মঙ্গলবার, ২৪ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনা মোকাবিলায় জাতীয় সংলাপ আহ্বান করুন

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

করোনা মোকাবিলায় জাতীয় সংলাপ আহ্বান করুন

দিন পেরিয়ে রাত। তার পরই বাঙালি জাতির জীবনে নির্মম অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। আমরা এক সাগর রক্ত ঢেলে সেই অন্ধকারে আলো জ্বেলেছিলাম, স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলাম ১৬ ডিসেম্বর, ’৭১। পাকিস্তানের কবর রচনা করেছিলাম ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে বিশ্ব করোনাভাইরাসের মহাপ্রাদুর্ভাবে ক্ষত-বিক্ষত, এলোমেলো। তবে প্রতি শতাব্দীর ২০ সালে এমন দুর্যোগের একটা নজির পাওয়া যায়। লোকজনের ক্ষয়ক্ষতি কী হবে কেমন হবে জানি না, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে আমাদের মস্তবড় এক কঠিন ধাক্কা সামলাতে হবে। তবে আশার কথা, চীনের যে উহান শহরে প্রথম করোনা ধরা পড়েছিল তারা সেখানে করোনার ওপর লাগাম টানতে পেরেছে। বাকিরা কেমন কী করবে তা তাদের তৎপরতা ও নিষ্ঠার ওপর নির্ভর করে। আমাদের দেশে তেমন সুখবর নেই। দু-একটা যা শুনছি বড়ই হৃদয়বিদারক। করোনা সন্দেহে ডাক্তার রোগীর কাছে যায় না, সেবা দেয় না- এ তো দেখছি বাঙালির চরিত্রই বদলে যাচ্ছে। আমরা তো সেই জাতি, অসুস্থকে সেবা না করে অনাদরে মরতে দিই না। বরং অতিসেবায় দম বন্ধ করে মারি। রাস্তাঘাটে কেউ দুর্ঘটনায় পড়লে চারদিক থেকে এমনভাবে ঘিরে ধরি যাতে অনেকে অক্সিজেনের অভাবে দম বন্ধ হয়ে মরে। এমন নজির ভূরি ভূরি। কিন্তু করোনার কথা শুনে ডাক্তার রোগী দেখে না, পালিয়ে যায়! আমাদের এমন কালচার ছিল না। সেদিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বললেন, ‘করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ২, আক্রান্ত ২৪।’ সঙ্গে কিন্তু এটা বলেননি, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু কত? আসলে কারও কথাবার্তাই বাস্তবসম্মত নয়, কেউ দক্ষও নন। কথাবার্তায় দরদ তো নেই বললেই চলে। মমতা আর দরদের জন্য যোগ্য মানুষের দরকার। যোগ্যতা-দক্ষতা মস্তবড় জিনিস। এর আগেও বলেছি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী কে, তার ব্যাকগ্রাউন্ড কী কিছুই জানি না। কর্নেল মালেকের ছেলে। কর্নেল মালেক জগদ্বিখ্যাত কেউ ছিলেন না, বাংলাদেশে বিখ্যাতও নন। পাকিস্তান-ফেরত সামরিক বাহিনীর লোক, মুক্তিযুদ্ধেও কোনো অবদান ছিল না। এ কদিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সম্পর্কে যার সঙ্গেই কথা হয়েছে একজনও ভালো বলেননি। পর্দার দাম যার আমলে ৩৭ লাখ, তার ৩৭ মিনিটও মন্ত্রিসভায় থাকার কথা না। পিতা নেই তাই আছেন। বোনও ব্যাপারটা দেখলে ভদ্রলোক যে হাওয়া হয়ে যাবেন- এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু যেভাবে করোনা মোকাবিলা হচ্ছে তা মোটেই ভালো লাগছে না। করোনা হয়েছে কিনা তা দেখার বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার এখন পর্যন্ত কোনো প্রকৃত যন্ত্রপাতি আমাদের নেই, সবই অনুমান। করোনা হয়ে কতজন মারা গেছে এটাও নিশ্চিত করে বলার মতো নয়। তবে কথাবার্তায় আমরা বড় নির্দয়। প্রধানমন্ত্রীর কথায় যে দরদ যে মাধুর্য যে মায়া-মমতা তার বিন্দুবিসর্গও মন্ত্রী ও অন্য কর্মকর্তাদের কণ্ঠে নেই। আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা প্রথম প্রথম চুল ছেড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে রানী এলিজাবেথের মতো সকালে এক রকম বিকালে আরেক রকম বয়ান দিচ্ছিলেন। কদিন তাকে দেখিনি। তিনি আবার এসেছেন। শান্তভাবে বলছেন। খুব ভালো লাগল। যে-ই আসুন কথা বলুন একটু দরদ দিয়ে বলুন। ছেলেবেলা থেকে শুনে এসেছি কথাই নেতৃত্ব করে কথাই কর্তৃত্ব করে। সেই কথাই যদি হৃদয়গ্রাহী না হয়ে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায় তাহলে কী বলব? পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেদিন কীভাবেই না বললেন, ‘আমাদের লোকজন দেশে এসে সব নবাবজাদা হয়ে যায়।’ এ কেমন কথা, কেমন ঔদ্ধত্য! কোনো সাবেক সরকারি কর্মচারী রাজনীতি না করে মন্ত্রিসভায় স্থান পেলে এমনই হয়। রাজনীতিতে মানুষের চাইতে বড় কেউ আছে? কেউ নেই। কিন্তু চট করে তিনি বলে বসলেন, প্রবাসীরা দেশে ফিরে সবাই নবাবজাদা হয়ে যায়। কই, এ কথা তো বললেন না, তাদের পাঠানো টাকায় অনেক হারামজাদা ফুটানি করে এবং টাকা লুটপাট করে বিদেশে পালায়। নেত্রী শেখ হাসিনার ঘাড়ে সওয়ার হয়ে এমন লাগামহীন কথা কারও মুখে সাজে না। কানাডার প্রধানমন্ত্রী বয়সে তরুণ, পিতার মতো অভিভাবকের মতো বিদেশে যারা আছে সেই কানাডিয়ানদের বলেছেন, ‘তোমরা ভয় পেয়ো না, নিজেদের অসহায় ভেব না। তোমার পাশে তোমার দেশ আছে, আমি আছি। যার বিমানের টিকিট নেই, থাকা-খাওয়ার পয়সা নেই তাকে আমরা টিকিট পাঠাব, থাকা-খাওয়ার টাকা পাঠাব। তোমরা যখন পার চলে এসো। দেশে খাবার না থাকলে খাবার দেব, টাকা না থাকলে টাকা দেব। আমরা সব সময় তোমাদের পাশে আছি।’ এটা তো বঙ্গবন্ধু, মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের মতো কথা। তাদের বিদেহী আত্মা কানাডার এই অভিভাবক যুব প্রধানমন্ত্রীর দেহে ভর করেনি তো? ১৯৬৮-’৭০-এর দিকে হুজুর মওলানা ভাসানী যখন গরু-ঘোড়া-ছাগল-ভেড়ার জন্য চারণভূমির দাবিতে আন্দোলন করতেন তখন তেমন বুঝতাম না। হাঁস-মুরগির খাবারের জন্য আন্দোলন করতে দেখতাম। কিন্তু এখন বুঝি কত বড় মানুষ ছিলেন। ’৭৪-এ রংপুরে দারুণ মঙ্গায় জাল পেঁচানো বাসন্তীর ছবি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তখন একটা সাধারণ শাড়ির দাম ছিল ৫-৬ টাকা, সেখানে জালের দাম ১২-১৩ টাকা। ছেঁড়া কাপড়ের ওপর জাল পেঁচিয়ে ছবি তুলে সারা পৃথিবীময় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ কাজটা কিন্তু সেদিন কোনো শত্রু করেনি। তথ্য মন্ত্রণালয়ই অতি উৎসাহী হয়ে কাজটি করেছিল। বেশি বেশি বিদেশি সাহায্য পাওয়ার আশায়। সে সময় বঙ্গবন্ধু এক বেলা খাবার ছেড়েছিলেন। পিতাকে কি যন্ত্রণাকাতর দেখেছি। কতবার খাওয়ার জন্য জোর করেছি। খাওয়াতে পারিনি। শুধু বলতেন, ‘না খেতে পেয়ে কত মানুষ মারা যাচ্ছে। কিছুই করতে পারছি না। আমি কী করে খাই।’ আমি জাস্টিন ট্রুডোর কথায় বঙ্গবন্ধুকে খুঁজে পাই। এখন আমার বোনকে ডোবানোর জন্য কেউ কেউ ক্ষতিকর অনেক কিছু করছে। সত্যিই কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রীর সম্মান রক্ষা করেছেন? যে মানুষ কত ঝড়-ঝাপটা উপেক্ষা করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেন। ছি! ছি! তাঁরই মন্ত্রী প্রবাসীদের নবাবজাদা বলেন। আমাদের দেশে নবাবজাদা কোনো প্রশংসা নয়, এটা একটা মারাত্মক গালি। প্রবাসীদের টাকায় ফুটানি করে তাদের গালি দিতে এ রকম শিক্ষিত লোকদের একটুও বাঁধল না? এটা বলতে পারি, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তিনি ক্ষমতায় থাকলে জাতিকে এমন গালি দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একমুহূর্তও ক্ষমতায় বা পদে থাকতে পারতেন না। পিতাকে চিনতাম, ’৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে অস্ত্র নিতে এসে বলেছিলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা তোমরা আমার কাছে খবর পাঠাবা। সুদখোর, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ কোনো কর্মকর্তাকে রাখব না। তোমাদের কথা আমি বিশ্বাস করব। সেইমতো দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর কর্মকর্তাকে বলব Your services are no longer required. জানি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রীরা এসব বেফাঁস কথা বলে বেশিদিন থাকবেন না। মানুষের এত গভীর ঘৃণা নিয়ে কেউই বেশিদিন থাকতে পারে না, সেটা মতিয়া চৌধুরীই হোক আর রাশেদ খান মেননই হোক কিংবা শাজাহান খান। সবই সময়ের ব্যাপার। কষ্ট হয়, যে সময় নেত্রীর পাশে দায়িত্বশীল বুদ্ধিমান দরদি লোকের থাকার কথা সে সময় চাটুকার অপদার্থরা চারপাশ ভরে আছে। তাদের কনুইয়ের গুঁতায় ভালো মানুষ কাছাকাছি হতে পারছে না। ভালো মানুষ ভালো পরামর্শ দিতে পারছে না। জি হুজুর যে কত খারাপ কত ক্ষতিকর, পৃথিবীর ইতিহাসে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে।

জাতীয় এই মহাদুর্যোগে এখন আর সরকার ও বিরোধী দল নয়। এখন আমরা সব এক ও অভিন্ন। আমাদের ভিন্ন কোনো পরিচয় নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা যেমন দেশমাতৃকার জন্য এক প্রাণ এক মন হয়েছিলাম, এখন আমাদের সে রকম এক হওয়ার সময় এসেছে। কাউকে গালাগাল, দোষারোপের সময় এটা নয়। সরকারের উচিত সবাইকে নিয়ে কাজ করা। কে বড় কে ছোট এটা ভাবার এখন সময় নয়। এখন সময় সবাই মিলে জাতীয় এই মহাদুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার পথ খোঁজা। সেদিনও এক বিএনপি নেতার টক শোয় শুনলাম, সরকার বললেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়বেন। আমি বিশ্বাস করি, তার মাপের নেতারা নিশ্চয়ই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে করোনার এ আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করতে দুর্বার বেগে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। কিন্তু তার দল এবং বড় বড় নেতারা অত সহজে অমনটা করবেন বলে মনে হয় না। তবে সরকারের উচিত সবাইকে নিয়ে একটি জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করা এবং সেখানে জাতীয় দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণের একটা পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা। সরকারি দলের অনেক কর্মকান্ড অনেকের পছন্দ নাও হতে পারে। তার পরও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সহযোগিতা করা ছাড়া এখন কারও সামনে কোনো বিকল্প নেই। তিনি সবার সহযোগিতা নিতে না পারলে ক্ষতি তার হবে। কিন্তু সরকারকে বিব্রত করতে অথবা শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ছোট করতে এ সময় কারও কিছু করা উচিত হবে না। বাংলাদেশের বাইরে বিএনপি-আওয়ামী লীগ বা অন্য দল আমি কোনো দিন পছন্দ করিনি। দেশের ভিতরে আমাদের যত দলই থাকুক, দেশের বাইরে আমরা বাঙালি, আমরা বাংলাদেশি। সেখানে আমাদের দলাদলি-হলাহলি উচিত নয়, ভালো নয়। ঠিক তেমনি এই মারাত্মক দুর্যোগ-দুর্বিপাকে কোনো দলাদলি-হলাহলি ভালো হবে না। যদিও সরকারি অনেক কর্মচারী কর্মকর্তার প্রচুর ব্যর্থতা আছে। সেদিনও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক চেয়ারে বসে যুদ্ধ করলেন। আর যাই হোক, চেয়ারে বসে যুদ্ধ করা যায় না। বারবার খবরে বলা হচ্ছে, ৫০ জন কোয়ারেন্টাইনে আছেন। উনি বললেন, প্রায় ৫০ জন! তার মুখে প্রায় হবে কেন? তিনি একেবারে নিশ্চিত হয়ে বলবেন। ঘরে বসে তিনি তো কারও সঙ্গে আড্ডা মারছেন না। তিনি জাতির সঙ্গে কথা বলছেন। তাকে ধৈর্য নিয়ে বলতে হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি খুব একটা গড় ওল্টাননি। তার মন্ত্রণালয়ে ৩৭ লাখ টাকা দিয়ে পর্দা কেনা হয়, তার পরও মন্ত্রী থাকেন। আজ হোক কাল হোক, এর কঠিন বিচার হবে। সে বিচার থেকে কারও মুক্তি নেই, স্বাস্থ্যমন্ত্রীও মুক্তি পাবেন না। তাই বলছি, এখন দলাদলি -হলাহলি নয়, কোমরে গামছা বেঁধে ১৭ কোটি বাঙালির করোনা মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত, করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত। আজ দুই দিন আইইডিসিআর পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরাকে ধীরস্থির শান্তভাবে কথা বলতে দেখছি। খুবই ভালো লাগছে। এটাই তো আমরা চাই। কথাতেই শরীরে আগুন জ্বলে আবার সেই কথায়ই সমস্ত জ্বালা দুশ্চিন্তা দূর করে দেয়। নানান জন নানান কথা বলবেন, কিন্তু যারা দায়িত্বে আছেন তাদের কথাবার্তায় দরদ থাকতে হবে, মাধুর্য থাকতে হবে, থাকতে হবে অফুরন্ত ভালোবাসা আর মমতা। আমরা কি একবারও ভাবব না, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো কী বলেছেন। বিদেশে ভ্রমণরত বসবাসরতদের তিনি বলেছেন, ‘আমরা তোমাদের ভুলে যাইনি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত অথবা ভ্রমণরত কানাডিয়ানদের নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। দেশের বাইরে একজনও আমাদের সহযোগিতার বাইরে না। তাদের বিমান পেতে ঘরে ফিরতে যদি সহায়তা দিতে হয় সেটা আমি দেব।’ বাইরে থাকা কানাডিয়ানদের উদ্দেশে তিনি আহ্বান জানান, ‘যারা দেশের বাইরে আছো তারা এখনই দেশে ফিরে এসো। যারা ফিরছ তোমরা ঘরে থাকো। কেবল নিজেকে সুস্থ রাখার জন্য নয়, আমাদের স্বাস্থ্যকর্মী যাতে দরকারি সেবা ও মনযোগ দিতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে ঘরে থাকো।’ ট্রুডোর কথা কি দেশের বাইরে থাকা সন্তান-সন্ততির মঙ্গল কামনায় পিতা-মাতার মতো শোনায়নি? কানাডার প্রধানমন্ত্রী তার দেশবাসীকে দেশে আসার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছেন, সব রকম সাহায্য দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। আর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একজন শিক্ষিত মানুষ একেবারে মূর্খের মতো বললেন, কেউ দেশে ফিরবেন না। যে যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন।’ শুধু এটুকু নয়, সেদিন আবার বলেছেন, ‘কেউ মারা গেলে তার লাশ সেখানেই দাফন করুন। আল্লাহর দুনিয়া সবখানেই সমান।’ ভদ্রলোককে কী বলি, মাতৃভূমি কী তা চাকরি করা লোকেরা অনেকেই হয়তো বুঝতে পারবেন না। আমি ১৬ বছর নির্বাসনে ছিলাম। প্রতি মুহূর্তে কেমন লাগত সেটা আমি জানি। সেটা অনেকের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। ভদ্রলোক যদি মাইকেল পড়তেন তাহলে বুঝতেন সারা জীবন ইংরেজ সাজতে গিয়ে তার কি দুঃখ। লাশও দেশে আসতে পারবে নাÑ এ কেমন নিষ্ঠুরতা, কেমন বর্বরতা! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! চাটুকারদের কথা শুনবেন না। এবার আপনার সুযোগ এসেছে আপামর জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত দোয়া পাওয়ার। এই পরম সুযোগ আপনি হাতছাড়া করবেন না। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে দৃঢ়তার সঙ্গে এ দুর্যোগ মোকাবিলা করুন। আমরা সবাই আছি আপনার সঙ্গে। আপনি যাকে ডাকবেন তাকেই পাবেন। আপনার সঙ্গের অনেকেই পেখম ধরে আছে। তারা মনে করছে তারাই সব- এটা ঠিক নয়। আপনি কি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর ১৭ তারিখের নাচগানের অনুষ্ঠান দেখেছেন? ১৭ তারিখের পর যে কজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, কথাবার্তা হয়েছে যাদের টিভি প্রোগ্রাম সম্পর্কে সামান্য ধারণা আছে তারাই বলেছেন এত নিম্নমানের প্রোগ্রাম বিটিভিতেও ইদানীং হয় না। আমি ভেবেছিলাম নাচের প্রোগ্রাম শিবলী করেছে। শিবলী মহম্মদকে ছোট্টকাল থেকে জানি। ওরা হয়তো এখন ভুলে গেছে। স্বাধীনতার পরপর প্রখ্যাত সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বেরের সঙ্গে যুদ্ধবিধ্বস্ত মোহাম্মদপুরে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছি। সে সময় শিবলী-সাদী ওদের মায়ের সঙ্গে আসত। যখন যা সম্ভব সহযোগিতা করতাম। পরে শুনলাম শিবলী ছিল না। খুব সম্ভবত আজম খান নামে কেউ ছিলেন। অনুষ্ঠানের একেবারে শেষের দিকে একটা নৃত্যগীত ছিল। যেখানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের খ- খ- টুকরো টুকরো বাজানো হয়েছে। বেশ ভালো কথা। ওই ভাষণ ছাড়া তো আজকাল আর কারও কিছু করার নেই। তবে আমি এত মর্মাহত হয়েছি, যাকে বঙ্গবন্ধু সাজানো হয়েছিল তার চালচলন দেখে। আমাদের এখানে ও রকম লম্বা বেতৈরের এক ঠাকুর ছিল। দেখতে অনেকটা তার মতো। আমরা কখনো বঙ্গবন্ধুকে ওভাবে ভাবী না। মঞ্চে যখন বঙ্গবন্ধুরূপী অভিনেতা উবুড় হয়ে এটাওটা দেখছিলেন বড় বিসদৃশ লাগছিল। বঙ্গবন্ধু সারা জীবনে মনে হয় অমন ছটফট করেননি যেটা সেদিন অভিনেতারা করেছেন। শতবর্ষ উদ্যাপনকারীদের কাছে বিনীত অনুরোধÑ আপনারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যা তা করবেন না। তিনি আমাদের আবেগ-অনুভূতি, তিনি আমাদের ভালোবাসা, আমাদের অস্তিত্ব। তাঁই তাকে নিয়ে ছেলেখেলা করলে আমাদের বুকে বাঁধে। আমাদের সহ্য করতে কষ্ট হয়। তাই বলছি, আপনারা যা খুশি করুন কেউ মঞ্চে বঙ্গবন্ধু সাজতে যাবেন না। বঙ্গবন্ধু সাজার মতো আপনাদের কারও কোনো যোগ্যতা নেই, সে পবিত্রতাও নেই। সব জাতীয় অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে ভালোই হয়েছে। তবু যদি মহামারী থেকে বাঁচা যায়। কিন্তু মক্কার কাবা বন্ধ করে দেওয়া কোনো ভালো কাজ হয়নি। এটা কোনো কাজের কাজ নয়। কাবার দরজা বন্ধ করা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। সেদিন পত্রিকায় দেখলাম কোনো পন্ডিত বলেছেন, ভারতে ৩০ কোটি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হবে। আমার বিশ্বাস, ৩০ হাজারও করোনায় আক্রান্ত হবে না। ধূপধুনো, ফুলচন্দন, গোবর আর তুলসী যেখানে আছে সেখানে করোনায় কিছু করার সম্ভাবনা দেখি না। তাই আমাদের ধৈর্য ধরা উচিত। জাতীয় ঐক্যের বড় বেশি প্রয়োজন। সাধ্যানুসারে যার যা আছে তাই নিয়ে এই অদৃশ্য অজানা শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। যারা বিদেশে আছেন যারা আসবেন তারা নিজে থেকেই যদি ঘরে থাকেন মানুষের সংস্পর্শে না যান তাহলে কোনোমতেই করোনার প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশকে ব্যাপকভাবে স্পর্শ করতে পারবে না। ঘরে আলাদা থাকা এমন কী কঠিন কাজ। সেও তো মাত্র ১৪ দিন। বঙ্গবন্ধু সাড়ে আট বছর, আমার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী আট বছর, আমিও কয়েকবারে এক-দেড় বছর, কিশোরগঞ্জের নগেন সরকার ৩২ বছর, শ্রী তৈলহ্মণনাথ চক্রবর্তী ৩০ বছর, কমিউনিস্ট নেতা সুসং দুর্গাপুরের মণি সিং ৩০ বছর জেলে এবং আন্দামানে কাটিয়ে তারা যদি বেঁচে থাকতে পারেন তাহলে মাত্র ১৪ দিন নিজের বাড়িতে থাকা কী এমন কঠিন কাজ! জাতীয় প্রয়োজনে আলাদা থাকতে কি অসুবিধা? আমরা তো কত মানুষ পরিবার-পরিজনের জন্য কত কিছু করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! আপনি জাতির পিতার কন্যা, আপনার দরদ আপনার মমতা আপনার মানবতা ভালোবাসা কেন জাস্টিন ট্রুডোকে অতিক্রম করতে পারবে না। নিশ্চয়ই পারবেন। আমার বিশ্বাস, এবার আপনার আহ্বানের মতো আহ্বান এলে সমগ্র দেশ সাড়া দেবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! পিতার মতো আপনাকেও ভালোবাসি, মঙ্গল কামনা করি। আমাদের নির্বাচন কমিশন একেবারে চেতনাহীন, নির্বোধ। তাদের থামতে বলুন। এই ৫ শতাংশের ভোটে তাদের কিছু হবে না। পরবর্তীতে বদনামের ভাগী হতে হবে আপনাকে। তাই এদের থামান। ন্যায়-সত্য ধরে থাকুন। দেখবেন ভবিষ্যৎ মঙ্গলময় হবে।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর