করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী আজ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে, গোটা বিশ্ব আজ অচল। আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে, সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। অদৃশ্য শত্রু করোনার সঙ্গে চলছে জীবন-মৃত্যুর লড়াই। বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার মসজিদ, গির্জা, সঙ্ঘ, মন্দির বন্ধ হয়েছে। ওমরাহ পালন, মক্কার পবিত্র মসজিদুল হারামে অতিরিক্ত জনসমাগমে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। ভ্যাটিকান কর্তৃপক্ষ এবার সেইন্ট পিটার্স ব্যাসেলিকায় ইস্টারের উপাসনা বন্ধ করেছেন। সেইন্ট পিটার্স ব্যাসেলিকার ইস্টার প্রার্থনা পরিচালনা করবেন না পোপ ফ্রান্সিস। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে পবিত্র ক্রসের গির্জাও। তীর্থযাত্রীদের যেতে দেওয়া হচ্ছে না ইসরায়েলে। আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে অমৃতসরের বিখ্যাত স্বর্ণমন্দির। আমাদের দেশেও মসজিদসহ অন্যান্য উপাসনালয়ে জনগণের সংখ্যা সীমিত করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী রাস্তার ফকির থেকে শুরু করে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি, সবাইকে এ ভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ে ঘরে বন্দী থাকতে হচ্ছে। কিন্তু এতকিছুর মাঝে অনিবার্য মৃত্যুঝুঁঁকি জেনেও বুক চিতিয়ে সম্মুখ সমরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সারা বিশ্বের চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবাকর্মীরা। তারাই করোনাভাইরাসকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করছেন। লাখ লাখ রোগীর চাপ সামলাতে সন্তান, পরিবার-পরিজন থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়েই চিকিৎসকদের জন্য মিলছে না পর্যাপ্ত সুরক্ষা পোশাক। ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামও অপ্রতুল। এত প্রতিকূলতা নিয়ে করোনাযুদ্ধে থাকা চিকিৎসকরাও আক্রান্ত হচ্ছেন, প্রাণ হারাচ্ছেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, গত ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে এ চিকিৎসকরাই প্রাণ দিয়ে জয়ী হয়েছিলেন। সেটাও অনেক বড় লড়াই ছিল। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও ইতিমধ্যে বাংলাদেশে সংক্রমণ শুরুর পর থেকেই দেশের চিকিৎসকরা এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিয়োজিত রয়েছেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে এখন পর্যন্ত শতাধিক চিকিৎসক ও নার্স করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শিকার হয়েছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, একজন ডাক্তার ও একজন স্বাস্থ্যসেবাকর্মী ইতিমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেক চিকিৎসক ও নার্স চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখলেও তাদের ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে এর অনেক বড় প্রভাব পড়ছে। এমনকি ঘরে ফিরেও নিজেকে পরিবার থেকে আলাদা থাকতে হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চিকিৎসকদের বিভিন্ন পোস্ট, মন্তব্য মানুষের মনে তাদের জন্য দুঃখময় অনুভূতি ছড়িয়ে চলেছে। উপরন্তু কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা বা সমন্বয়হীনতার কারণে কিছু দায়িত্বহীন সিদ্ধান্ত চিকিৎসাসেবাকর্মীদের মনোবল ভেঙে দিয়েছে। সম্প্রতি ছয়জন চিকিৎসককে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অন্যায় করেছে, যা সঠিক হয়নি। যাদের বরখাস্ত করা হয়েছে, তারা কি আসলেই দোষী? তারা এখন কী করবে? তারা কি ওখানে কাজ করবে? তারা কাজ করবে কীভাবে? এমনকি নতুন কাউকে সেখানে নিয়োগও দেওয়া হয়নি। তাহলে চিকিৎসা চলবে কীভাবে? এতে করে কী ঘটল? তাদের কাজের মূল্যায়ন তো হলোই না বরং আমরা শুরুতেই উল্টো মনোবল ভেঙে দিলাম। চিকিৎসাসেবাকর্মীদের বরখাস্ত করা কোনো সমাধান নয়। চিকিৎসকদের ভয় দেখানোও কোনো সমাধানের পথ নয়। উপরন্তু করোনা পরীক্ষার পরীক্ষাগার স্থাপন এবং উপযুক্ত মাস্ক না পাওয়া নিয়ে যে সমন্বয়হীনতা সেটা প্রধানমন্ত্রীসহ সারা দেশের মানুষ সরাসরি ভিডিও কনফারেন্সে প্রত্যক্ষ করেছেন, যা এ সময়ে অপ্রত্যাশিত এবং দুঃখজনক। এ ছাড়া করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য নির্ধারিত চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়োগপ্রাপ্ত নার্স এবং চিকিৎসকদের নিয়মিত খাবার প্রদান করা হচ্ছে না কিংবা যে খাবার প্রদান করা হচ্ছে তার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
মনে রাখতে হবে রোগ যদি আরও ছড়ায় তাহলে মানুষ যেখানেই চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী পাবে সেখানেই ছুটবে। তাই, অবিলম্বে এ চিকিৎসকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। চিকিৎসকদের জন্য মানসম্মত পিপিই ও নিরাপদ মাস্ক সরবরাহ করতে হবে। এর সঙ্গে প্রয়োজন তাদের স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। যেহেতু চিকিৎসকরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করছেন কিংবা হাসপাতালে কর্তব্যরত অবস্থায় তারা যে কোনোভাবেই এ ভাইরাসের সংক্রমণের শিকার হতে পারেন। তাই এ চিকিৎসকদের পরিবার থেকে আলাদা করে ভালো বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্বের উন্নত দেশে বড় বড় হোটেলগুলো চিকিৎসকদের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার শুরু করেছে। আবার একজন চিকিৎসক আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসার ব্যাপারে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে করে দ্রুত সময়ে সুস্থ হয়ে তিনি আবার মানব সেবায় ব্রতী হতে পারেন। পাশাপাশি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদেরও কাজের সমন্বয়হীনতা দূর করে করোনা-সংক্রান্ত চিকিৎসাব্যবস্থাকে যতটা পারা যায় মসৃণ করতে হবে, যাতে স্বাস্থ্যকর্মীরা নির্বিঘ্নে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারেন।
এ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে চিকিৎসকদের আস্থায় নিয়ে আমাদের এ ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে ভাইরাসের বিপক্ষে লড়াই করতে হবে। করোনা পরিস্থিতিতে ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উৎসাহ দিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্যসেবাদানকারীদের জন্য সম্মানজনক প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন তাদের আবাসনগুলোতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু সরকারি-বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে এসেছে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে লাখ টাকা দিলেও নিজের মৃত্যুর দিকে কেউ কিন্তু এগিয়ে যাবে না। তাই অন্তত আমাদের নিজেদের স্বার্থেই ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা, তাদের সম্মান এবং সেবা দেওয়া জরুরি। প্রয়োজন ডাক্তারসহ চিকিৎসাসেবাকর্মীদের মানসিকভাবে উৎসাহ দেওয়া এবং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণের মাধ্যমে তাদের অনুপ্রেরণা দেওয়া। আমাদের বুঝতে হবে, চিকিৎসকদের মধ্যে কারও কারও দ্বিধা বা মনে জোর কম থাকতে পারে। তাদের মোটিভেশন করতে হবে। তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তারা যেন আশ্বস্ত হয় যে, এ ডিউটি করতে এসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম, যদি আক্রান্ত হয়ে যায় তাহলে তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা হয়েছে।
সাধারণ জনগণের রয়েছে বিশাল দায়িত্ব, আমরা বিভিন্ন জায়গায় দেখতে পাচ্ছি হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে, করোনা পরীক্ষার জন্য ল্যাব স্থাপনে বাধা দেওয়া হচ্ছে, এমনকি ডাক্তার শুধু নয় যারা এ বিপদে জনগণের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন যেমন : সাংবাদিক, পুলিশ প্রশাসনের লোকজন তাদেরও বাড়িতে থাকার ব্যাপারে অনেক বাড়িওয়ালা অসহযোগিতা করছেন। যা একেবারেই কাম্য নয় এবং অমানবিক। আমাদের মনে রাখতে হবে এ বিপর্যয় আমরা কেউ-ই একা বাঁচতে পারব না, আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। আমি একা করোনামুক্ত থাকলে হবে না, আমার আশপাশের মানুষ যদি করোনামুক্ত না থাকে তবে আমার করোনা আক্রান্ত হওয়ার চান্স বেড়ে যাবে। এ জন্য নিজের ভালোর জন্য হলেও সবাইকে সবার সহযোগিতা করতে হবে। আমরা অসুস্থ হলে কিংবা করোনা আক্রান্ত হলে আমাদের হাসপাতালে সেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের ঢিলেমি কিংবা কোনো সমন্বয়হীনতা বা যে কোনো ধরনের অসঙ্গতির কথা সাংবাদিকরাই সামনে তুলে ধরে সমাধানের আবেদন জানাবে, আমার বিপদে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাকে রক্ষা করবে। তাই দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের আরও বেশি মানবিক, সহনশীল ও দায়িত্বশীল হতে হবে। সচেতনতার অংশ হিসেবে আমাদের বাড়িতে থাকতে হবে, রাষ্ট্র ঘোষিত নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে। নিজে সচেতন হতে হবে, আশপাশের মানুষকে সচেতন করতে হবে।
ডাক্তারদেরসহ সব স্বাস্থ্যসেবাকর্মী এবং জরুরি সেবাদানকারী মানুষগুলোরও তো পরিবার আছে, মা-বাবা, ভাই-বোন, সন্তান রয়েছে। কাজেই তাদের সমস্যাটাও বুঝতে হবে এবং তাদের সঙ্গে নিয়েই করোনা মোকাবিলা করতে হবে। কারণ তারাই হলো সম্মুখ সমরের যোদ্ধা। কাজেই তাদের যদি দেখভাল না করা হয়, তাদের যদি মানসিকভাবে উৎসাহিত না করা হয়, সুরক্ষা না দেওয়া হয়, তাহলে তারা সেবাটা দেবে কীভাবে? তাই চিকিৎসকসহ সব সেবাদানকারীর প্রতি মানবিক হওয়া ও তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি।
লেখক : প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক।