ষণের শিকার হয় না, ও হলো কেন, নিশ্চয়ই ও খারাপ। নিশ্চয়ই ধর্ষিতা হতেই সে চেয়েছে! ধর্ষণের কারণ যে পুরুষের নারীবিদ্বেষ, নারীকে যৌনবস্তু ভাবার মানসিকতা, নারীকে নির্যাতন করাই যায়, নারী তো নিতান্তই তুচ্ছাতিতুচ্ছ বস্তু- এই বিশ্বাস, তা অনেকে জানে না। অথবা জানলেও না জানার ভান করে। ধর্ষণের শিকার হলে হাজারো মেয়ে সাধারণত মুখ বুজে থাকে। তারা রাষ্ট্র করে না খবর। এই মেয়েটি জানিয়েছে সব্বাইকে। নিঃসন্দেহে সাহসী মেয়ে। কিন্তু সে ততটুকু সাহসী নয়, যতটুকু সাহসী হলে পাছে লোকে কী বলবে তার তোয়াক্কা    করে না। দিল্লির বাসে যে মেয়েটিকে গণধর্ষণ করা হয়েছিল, মৃত্যুর সঙ্গে যখন সে লড়ছিল, সারা পৃথিবীর সমর্থন সহানুভূতি পেয়েছিল সে, তারপরও নিজের নাম যে জ্যোতি সিং, তা বলেনি। তার নাম দেওয়া হয়েছিল নির্ভয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীটির নামও কি তবে ওই জাতীয় কিছু একটা দেওয়া হবে? আর কতদিন এই ভীতু মেয়েদের আমরা নির্ভয়া বা সাহসিনী বলে ডাকবো?

ধর্ষণের শিকার যারা, তারা যেন আর মুখ না লুকোয়। যদি এমন হয় যে ধর্ষণের শিকার হলে তাকে হেনস্তা করা হচ্ছে, তাহলে যারা হেনস্তা করছে, তাদের চিহ্নিত করা হোক। তাদেরও শাস্তির ব্যবস্থা হোক। শুধু ধর্ষণ যে করে, সে-ই দোষী? ধর্ষকের পক্ষ নিয়ে যারা তার শিকারকে ঘৃণা করে, একঘরে করে, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, নির্যাতন করেÑ তারাও তো ধর্ষকের মতোই। ধর্ষক করে শারীরিক নির্যাতন, সমাজের ভদ্রলোকেরা করে মানসিক নির্যাতন। এখনও শারীরিক নির্যাতনকে নির্যাতন হিসেবে ধরা হয়, মানসিক নির্যাতনকে নয়। ধর্ষণের পর একটি মেয়েকে পরিবার এবং সমাজ মানসিক নির্যাতন করে, এ কারণেই মেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়, আত্মহত্যা করে। শারীরিক নির্যাতনের চেয়ে মানসিক নির্যাতন হাজার গুণ ভয়ংকর। ধর্ষণ পুরুষতন্ত্রের উপসর্গ ছাড়া আর কিছু নয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এই ঘোষণা দেয় যে নারী দুর্বল, পুরুষ সবল। পুরুষের জগত বাইরে, নারীর জগত ঘরে। পুরুষ অর্থকড়ি উপার্জন করে, নারী ঘর সংসার করে, শিশু পালন করে। নারীকে তার পিত্রালয় থেকে উঠিয়ে স্বামীগৃহে স্থান দেওয়া হয়। শৈশব কৈশোরে মেয়েরা পিতার অধীন, যৌবনে স্বামীর অধীন। নারীকে স্বামীর সেবা যতœ করতে হবে, সন্তান, বিশেষ করে পুত্র সন্তান জন্ম দিতে হবে। নারী এবং পুরুষকে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকায় বেঁধেছে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। এই ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকাই প্রমাণ করে নারী নিতান্তই পুরুষের দাসী, যৌনদাসী। যৌনদাসীকে তাই খুব সহজেই রাস্তাঘাটের লোকেরা তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করতে পারে। কোনও ধর্ষক ভাবে না সে অন্যায় করছে। ঘরে ঘরে নারী নির্যাতন চলছে, যে নির্যাতনকে বৈধ বলে মনে করে দেশের প্রায় সবাই। ঘরে ঘরে ধর্ষণ চলছে। স্ত্রীকে ধর্ষণ করছে স্বামী। আজও স্বামীর ধর্ষণকে ধর্ষণ বলে মানা হয় না। আজও গণিকালয়ে গিয়ে পুরুষেরা যে ধর্ষণ করে, সেই ধর্ষণ এবং যৌন নির্যাতনকেও বৈধ বলে মানা হয়।

ঘরে এবং বাইরে এক শ্রেণির পুরুষ যা করে অভ্যস্ত, তা ধর্ষণ। তবে কেন একটি মেয়েকে সুযোগ পেলে অন্ধকারে নিয়ে ধর্ষণ করবে না? পুরুষকে তার পেশি, তার জোর, তার ক্ষমতা, তার সাহস নিয়ে, মোদ্দা কথা তার পৌরুষ নিয়ে গর্ব করতে শেখানো হয়েছে। ধর্ষণ সেই গর্ব থেকেই করে পুরুষ।

মজনু নামক ধর্ষকটির কাছে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব মেয়েই সমান। নারী, তার কাছে, যৌনাঙ্গ ছাড়া কিছু নয়। প্রচুর পুরুষ, ধর্ষক অথবা ধর্ষক নয়, নারীকে আস্ত একটি যৌনাঙ্গ বলেই বিচার করে। মজনু এমন কোনও অস্বাভাবিক কোনও পুরুষ নয়। সে সমাজের আর দশটা পুরুষের মতোই পুরুষ। তারও হয়তো বউ বাচ্চা আছে অথবা বাবা-মা, ভাই-বোন আছে। সে এই দেশেরই সন্তান। সে আসমান থেকে পড়েনি।

মজনুরা আর কতকাল ধর্ষণ করবে মেয়েদের? পুরুষদের কি এখনও সময় হয়নি ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার? পুরুষেরা যেন পুরুষদের সেই ভাবে শিক্ষা দেয়, যে ভাবে শিক্ষা দিলে পুরুষেরা ধর্ষণ করবে না বা ধর্ষণ করলেও ধর্ষণ করা বন্ধ করবে। নারীরা চিৎকার করলে পুরুষেরা কান দেয় না। নারীরা জানে না কী করলে বা কী বললে পুরুষেরা ধর্ষণ বন্ধ করবে। পুরুষেরাই জানে পুরুষের মন। সুতরাং পুরুষের শিক্ষক, উপদেষ্টা পুরুষকেই হতে হবে। পুরুষকেই দল বেঁধে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ মানব সমাজে বাস করতে হলে, নারীর সঙ্গে এক সমাজে বাস করতে হলে, পুরুষকে নারী নির্যাতন বন্ধ করতেই হবে। এ ছাড়া উপায় নেই।

                লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর