বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

এত আগুনে পোড়ে কেন দেশ?

তসলিমা নাসরিন

এত আগুনে পোড়ে কেন দেশ?

আমেরিকায় গাড়ি পার্ক করতে গেলে সমস্যায় পড়ি। রাস্তার কিনারে চমৎকার পার্কিং-এর জায়গা পাওয়া যায়, কিন্তু পার্ক করা চলবে না। কেন? ফায়ার হাইড্রেন্ট। ফায়ার হাইড্রেন্টের সামনে গাড়ি পার্ক করলে বিশাল জরিমানা। এই জায়গা সবসময় ফাঁকা রাখতে হবে। কারণ যে কোনও সময় জায়গাটা দরকার পড়বে। এত ফায়ার হাইড্রেন্ট কেন শহরে? উত্তর তো জানিই। আগুন ধরলে যেন দ্রুত আগুন নেভানো যায়। যে কোনও সময় যে কোনও বাড়িতে, বা অফিসে, বা কারখানায় যে কোনও কারণে আগুন লেগে যেতে পারে। ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি এসে থামবে, তার জায়গা চাই, ফায়ার হাইড্রেন্টে নল লাগিয়ে দিলে পানি এমন জোরে বেরোবে যে, সে পানি আগুনের ওপর ছড়ালে আগুন নিভে যাবে, দ্রুত অথবা ধীরে। হাত গুটিয়ে বসে থাকার চেয়ে নিশ্চয়ই এ কাজটি ভালো। ফায়ার ব্রিগেডের গাড়িতে পানির ট্যাংক থাকে, সেটাও রইল, এটাও রইল। আগে তো ফায়ার ব্রিগেড ছিল না, ছিল বাকেট ব্রিগেড। বালতিতে পানি ভরে নিয়ে এসে আগুন নেভানোর চেষ্টা করত মানুষ। এক সময় ঘোড়ার গাড়িতে করে পানি নিয়ে আসা হতো আগুন নেভানোর জন্য। যত আধুনিক হয়েছে মানুষ, তত আগুন নেভানোর আধুনিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। ইউরোপের ফায়ার হাইড্রেন্টগুলো মাটির নিচে, আমেরিকায় মাটির ওপর। যে দেশে মানুষের জীবনের মূল্য আছে, সে দেশে দুর্ঘটনা যেন না ঘটে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকার সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়, এবং দুর্ঘটনা যদি ঘটেই যায়, একে নিয়ন্ত্রণ করতে, ক্ষয়ক্ষতি যেন বেশি না হয় তার সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শুধু ধনী-এলাকায় নয়, ধনী নয় এমন এলাকাতেও, শ্রমিক-এলাকাতেও একই রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

বাংলাদেশে কদিন পর পরই আগুনে পুড়ে যায় ঘর-বাড়ি, কলকারখানা। আগুন সহজে নেভানো যায় না। কারখানাগুলোকে এমন ভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যে যে কোনও সময় যে কোনও ধাক্কায় ধসে যেতে পারে। যে কোনও ম্যাচকাঠির গন্ধ শুঁকলেই আগুন লেগে যেতে পারে। এমন দুর্ঘটনা ঘটলে, সকলে জানে, কাদের মৃত্যু হবে। শ্রমিকদের, গরিবদের। গরিবরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শ্রম দেয়। ধনীরা মনে করে না গরিবের জীবনের কোনও মূল্য আছে। রানা প্লাজার ছ’তলার বিল্ডিং-এর ওপর অবৈধভাবে দুটো তলা উঠিয়ে এর ভিতটাকেই নড়বড়ে করে দেওয়া হয়েছিল বলেই তো ধসে গেল, মৃত্যু হলো ১১৩৪ জন শ্রমিকের। কারখানা কোনও একটি ভুলের কারণে পুড়ে ছাই হয়ে যায়, শ্রমিকরাও পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কারখানা বন্ধ থাকে কিছুকাল। মালিকেরা আবার খোলে কারখানা। ভুলগুলো সংশোধন করে কি খোলে? একেবারেই না।

২০২০ সালে ৩৮৩টি শিল্পকারখানা আগুনে পুড়েছে। এর মধ্যে ২৭৩টিই পোশাকশিল্পকারখানা। ২০১২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পোশাকশিল্পকারখানায় ১৫০টি আগুনে পোড়ার ঘটনা ঘটেছে। ১৩০০ জন মারা গেছে, আর ৩৮০০ এর চেয়েও বেশি মানুষ আহত হয়েছে। গত ৫ বছরে ৫৮৩৪টি শিল্পকারখানায় আগুনে পোড়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে ক্ষতি হয়েছে ২৫০ কোটি টাকা।

ভুল সংশোধন বাংলাদেশের পোশাকশিল্পকারখানার মালিকেরা করেন না। ২০১২ সালে আগুন লেগে তাজরীন ফ্যাশন ফ্যাক্টরির ১১৭ জন শ্রমিক মরে গেল। তার কিছুদিন পর স্মার্ট এক্সপোর্ট কারখানায় আগুন লেগে আট জন মারা গেল। তার কিছুদিন পর আরও একটি পোশাকশিল্পকারখানার আরও আটজন আগুনে পুড়ে মারা গেল। এরকম চলছেই। মালিকপক্ষ জানেন, কিছু পয়সা ঢাললেই মামলা, গ্রেফতারি পরোয়ানা ইত্যাদি এড়ানো যায়। আর এই সেদিন রূপগঞ্জে হাসেম ফুড কোম্পানির কারখানায় আগুন লেগে ৫২ জনের মৃত্যু হলো। এই ৫২ জনের মধ্যে শিশু ছিল অনেক। আহত হয়েছে ৫০ জনের মতো। সব চেয়ে অবাক কান্ড, কারখানা থেকে বেরোবার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। যদিও বাংলাদেশের আইনে শ্রমিকেরা যখন কারখানায় কাজ করে, কারখানা থেকে বেরোনোর দরজা তালাবন্ধ করা নিষিদ্ধ। আইন অমান্য করে দরজায় কেন তালা লাগানো হলো? বেশ নির্বিঘ্নে যেন সবাই মরতে পারে? কারখানার নিচতলায় হয়েছে আগুনের সূত্রপাত, আর তখন কিনা নিরাপত্তাকর্মীরা কারখানা থেকে বেরোবার দরজায় তালা লাগিয়ে দিল! শ্রমিকেরা বাঁচার জন্য অগত্যা ওপরের তলায় উঠে যায়। কিছু শ্রমিক বাঁচার জন্য ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মরে যায়। কারখানায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না, অথচ প্রত্যেক কারখানায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকা অত্যন্ত জরুরি। হাসেম ফুডসের নিরাপত্তাকর্মীরা, যতদূর জানা যায়, ব্যস্ত ছিল নিজেদের নিরাপত্তা আর কারখানার নিরাপত্তা নিয়ে। তারা শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে সামান্যও ভাবেনি। দরজা তালাবন্ধ না করলে আজ এতগুলো মানুষকে মরতে হয়না। ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশন ফ্যাক্টরির ১১৭ জন শ্রমিক যে মারা গিয়েছিল, সেই ফ্যাক্টরি থেকে বেরোবার দরজাও কিন্তু তালাবন্ধ ছিল। শিক্ষা হয়নি। বিল্ডিং-এ নাকি কেমিক্যাল জমা করা ছিল। ২০১৯ সালেই তো অবৈধভাবে কেমিক্যাল রাখার কারণে এক বাড়িতে আগুন লেগে ৭০ জন মারা গেল। এর আগেও কিন্তু কেমিক্যাল রাখার কারণেই ২০১০ সালে পুরোনো ঢাকায় ১২৩ জন লোক মারা গিয়েছিল। তারপরও শিক্ষা হয়নি!

শিক্ষা কেন হয় না জানি। কারণ গরিবদের জীবনের কোনও মূল্য নেই। গরিবরা কারখানায় মরে ছাই হয়ে গেলেও, আরও অসংখ্য গরিব মিলবে কারখানায় কাজের জন্য। ওদিকে যদি মালিকের বিচার করা হয়, বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে জামিন নিয়ে ইউরোপ আমেরিকায় পাড়ি জমিয়ে চমৎকার জীবন যাপন করে মালিকেরা। দেশেও এঁদের লাক্সারির শেষ নেই, বিদেশেও লাক্সারির শেষ নেই। ধন সম্পদ এরা বানায় গরিবের ঘাম আর রক্ত দিয়ে, গরিবের পোড়া শরীর দিয়ে। গরিবেরা তো নিজেদের গরিব বস্তিগুলোয় মরছেই। প্রতিবছর আগুনে পুড়ছে বস্তি। অবৈধভাবে বিদ্যুৎ আর গ্যাসের সংযোগ নেওয়া হয় বস্তিতে। শর্ট সার্কিট হয়ে আগুন ধরে যায়, ঘর বাড়ি পোড়ে, মানুষ পোড়ে। এক ঢাকাতেই সাড়ে ছ’লক্ষের বেশি লোক বাস করে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বস্তিতে। অবৈধভাবে বিদ্যুতের তার যায় বটে বস্তির ঘরে ঘরে, কিন্তু বস্তির এক একটা ঘর থেকে বিদ্যুৎ এবং গ্যাস বাবদ চার পাঁচশ’ করে টাকা দিতে হয় সিন্ডিকেটের হাতে। এই সিন্ডিকেটই ৩ থেকে ৫ কোটি টাকা এভাবেই অবৈধ পথেই উপার্জন করছে প্রতি মাসে। এই টাকা থেকে অবশ্য পুলিশকে দিতে হয় বেশ খানিকটা। অনেকে ভাবে এই যে বস্তি পুড়ে যাচ্ছে, মানুষ পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, এর কারণ দারিদ্র। কেউ কেউ ভাবে, এর মূল কারণ দারিদ্র নয়, এর মূল কারণ লোভ। টাকার লোভেই অবৈধ বিদ্যুৎ দেওয়া হচ্ছে বস্তিতে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা দিন দিন ভালো হচ্ছে। ২০০৭ সালেও ভারতের মাথাপিছু আয়ের অর্ধেক ছিল বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়। আর গতবছর কিনা ভারতকেও ছাড়িয়ে গেল বাংলাদেশ! ভারতের জিডিপিও ৮ থেকে মাইনাস দশএ এখন। আর বাংলাদেশের জিডিপি ৭ পার হয়ে ৮এর ওপর। এই করোনাকালেও খুব একটা মন্দ নয় বাংলাদেশের জিডিপি। দারিদ্রও শতকরা ১৫ ভাগ থেকে শতকরা ৯ ভাগে নেমে এসেছে। সারা বিশ্বেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার স্তুতি গাওয়া হচ্ছে। এই সময় কি আগুনে শ্রমিকের জ্বলে যাওয়া, আর পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া আর মরে যাওয়ার খবর মানুষকে দ্বিধায় ফেলবে না? মানুষ বলবে না তাহলে দেশের ধন সম্পদ কী খাতে কাদের আরাম আয়েশ আর নিরাপত্তার জন্য ব্যয় হয়? যতই অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটুক দেশে, শ্রমিকের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা ছাড়া, অমানুষিক পরিশ্রম ছাড়া ঘটেনি। আর সেই উন্নতির ভাগ শ্রমিকের নিরাপত্তার জন্য জোটে না। আন্তর্জাতিক শ্রমিক বিধি না মেনে যুগের পর যুগ শ্রমিকদের শোষণ করা হয়েছে, আজও হচ্ছে। আজও শ্রমিকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পা বাড়ায় ধনীদের শ্রম দিতে।

বাংলাদেশে অতি-ধনীর সংখ্যা বেড়েছে ২০১২ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে। অতি ধনীদের সম্পদ এ সময় শতকরা ১৭.৩ ভাগ বেড়েছে। বাংলাদেশের মোট দেশীয় পণ্যের উৎপাদন এখন চীন, হংকং, কেনিয়া, আয়ারল্যান্ড, ভারত এবং পাকিস্তানের মোট দেশীয় পণ্যের উৎপাদনের চেয়েও বেশি। চীন এবং হংকং অবশ্য সবচেয়ে বেশি ধনী লোক তৈরি করেছে গত ৫ বছরে। বাংলাদেশে যদিও মাথাপিছু আয় বেড়েছে, উৎপাদনও বেড়েছে, কিন্তু গরিব এবং ধনীর মধ্যে ফারাকও বেড়েছে সেই সঙ্গে। গরিব আরও গরিব হয়েছে, ধনী আরও ধনী হয়েছে। এই যে অর্থনৈতিক সাফল্য তার সিংহভাগ ভোগ করছে ধনী শ্রেণী। গরিব ধনীর মধ্যে এই বিরাট বৈষম্যের পেছনে কারণ অনেক, অব্যবস্থা, এবং দুর্নীতি নিঃসন্দেহে বড় কারণ।

আমি অর্থনীতিবিদ নই। অর্থনীতিতে আমার অতি স্বল্প জ্ঞান। তবে একটি জ্ঞান তো নিশ্চয়ই আছে, সেটি হলো অর্থনৈতিক উন্নতি হলেই যদি দেশ উন্নত হতো, তাহলে যে দেশগুলোয় নারীর অধিকার বলতে, গরিবের অধিকার বলতে, বাক স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার বলতে কিছুর অস্তিত্ব নেই- মধ্যপাচ্যের সেই বর্বর দেশগুলোকে উন্নত বলে ধরা হতো। আমি মনে করি নারী পুরুষের সমানাধিকারের ব্যবস্থা হলে, কোনও শ্রেণী বৈষম্য না থাকলে, সম্পদের সুষম বণ্টন হলে, লিঙ্গ বর্ণ শ্রেণী নির্বিশেষে সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে, সকলের অন্ন বস্ত্র শিক্ষা স্বাস্থ্য নিশ্চিত হলে, গরিব শ্রেণীটির অস্তিত্ব বিলোপ হলেই সে দেশকে সত্যিকার উন্নত দেশ বলা যায়।

 

সত্যিকারের উন্নত দেশ হতে বাংলাদেশের অনেক দেরি।

 

                লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর