সোমবার, ৯ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ধূসর এক মরীচিকার পেছনে ছুটে চলা

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

ধূসর এক মরীচিকার পেছনে ছুটে চলা

দুনিয়া কখনো মুখ তুলে তাকায়। কখনো পালিয়ে বেড়ায় পিঠ দেখিয়ে। ধনী গরিব হয়। আনন্দ গড়ায় বেদনায়। দুনিয়ার জীবন কখনো এক অবস্থায় স্থির থাকে না। কিšুÍ আমরা তা বুঝতে চাই না অবিরাম ছুটে চলি এই মরীচিকার পিছনে। অজান্তেই একদিন ফুরিয়ে যায় আয়ু। এসে যায় অন্তিম মুহূর্ত। অস্থায়ী উপভোগের সব বস্তু ছেড়ে দিয়ে পাড়ি জমাতে হয় ওপারে। দুনিয়া আমাদের ধোঁকায় ফেলে আখিরাতকে ভুলিয়ে রাখে। ভুলিয়ে রাখে সে সত্যকে যার সম্মুখীন হব আমরা সবাই। তবুও এই দুনিয়াকে ঘিরেই আমাদের অনেক স্বপ্ন। আফসোস একটিবারও গভীরভাবে ভেবে দেখলাম না যে, আমাদের আগে আরও অনেকে দুনিয়ার এ পথ অতিক্রম করেছে। দুনিয়ার সামগ্রী অর্জনের জন্য আমাদের চেয়েও বেশি চেষ্টা করে গত হয়েছে, কোথায় আজ তারা? কোথায় তাদের দুনিয়া অর্জন? প্রিয় পাঠক। দুনিয়া অন্বেষণকারীর উদাহরণ হলো সমুদ্রের পানি পানকারীর ন্যায়, যতই সে পান করে, ততই তার তৃষ্ণা বৃদ্ধি পায়। একদিকে মৃত্যুর তীর তাক করা আছে প্রত্যেকের দিকে। অন্যদিকে আশা-আকাক্সক্ষার ফাঁদ পাতা আছে চলার পথে। সুতরাং আমাদের প্রতিটি পা ফেলতে হবে সতর্কতার সঙ্গে। আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে অনেককেই বলতে শুনেছি, ‘দুনিয়ার সমৃদ্ধি অনেক সময় শুধু দুশ্চিন্তাই বয়ে আনে না কেড়ে নেয় মানসিক প্রশান্তি। সম্পদ বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়তে থাকে পেরেশানির মাত্রাও।’ আমরা অনেকেই দীনের কাঠামো বিচূর্ণ করে দুনিয়ার প্রাসাদ গড়ি। ফলে দিন শেষে না পাই দীন না পাই দুনিয়া। আমাদের পূর্বসূরিরা আখিরাতের জন্য সময় ব্যয় করার পর হাতে থাকা অবশিষ্ট সময় দুনিয়ার জন্য বরাদ্দ রাখতেন। আর আমরা দুনিয়ার জন্য সময় ব্যয় করে অবশিষ্ট সময় নির্ধারণ করি আখিরাতের জন্য। দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের সুখ-শান্তি, নাম-যশ ও আরামের জন্য কত কিছুই তো আমরা করছি। অথচ পরকালের সময়ের তুলনায় এ জীবন মাত্র সাড়ে তিন মিনিট। এর জন্যই যদি এত কিছু করা হয়, তবে স্থায়ী আবাসের জন্য কত বেশি প্রস্তুতি নেওয়া দরকার, একটু কি ভেবেছি। দুনিয়ার রং মহলে ডুবে থেকে আমরা আখেরাত ভুলে হারিয়ে যাই রঙের দুনিয়ায়। ভুলে থাকি আল্লাহকে। ভুলে যাই কবরের জীবনকে। কবর দেশের খবর নেওয়ার ফুরসত পাই না একেবারে।

আজকে টাকার গরমে, ক্ষমতার দাপটে ধরাকে সরা জ্ঞান করছি। একটিবারও ভাবছি না আমার চেয়ে কত বেশি টাকাওয়ালা ছিল কারুন, কত বেশি ক্ষমতাধর ছিল নমরুদ, ফেরাউন। কত বেশি জ্ঞানী ছিল কবরের দেশে চলে যাওয়া মানুষগুলো। টাকার মায়া, ক্ষমতার অহংকার আর ইলমের বাহাদুরি তাদেরও ছিল। দুনিয়াজুড়ে তারাও খ্যাতি লাভ করেছিল। পৃথিবীর এ প্রান্তে ও প্রান্তে এক বাক্যে মানুষ তাদের চিনত। হায় আফসোস! আজ তাদের কবরের চিহ্নটুকু পর্যন্ত নেই। একদিন আমার ওপরও এমন একটি সময় আসবে। অন্ধকার কবর দেশে অসহায়-এতিমের মতো আমি পড়ে থাকব। আমার কবরের ওপর গরু ঘাস খাবে, ছাগল বসে থাকবে। কুকুর দৌড়াবে; কিন্তু হায়! একটি পোকা তাড়ানোর ক্ষমতাও আমার সে দিন থাকবে না।

আজ আপনার রক্ত গরম। ক্ষমতা বেশি। আপনার আগে কেউ চলে গেলে, আপনার কথার ওপর কথা বললে, হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন। হে আল্লাহর বান্দা, মনে করে দেখুন, এমন একদিন ছিল, আপনি কথাও বলতে পারতেন না। আবার একদিন আসবে আপনি কথা শুনবেন; কিন্তু জবার দিতে পাববেন না। মহান রাব্বুল আলামিন কোরআনুল কারিমের সূরা মরিয়মের ৯৩ নম্বর আয়াতে বলেছেন, মহাকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে এমন কেউ নেই, যে দয়াময়ের কাছে দাস হিসেবে হাজির হবেন না। ৯৫ নম্বর আয়াতে বলেন, আর মহাবিচার দিবসে সবাই একাকীই হাজির হবে তার কাছে। সুতরাং সেই দিনের কথা একটু কি ভাবা উচিত নয়। নবী-রসুলগণ আমাদের দেখিয়ে গেছেন দুনিয়ার চেয়ে পরকালকে কীভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘মুহাম্মদ (সা.)-এর পরিবারবর্গের ওপর কখনো কখনো এক মাস অতিক্রান্ত হয়ে যেত, অথচ কোনো রুটি বানানো হতো না।’ বর্ণনাকারী বলেন, আমি বললাম, ‘হে উম্মুল মুমিনীন! তাহলে রসুল (সা.) কী খেয়ে থাকতেন?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘আমাদের প্রতিবেশী ছিল কতিপয় আনসার-আল্লাহ তাঁদের উত্তম প্রতিদান দিন, তাঁরা রসুল (সা.)-কে কিছু দুধ উপহার দিতেন।’ (মুসলিম-২৯৭২/১৮)

আল্লাহ ইউনুস (আ.) সম্পর্কে বলেন, বিপুল অন্ধকারের মধ্যে সে (আল্লাহকে) ডাকল... (সূরা আল-আম্বিয়া ৮৭) এর ব্যাখ্যায় সালিম ইবনু আবিল জা’দ (রহ.) বলেন, আল্লাহ তিমিকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তুমি তার হাড় ও মাংসের কোনো ক্ষতিসাধন করবে না। কিছুক্ষণ পর সেই তিমিকে আরেকটি তিমি গিলে ফেলে।  ইউনুস (আ.)  ঘোর অন্ধকারের মধ্যে আল্লাহকে ডাকতে থাকেন; ঘোর অন্ধকার হলো- (প্রথম) তিমির অন্ধকার, (তার ওপর) আরেক তিমির অন্ধকার ও (সর্বোপরি) সাগরের অন্ধকার। আল-ফাতহুর রব্বানি, ২০/৮১ তে এসেছে  ‘ইউনুস (আ.) তিমির পেটে চল্লিশ দিন ছিলেন, এই সময়ে তিনি আল্লাহকে ভোলেননি। সাবিত (রহ.) বলেন, দিবারাত্রির সময়কে দাউদ (আ.) তাঁর পরিবারের লোকদের মধ্যে বণ্টন করে দিয়েছিলেন; ফলে রাতের বেলা কখনো এমন সময় অতিবাহিত হয়নি যখন তাঁর পরিবারের কেউ না কেউ সালাতে দন্ডায়মান থাকেননি। আল্লাহ তাঁদের এ বিষয়টি নিম্নোক্ত আয়াতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞ হও; আমার দাসদের অল্প অংশই কৃতজ্ঞ। (সূরা সাবা ১৩)।

লেখক : চেয়ারম্যান : বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীরসাহেব আউলিয়ানগর।

www.selimsazadi.com

সর্বশেষ খবর