রবিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

ইয়েমেনের কষ্টের শেষ কোথায়

তুষার কণা খোন্দকার

ইয়েমেনের কষ্টের শেষ কোথায়

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শপথ নেওয়ার পর অনেক এক্সিকিউটিভ অর্ডারে সই করেছেন। সেসব সিদ্ধান্ত আমেরিকানদের স্বার্থের পক্ষে যাচ্ছে নাকি বিপক্ষে তা বোঝার দায়িত্ব আমেরিকাবাসীর। আমি একজন ভিনদেশি মানুষ হিসেবে সেসব নিয়ে কোনো আলোচনায় যেতে চাই না। তবে ভিনদেশি একজন মানবতাবাদী হিসেবে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে অন্তস্তল থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি তাঁর একটি বাক্যের জন্য। তিনি বলেছেন, ‘ইয়েমেন যুদ্ধের অবসান হওয়া প্রয়োজন।’ ইয়েমেনের যুদ্ধ প্রসঙ্গে আমি আগেও বাংলাদেশ প্রতিদিনের পাতায় লিখেছি। ইয়েমেনের যুদ্ধকে আমার কখনো যুদ্ধ মনে হয় না; মনে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির নাজি বাহিনীর ইহুদি নিধনের ইয়েমেনি সংস্করণ। যুদ্ধের নিয়মনীতির মাপকাঠি দিয়ে এ আত্মঘাতী বিধ্বংসী হানাহানিকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। ইয়েমেনের যুদ্ধের ক্ষত পক্ষ-বিপক্ষের যোদ্ধারা কতখানি বহন করছে তা যুদ্ধরত বাহিনীগুলো ভালো বলতে পারবে। কিন্তু ইয়েমেন যুদ্ধের ভয়ংকর ক্ষত বহন করছে সে দেশের লাখ লাখ নারী-শিশু-পুরুষ। এরা কেউ যোদ্ধা নয়। কিন্তু যুদ্ধ নামের হানাহানির সর্বনাশা ফল কি নিদারুণভাবে সাধারণ মানুষের জীবন বিধ্বস্ত করে দিয়েছে তা দেখলে নিজেদের সভ্য পরিচয় দিতে লজ্জা হয়। ইয়েমেনের ভুখা-নাঙ্গা কঙ্কালসার শিশুগুলো একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতার মুখোশের ওপর ক্রমাগত আঁচড় কেটে যাচ্ছে। কিন্তু শিশুগুলো জানে না উন্নত দুনিয়ার মুখ থেকে সভ্যতার মুখোশ সরে গেলে তার নিচ থেকে যে রাক্ষসমূর্তি বেরিয়ে আসবে তার সবটাই অস্ত্র বিক্রির লোভ আর আধিপত্য বিস্তারের লালসা দিয়ে ঠাসা। ২০১৪ সালে শুরু হয়ে ইয়েমেন একটি সর্বগ্রাসী রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। কত শিশু সেখানে ক্ষুধায় কষ্ট পেয়ে রোগে ভুগে মারা গেছে তার সঠিক পরিসংখ্যান একদিন হয়তো পাওয়া যাবে। তবে আজ ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের রিপোর্ট বলছে, এ বছর অর্থাৎ ২০২১ সাল শেষে হওয়ার আগে ও দেশে ৪ লাখ ইয়েমেনি শিশু পুষ্টিহীনতায় মারা যাবে। এমন রিপোর্ট নতুন কিছু নয়। ছয় বছর ধরে ইয়েমেনের মানবিক বিপর্যয়ের খবর দুনিয়ার সব সংবাদমাধ্যমে বারবার প্রকাশিত হয়েছে; কিন্তু দুনিয়ার মানুষ তাতে কতটুকু সাড়া দিয়েছে সেটি বড় প্রশ্ন। 

উন্নত দুনিয়া ইয়েমেনের যুদ্ধকে দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে চোখ উল্টে দিয়ে বসে থাকতে চায়। সবচেয়ে বড় সত্য, ইয়েমেনের যুদ্ধকে পুঁজি করে উন্নত দুনিয়া সৌদি আরব কিংবা ইরানের কাছে অস্ত্র বিক্রির ধান্ধায় ব্যস্ত। আমেরিকার ট্রাম্প প্রশাসন কোনো রাখঢাক না রেখে সৌদি আরবের সঙ্গে বিশাল অঙ্কের অস্ত্র বিক্রির চুক্তি করেছিল। বাইডেন প্রশাসন সে চুক্তি আপাতত স্থগিত করেছে। তবে বাইডেনের চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্তকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করার সুযোগ নেই। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনের রোগাভোগা শিশুদের মেরে সাফ করে দেওয়ার মতো যথেষ্ট অস্ত্র সৌদি আরবের ভান্ডারে জমা আছে। যুদ্ধরত পক্ষগুলোর ক্ষমতার জিঘাংসা না কমলে অস্ত্র বিক্রির চুক্তি স্থগিত করে কোনো লাভ হবে না। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুদ্ধরত পক্ষগুলোকে আলোচনার টেবিলে বসতে বলেছেন। এ কথাটি মুখে বললে হবে না। ইয়েমেনের যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে তিনি আন্তরিক হলে তাঁর প্রশাসন থেকে দায়িত্বশীল, মানবিক অনুভূতিসম্পন্ন কোনো প্রতিনিধিকে ইতিবাচক আলোচনা শুরু করার দায়িত্ব দিতে হবে। জাতিসংঘ মাঝেমধ্যে আচমকা জেগে উঠে বলে, হায় হায় এ কী হলো! ইয়েমেনে যা ঘটছে একে মানবিক বিপর্যয় ছাড়া আর কিছু বলা সম্ভব নয়। জাতিসংঘ তাদের মানবতাবাদী খোলস ধরে রাখার জন্য আহাবিহার অভিনয় করে থাকে। জাতিসংঘের কাছে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করাও উচিত নয় কারণ জাতিসংঘ একটি নখদন্তশূন্য বাঘ। ইয়েমেন যুদ্ধ কেন্দ্র করে বক্তৃতা-বিবৃতি দেওয়ার সময় জাতিসংঘের ভাষা শুনে মনে হয় এ যুদ্ধ দেশটির অভ্যন্তরে ছোটখাট জাতিগত দাঙ্গা। এটি ইয়েমেনিরা নিজ উদ্যোগে মিটিয়ে ফেলতে পারে।

ইয়েমেনের বাস্তবতার আলোকে বিবেচনা করলে একে কি গৃহযুদ্ধ বলা যাবে? ইয়েমেনের যুদ্ধে যে সার্বিক মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে তাকে কি কোনোভাবে ছোট করে দেখার সুযোগ আছে? আমার বিবেচনায়, ইয়েমেনের যুদ্ধকে গৃহবিবাদ হিসেবে চিত্রিত করে দুনিয়ার ক্ষমতাধর দেশগুলো তাদের অস্ত্র ব্যবসার লালসা ঢেকে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ যুদ্ধের সঙ্গে খোদ ইয়েমেনবাসীর স্বার্থের যোগাযোগ আদৌ আছে কিনা তা তারা খতিয়ে দেখতে রাজি নয়। আসলে ইয়েমেন ভূখন্ডের ওপর ইরান ও সৌদি আরব তাদের প্রভাব বিস্তারের লোভ থেকে এ নিষ্ঠুর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এমন যুদ্ধকে রাজনীতির ভাষায় বলা হয় ছায়াযুদ্ধ অর্থাৎ প্রক্সি ওয়ার। ইয়েমেনের সুন্নি নেতা মনসুর হাজী ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা সৌদি আরবের স্বার্থে ইয়েমেনের মাটিতে জায়েদি শিয়া হুতি বিদ্রোহীদের বিপক্ষে লড়াই করছেন। মনসুর হাজী ধর্মীয় পরিচয়ে সুন্নি মুসলমান। এরা সৌদি আরবকেই তাদের গার্জিয়ান মেনে বসে আছে। ইয়েমেনের মাটিতে বসে মনসুর হাজীর লোকজন সরকার গঠন করতেও সাহস পান না। মনসুর হাজী অ্যান্ড গং সরকার গঠনের জন্য সদলবলে সৌদি আরবে যান। অথচ মনসুর হাজী নিজেকে ইয়েমেনের আইনসম্মত শাসক বলে দাবি করেন। ইয়েমেনবাসীর জন্য মনসুর হাজী এমন এক শাসক যার অবস্থান ব্যাখ্যা করতে চাইলে বাংলা প্রবচনের আশ্রয় নিতে হয়। আমার দেশের লোক চলতি ভাষায় মনসুর হাজীকে বলে ‘ভাত দেবার মুরোদ নাই কিল মারার গোঁসাই’। হাজার হাজার ইয়েমেনি শিশু খাবারের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরছে আর মনসুর হাজী সেখান থেকে চোখ ফিরিয়ে সৌদি রাজা-বাদশাহর পদলেহনে মজে আছেন। হুতি যোদ্ধারা শিয়া। গায়ে শিয়া ছাপ থাকায় হুতিরা ইরানের শাসক দলের প্রিয় পাত্র। ইরান দাবি করে, হুতিরা ইরানের ধর্মীয় নেতার অঙ্গুলি হেলনে ওঠে-বসে। ইরানি ধর্মীয় নেতা বুক চিতিয়ে বলেন, আমরা হুকুম করলে হুতি বিদ্রোহীরা সৌদি আরবের তেল স্থাপনার ওপর গোলাবর্ষণ করে থাকে। কিন্তু আমার বিবেচনায় কথাটি সর্বাংশে সত্য হতে পারে না। ইরানি নেতার এমন ঘোষণা স্রেফ সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অপকৌশল ছাড়া কিছু না। আমার এমন বিশ্বাস জন্মানোর জন্য কিছু ঐতিহাসিক বাস্তবতা আছে। হুতিরা শিয়া তবে তারা ইরানের ১২ ইমামবাদী শিয়া নয়। ইরানের শিয়ারা যে ঘরানার শিয়া ধর্ম পালন করে তা হুতি বিদ্রোহীদের থেকে একেবারে আলাদা। ইয়েমেনের শিয়ারা জায়েদি মাজহাবের শিয়া। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ইয়েমেনের জায়েদি মাজহাবের শিয়া ধর্মাবলম্বী নেতা হোসেন বদরুদ্দিন আল-হুতি ইয়েমেনে সুন্নি আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন। জায়েদি শিয়া নেতা বদরুদ্দিন হুতির নামে এ বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নাম হয়েছে হুতি বিদ্রোহী। ১২ ইমামবাদী ইরানি শিয়া বিশ্বাস থেকে জায়েদি শিয়া গোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাস সম্পূর্ণ আলাদা। সৌদি আরবকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য ইরানের ১২ ইমামবাদী শিয়ারা ইয়েমেনের জায়েদি শিয়াদের ভারি বন্ধু সেজেছে। ইতিহাস বলে, একসময় ইরান ও ইরাকে প্রচুর জায়েদি শিয়ার বাস ছিল। কিন্তু ১২ ইমামবাদী শিয়াদের অত্যাচারে জায়েদি শিয়াদের এক অংশ প্রাণে মরেছে আর আরেক অংশ নিজেদের মাজহাব পরিবর্তন করে জান বাঁচিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, জায়েদি শিয়ারা ইয়েমেন থেকে তাদের বাস তুলে নিয়ে আজ যদি ইরানে এসে বসবাস করতে চায় তাহলে ১২ ইমামে বিশ্বাসী ইরানি শিয়ারা জায়েদি শিয়াদের ধর্মের ভাই ডেকে কোলে তুলে নেবে না। ইরানের মাটিতে ইরানি শিয়ারা কি জায়েদি শিয়াদের স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করতে দেবে? ইতিহাস বলে, ইরানি শিয়ারা জায়েদি শিয়াদের সমমর্যাদা দেওয়া দূরের কথা, জায়েদি শিয়াদের ইরানি শিয়ারা আগের মতো জানে মারতে দ্বিধা করবে না। কাজেই ইয়েমেনে যা কিছু ঘটছে তা ইয়েমেনের সমস্যা নয়। ইয়েমেনে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে ছায়াযুদ্ধ চলছে এটিই সত্য।

ইয়েমেনের যুদ্ধ এবং তার পরিণামে মানবিক বিপর্যয়ের রূপ দেখে মনে হয় বিশ্ববিবেক শব্দটি সত্যি ভয়ানক খেলো। বিশ্ববিবেক শব্দটি কত খেলো তার বড় প্রমাণ ২০১৫ সালে ইয়েমেনের বিরুদ্ধে সৌদি জোটের চার সপ্তাহের সর্বগ্রাসী সামরিক অভিযান। সামরিক ইতিহাসে এ ঘৃণ্য যুদ্ধের নাম অপারেশন ডিসাইসিভ স্টর্ম। মনসুর হাজী নিজ দেশে হুতিদের হাতে পরাজিত হয়ে সৌদি আরবে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সৌদি আরবের মাটিতে বসে তিনি তার নিজ দেশ ইয়েমেনকে ধ্বংস করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র মাথায় নিয়ে সৌদি জোট গঠনে মদদ দিলেন। তারই মদদে সৌদি আরব ২০১৫ সালের মার্চে একপাল বন্যপশুর মতো ইয়েমেনিদের ওপর হামলে পড়েছিল। সে যুদ্ধে মানবতার ধ্বজাধারী আমেরিকা গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ এবং অন্যান্য সহযোগিতা করে ইয়েমেনে গণহত্যা ও মানবিক বিপর্যয় ত্বরান্বিত করেছিল। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০২১ সালে হোয়াইট হাউসে বসে বলেছেন, ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধ হওয়া উচিত। অথচ ২০১৫ সালে জো বাইডেন ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউসেই ছিলেন। ২০১৫ সালে ইয়েমেন আক্রমণে যারা সৌদি আরবের সহযোগিতা করেছে তারা সবাই সৌদি আরবের কাছ থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছে।

ইয়েমেনের মানবিক বিপর্যয়ের ভয়ংকর রূপ দেখে উন্নত দুনিয়া অস্ত্র বিক্রির লাভ-ক্ষতির হিসাব থেকে সরে আসবে আমি এমনটি বিশ্বাস করি না। তবে দুনিয়ার কাছে নিজেদের মানবতাবাদী খোলস টিকিয়ে রাখতে হলে আমেরিকা ও তার সহযোগীদের যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। গত কয়েক বছর একটানা যুদ্ধ চলার কারণে ইয়েমেনে হরেক রকম সন্ত্রাসী অপশক্তি দানা বেঁধেছে। ইয়েমেনের যুদ্ধ এখন আর হুতি কিংবা সুন্নিদের বিবাদ-বিভাজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। হত্যা ও ধ্বংসের বান ডাকার পরে সেখানে আইসিস, আল-কায়েদা, আল নুসরা ফ্রন্ট সবাই আপন আপন শক্তি দেখাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ইয়েমেনের অন্য ছোটখাট গোষ্ঠীগুলো নিজেদের শক্তিবলয় বাড়ানোর জন্য মাথা তুলে দাঁড়িয়ে গেছে। এ অবস্থায় সৌদি আরব এবং ইরান যদি এ মুহূর্তে ইয়েমেনে যুদ্ধ থামিয়ে দেয় তবু ইয়েমেনের আকাশ থেকে অশান্তির কালো মেঘ সরবে না। ইয়েমেনে যুদ্ধ থামিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে কোনো নিরপেক্ষ শক্তিকে নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইয়েমেনের যুদ্ধ থামানোর জন্য মুখের কথায় নিজেকে আটকে না রেখে বাস্তব পদক্ষেপ নেবেন এ আশায় আমরা দিন গুনছি।

            লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর