সোমবার, ২৬ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

খাইবারে আবার আসছে তালেবান

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

খাইবারে আবার আসছে তালেবান

ইউরোপিয়ানদের আগমনের আগে ভারতীয় উপমহাদেশে বিদেশি শক্তির দ্বারা যত আক্রমণ, হত্যাযজ্ঞ  ও লুণ্ঠন হয়েছে তার প্রায় সবগুলোতে আক্রমণকারীরা খাইবার গিরিপথ ধরে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছে। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে গজনির সুলতান মাহমুদ ১৭ বার ভারতবর্ষ আক্রমণ ও লুণ্ঠন অভিযানে খাইবার গিরিপথ ব্যবহার করেছেন। পরবর্তীতে ১৩৯৮ সালে তৈমুর লং, ১৭৩৯ সালে পারস্যের নাদির শাহ এবং ১৭৪৮-১৭৫৬, এই সময়ের মধ্যে আহমদ শাহ আবদালি বারবার দিল্লি পর্যন্ত এসেছে, হত্যাযজ্ঞ ও লুণ্ঠন চালিয়েছে, প্রতিবারই খাইবার গিরিপথই ছিল তাদের প্রবেশদ্বার। গবেষক ও জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল শশি থারুরের ‘অ্যান ইরা অব ডার্কনেস’ গ্রন্থের পঞ্চম পৃষ্ঠার বর্ণনায় পাওয়া যায়- নাদির শাহের তান্ডবে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ নিহত হয়। মুঘল সাম্রাজ্যের গৌরবের প্রতীক ময়ূর সিংহাসন ও কহিনূর ডায়মন্ড নাদির শাহ নিয়ে যান এবং সঙ্গে এত পরিমাণ সম্পদ লুট করেন যে, পরবর্তী তিন বছর রাজ্য পরিচালনায় পারস্যের মানুষকে কোনো কর দিতে হয়নি। লেখার শুরুতে কিছু বহির্দেশীয় দস্যুর ভারতবর্ষ আক্রমণ ও লুণ্ঠনের কথা উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে খাইবার পাসের অপর প্রান্তে তালেবানি শাসন শুধু আফগানিস্তানকে ধ্বংস করেনি, বিশ্ব ব্যবস্থাকে তছনছ করে ফেলেছে। দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বব্যাপী সশস্ত্র জঙ্গি সন্ত্রাসের জন্ম ও বিস্তার ঘটিয়েছে। একবার ভাবুন, তালেবানি সরকার ওসামা বিন লাদেনকে শুধু আশ্রয় নয়, বিশ্বব্যাপী অবাধে উগ্রবাদী ধর্মান্ধ জঙ্গি রপ্তানি ও আত্মঘাতী বোমা আক্রমণের সুযোগ করে যদি না দিত এবং ৯/১১-এর মতো ঘটনা যদি না ঘটত তাহলে কি আইএসের মতো দানবের জন্ম হতো। ইরাক ও সিরিয়ার মতো আধুনিক উদার, সমৃদ্ধ মুসলিম রাষ্ট্রের আজ যে দশা হয়েছে তা কি হতো? এহেন নিষ্ঠুর মধ্যযুগীয় পশ্চাদপদ তালেবানি শাসন আবার আফগানিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আশঙ্কায় গত কয়েক মাস যাবৎ বিশ্বের বড় বড় মিডিয়ায় অনবরত প্রবন্ধ, কলাম ও প্রতিবেদন ছাপা হচ্ছে এবং বিচার বিশ্লেষণ চলছে। ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি আমেরিকা ও তালেবানের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির শর্তানুযায়ী ন্যাটো বাহিনীসহ সম্পূর্ণ আমেরিকান ফোর্স আফগানিস্তান থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে ফেরত চলে যাবে। এ চুক্তি স্বাক্ষর এবং প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণায় খ্যাতিমান রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকগণ মোটামুটি সবাই একমত যে, শিগগিরই কাবুলে পুনরায় ক্ষমতা দখল করতে যাচ্ছে তালেবান বাহিনী। খোদ আমেরিকান গোয়েন্দা সূত্রের উল্লেখপূর্বক পত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে এই মর্মে যে, সেপ্টেম্বরে সৈন্য প্রত্যাহার শেষ হওয়ার ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে আশরাফ ঘানি সরকারকে হটিয়ে কাবুলের কর্তৃত্ব নিবে তালেবান বাহিনী। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র ভিন্ন কথা বললেও বিশ্লেষকরা এটাকে আমেরিকার স্ট্যাটেজিক পরাজয় ও আফগানিস্তানের মহামানবিক বিপর্যয়ের অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন। রাতের অন্ধকারে পুরো বিদ্যুৎ লাইন বন্ধ করে গাড়িসহ মূল্যবান সরঞ্জামাদি ফেলে ১ জুলাই মার্কিন সেনারা তাদের সদর দফতর বাগরাম বিমান ঘাঁটি যেভাবে ছেড়ে গেলেন তার বর্ণনা শুনে একটা প্রামাণ্য চিত্রের কথা মনে পড়ছে। আমেরিকায় একটা প্রশিক্ষণ কোর্সের সময় ২০০১ সালে প্রামাণ্য চিত্রটি দেখেছিলাম। যতদূর মনে পড়ছে সেটির শিরোনাম ছিল-‘সায়গন, দ্য ফাইনাল আওয়ারস’। তাতে দেখা যায়, ভিয়েতনামে আমেরিকান সেনাবাহিনীর সর্বশেষ দিন ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল শেষ ১৮ ঘণ্টায় মার্কিন সেনাদের সর্বশেষ দল, দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং মার্কিন সেনাদের সহযোগী দক্ষিণ ভিয়েতনামের বেসামরিক লোকজন সব ফেলে একটা ভয়ার্ত পরিবেশে বড় বড় হেলিকপ্টার ও পরিবহন বিমানে সায়গন ত্যাগ করছে। শেষ হেলিকপ্টার উড্ডয়নের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভিয়েতকং বাহিনী বিজয় উল্লাসে মার্কিন দূতাবাসের মধ্যে ঢুকে পড়ে। ৪৬ বছর পর একই রকম দৃশ্যের অবতারণা হয়তো হবে না। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি সে রকম কিছু ঘটার আগেই একটা ক্লিন ব্রেকের পথ বেছে নিল মার্কিন বাহিনী। ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারিতে তালেবানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তির চেয়েও শক্তিশালী শান্তি চুক্তি ১৯৭৩ সালে আমেরিকা স্বাক্ষর করেছিল উত্তর ভিয়েতনামের সঙ্গে। কিন্তু উত্তর ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট লি ডাক থো এক বছরের মাথায় তা ছুড়ে ফেলে দেন। ১৯৭৩ সালে হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হলেও লি ডাক থো সেটি গ্রহণ করেননি। ২০০১ সাল থেকে ২০ বছরে ২ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ, প্রায় আড়াই হাজার সৈন্য নিহত, কয়েক হাজার আহত হয়ে পঙ্গু ও মানসিক ভারসাম্য হারানোর মধ্য দিয়ে যাদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হলো, সেই তালেবান বাহিনী আবার কাবুলে ক্ষমতা দখল করবে জেনেও আমেরিকা কেন আফগানিস্তান থেকে সরে যাচ্ছে। আমেরিকান প্রশাসনের অফিশিয়াল ভাষ্য অনেকের কাছে যৌক্তিক মনে হচ্ছে না। বিশ্লেষণমূলক কিছু কারণের কথা অনেকেই বলছেন। প্রথমত, মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব ইউরোপে রাশিয়াকে এবং এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনকে সফলভাবে মোকাবিলা করাটাকেই হয়তো স্টেট ডিপার্টমেন্ট এখন অগ্রাধিকার দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আমেরিকার প্রশাসন হয়তো মনে করছে তালেবানই হোক, আর আল-কায়েদা বা আইএসই হোক, আমেরিকার মূল ভূ-খন্ডে পুনরায় ৯/১১ অথবা অন্যরকম কোনো বড় আক্রমণ চালানোার ক্ষমতা কোনো জঙ্গি সংগঠনের নেই, অথবা আমেরিকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতই সুরক্ষিত করা হয়েছে যে, সে চেষ্টা করেও তারা সফল হবে না। তবে উত্তর এবং উত্তর পূর্ব আফ্রিকায় বকোহারাম ও আল শাবাব জঙ্গি গোষ্ঠী যেভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাতে বিশ্লেষকরা বলছেন- এটা আমেরিকার বিগ মিসটেক; ১৯৯৮ সালের ৭ আগস্টে নাইরোবি ও দারুসসালামে আমেরিকান দূতাবাসে ভয়াবহ আত্মঘাতী বোমা আক্রমণের কথা ভুলে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না। অন্যদিকে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে কী হতে চলেছে এবং তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় তার কী প্রভাব পড়বে সেটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তালেবান বাহিনী ইতিমধ্যেই কয়েকটি প্রাদেশিক রাজধানীসহ আফগানিস্তানের অর্ধেকেরও বেশি এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। প্রতিনিয়তই সরকারি বাহিনীর পিছু হটার খবর আসছে। হয়তো দেখা যাবে আমেরিকান সৈন্য প্রত্যাহারের সম্পূর্ণ হওয়ার পরপরই নব্বই দশকের মতো একই কায়দায় পাকিস্তানি সৈন্যরা ছদ্মবেশে তালেবানদের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দেবে এবং আশরাফ খানির সরকারকে হটিয়ে তালেবান সরকারকে ক্ষমতায় বসাবে। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সাবেক প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদ গুল ২০১৪ সালে পাকিস্তানের এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে যখন ইতিহাস রচিত হবে তখন তাতে লেখা থাকবে আমেরিকার সহায়তা নিয়ে আইএসআই আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীকে পরাস্ত করে এবং তাতে আরও লেখা হবে, আমেরিকার সহায়তা নিয়ে আইএসআই আমেরিকাকেই পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছে। (নিউইয়র্ক টাইমস, ১৬ এপ্রিল ২০২১)। ২০ বছরে সামরিক-বেসামরিক মিলে কয়েক আফগান আমেরিকা ভার্সেস তালেবান যুদ্ধের বলি হয়েছে। ২৬ লাখ মানুষ অন্য দেশে শরণার্থী এবং আরও প্রায় এক কোটি অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়ে আছে। এই ত্যাগের কোনো মূল্য রইল না। নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে দেখলাম গত ২০ বছরে আমেরিকার সেনাবাহিনীর জন্য অনুবাদক, গাড়িচালক, অফিস সহকারী ইত্যাদি জায়গায় যেসব কয়েক হাজার আফগান নাগরিক কাজ করেছে, যার শতকরা ৮০ ভাগ নারী, তারা প্রাণভয়ে দেশ ত্যাগ করার জন্য আমেরিকায় দূতাবাসে প্রতিদিন লাইন দিচ্ছে। সবাই মনে করছে তালেবান বাহিনী তাদের কচুকাটা করবে। এবার বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার হুমকির কথা বলি। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে দেড় হাজার বছরের পুরনো বৌদ্ধমূর্তি তালেবান বাহিনী ধ্বংস করে ফেলে। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমারের বৌদ্ধ উগ্রবাদীরা মুসলমানদের ওপর আক্রমণ চালায় এবং সহায় সম্পদ ধ্বংস করে (হিউম্যান রাইট ওয়াচ প্রতিবেদন, জুলাই ২০০২)। নব্বই দশকের এ লেগেসির উদাহরণ এবং জেনারেল হামিদ গুলের কথার সূত্রে বলা যায়, কাবুলের তালেবান সরকার পরোক্ষভাবে পাকিস্তানের নয়, গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সরকার হবে। সেই সূত্রে চীন আসবে এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনে নগদ টাকার চাহিদায় বিনিয়োগের জন্য তালেবান সরকার চীনের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। সংগত কারণে চীনও সেই চেষ্টা করবে। খবরে দেখলাম, তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির জন্য ভারত ইতিমধ্যে যোগাযোগ শুরু করেছে। আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে ভারতের বড় ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে। এই বিনিয়োগ রক্ষায় আগামী দিনের তালেবান সরকার ভারতের সঙ্গে একটা কৌশলী অবস্থান নিলেও নিতে পারে। তবে এর সবকিছুই অনেক যদিও কিন্তুর ওপর নির্ভর করছে। যত যা হোক না কেন ভবিষ্যতের তালেবান সরকারের ওপর পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়েরই প্রাধান্য থাকবে। সেই সূত্রে লস্কর-ই-তৈয়বা এবং জইশ-ই-মুহম্মদের মতো সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠনের জিহাদি তৈরির প্রশিক্ষণের উপযুক্ত জায়গা হবে আফগানিস্তান। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জিহাদিরা আগের মতো কাশ্মীর ও ভারতের মূল ভূখন্ডের ভিতরে নাশকতামূলক তৎপরতা চালানোর চেষ্টা করবে। তাতে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব-সংঘাত বৃদ্ধি পাবে। আফগানিস্তানে ভারত যাতে সুবিধা না পায় সে চেষ্টাই করবে পাকিস্তান। এতদিন ধরে এটাই পাকিস্তান চেয়ে আসছে। সে জন্যই জেনারেল হামিদ গুল বলেছেন, এটা হবে পাকিস্তানের বিজয়।

নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জামায়াত-হেফাজতসহ জঙ্গি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী উৎফুল্ল হবে। আগের মতো আফগানিস্তান হবে এদের হিজরতের জায়গা। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে তালেবান শাসনের সময় বাংলাদেশের বহু জিহাদি সেখানে গিয়েছে প্রশিক্ষণ নিয়েছে এবং কথিত ধর্মীয় নেতারা সে দেশ সফর শেষে বাংলাদেশের পত্রিকায় লিখেছে, আফগানিস্তানে বেহেশত দেখে এলাম। শুধু উপমহাদেশ নয়, উত্তর আফ্রিকা থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সব উগ্রবাদী গোষ্ঠীর প্রশিক্ষণ ও বিশ্রামের জায়গা হবে আফগানিস্তান। সুতরাং খাইবারের অপর প্রান্তে আবার তলেবানি শাসন পুরো অঞ্চলসহ বিশ্ব শান্তির জন্য দুঃসংবাদ।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর