রবিবার, ২২ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

দাতব্যশিল্প : কভিড সাহায্য প্রতারণা

মধ্যমণিদের মধ্যে রয়েছেন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, চিহ্নিত সন্ত্রাসী আর অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তানি আর্মি জেনারেল

প্রতিদিন ডেস্ক

দাতব্যশিল্প : কভিড সাহায্য প্রতারণা

বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে (চীন ছাড়া) ‘ভারতে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের কল্যাণে কাজ করছে’ ভঙ্গি নিয়ে মানবতাবাদীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের পর আত্মসাৎ করার কাহিনি ফাঁস করে দেয় এশিয়ার প্রথম ডিসইনফো ল্যাব নামক ডিজিটাল গবেষণা সংস্থা। এ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হচ্ছে ভুয়া সংবাদ আর প্রচারণার ব্যাপারগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরা। এ পর্যায়ে তারা সম্প্রতি ইসলামের নাম ব্যবহার করে যারা প্রতারণায় লিপ্ত তাদের কুকীর্তি প্রকাশ করে এবং অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে সম্বল করে বাংলাদেশের একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী, চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও পাকিস্তানের অবসরপ্রাপ্ত এক লে. জেনারেল কী কী অনাচার করেছেন তার বর্ণনা দেয়। ‘দাতব্যশিল্প : কভিড সাহায্য প্রতারণা’ শীর্ষক সেই প্রতিবেদন ব্যাপক আলোড়ন তোলে। বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৪ আগস্ট থেকে পর্যায়ক্রমে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করছে। আজ চতুর্থ কিস্তি উপস্থাপন করা হলো : মুসলিম এইড ইউএসএ ও Good Old ‘Lauach Good’ তহবিল সংগ্রহ প্ল্যাটফরম : মুসলিম এইড ইউএসএ ৩০ এপ্রিল ভারতে কভিড-১৯ আক্রান্তদের ত্রাণ দেওয়ার জন্য ‘লাঞ্চ গুড’ প্রচারণা শুরু করে যা তাদের ফেসবুক পেজে পোস্ট করা হয়েছে। একই সঙ্গে তারা ভারতের করোনা আক্রান্তদের সাহায্যার্থে অনুদান চেয়ে বাণিজ্যিক প্রচারণা চালায়। শুধু ‘লাঞ্চ গুড’ প্রচারাভিযানের মাধ্যমে এরা ৭৬ হাজার ৮৮৬ মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেছে। অঙ্কটা তাদের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। এসব তহবিল অন্যান্য প্ল্যাটফরম আর তাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সরাসরি অনুদান নগদে পাওয়া যেত। ‘লাঞ্চ গুড’ শুধু তহবিল সংগ্রহ ও বিতরণের ব্যাপারে অস্বচ্ছ নয়, এটি জামায়াতে ইসলামীর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইমানার মতো মুসলিম এইড ইউএসএ ‘ভারতীয় ভাইদের সাহায্যে’ প্রচারাভিযানের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করেছে। এটা ছিল ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট করার প্রচারণামূলক কপি-পেস্ট উদ্যোগ। এটা একটি ধূর্ত প্রচারাভিযান যা শুধু ভারতের সংকটকেই ঘনীভূত করেনি বরং ইমানার আগের প্রচারাভিযানের পক্ষে সমর্থন জুগিয়েছে।

লক্ষ্যস্থল উপকারভোগী স্থানীয় ও অংশীদারদের ব্যাপারে বিশদ কাজ না করেই যেভাবে তহবিল সংগ্রহ প্রচারাভিযান চালানো হয়েছিল তাতে প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকান্ড তহবিল সংগ্রহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে বাধ্য। অধিকন্তু তহবিল ব্যবহার -সংক্রান্ত প্রত্যাশিত তথ্যাদির পরিবর্তে কিছু ছবি ও সাধারণ তথ্যসংবলিত চিত্র দিয়েই তহবিল ব্যবহার দফতরের দায়িত্ব সম্পন্ন করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মুসলিম এইড ইউএসএ শুধু নয়টি অক্সিজেন ঘনত্বযন্ত্র প্রদানের খবর প্রচার করেছে; এ যন্ত্র আদৌ গ্রাহকের কাছে গেছে কি না তা অনিশ্চিত।

চূড়ান্ত জালিয়াতির প্রদর্শনী : ২৭ মে ২০২১। এ দিন মুসলিম এইড প্রকাশিত এক উপস্থাপনায় তারা দাবি করে, ভারতে একটি রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়েছে। দুটি ছবিও প্রকাশ করা হয় বাহনটির বাহির ও ভিতরের চিত্রের সমন্বয়ে। গভীর পর্যবেক্ষণে ছবি দুটি ভিন্ন বাহনের বলেই প্রতীয়মাণ হয়। ১. প্রথম চিত্রে দরজার কবজা পেছনের বাতির নিচে যা কি না দ্বিতীয় চিত্রে বাতির ওপরে। ২. প্রথম চিত্রটিতে ভিতরের আয়তন ক্ষুদ্র এবং একটি কম্পার্টমেন্ট আছে অথচ দ্বিতীয় চিত্রে ভিতরের আয়তন বড় ও দুটি কম্পার্টমেন্ট আছে। ৩. দুটি চিত্রের বাহন সম্পূর্ণ আলাদা। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এ অ্যাম্বুলেন্সের নম্বর প্লেট হলো অস্থায়ী (MPN-TR)। এ ধরনের গাড়ি মধ্যপ্রদেশের একটি সংস্থা দান করে।

সবকিছু নামমাত্র : মুসলিম এইড ইউএসএ তাদের ইনস্টাগ্রাম পেজে ২৬ মে সাহায্যের ছবি প্রকাশ করেছে যাতে অনুদান প্রদানের ক্ষেত্র নির্বাচন সুযোগ ছিল। যখনই ‘অনুদান তহবিল সংগ্রাহকের’ বক্সে ক্লিক করলে প্রদায়ককে তহবিল সংগ্রাহকের পাতায় নিয়ে যাওয়া হয়।

কাশ্মীর তহবিল সংগ্রহের শুভেচ্ছা : কভিড আক্রান্তের জন্য প্রকৃত সহায়তার কোনো বিবরণ না থাকলেও মুসলিম এইড ইউএসএ ১৭ জুন জম্মু ও কাশ্মীরের করোনা আক্রান্তদের সাহায্যার্থে এক নতুন তহবিল সংগ্রহ প্রচারাভিযান শুরু করেছে। তারা লাঞ্চ গুড দিয়ে জম্মু ও আজাদ কাশ্মীরের জন্য তহবিল সংগ্রহ শুরু করেছে। এখানেও তারা স্থানীয় অংশীদার ও উপকারভোগীদের ব্যাপারে কিছুই উল্লেখ করেনি। সম্পূর্ণ অস্বচ্ছতা ও তহবিল বিতরণের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণের অভাব সত্ত্বেও তারা কুকাজ করেই চলেছে।

২০১৩ সালে শুরু করে মুসলিম এইড ইউএসএ কার্যত ২০১৬ সাল পর্যন্ত সক্রিয় ছিল। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি নিষ্ক্রিয় ছিল। ২০১৯ সালে এর পরিচালনা পর্ষদে নতুন মুখ নিয়ে পুনরায় সক্রিয় হয়। ২০২১ সালের জানুয়ারির আগে তাদের তৎপরতা অনুভূত হয়নি। ঠিক কী কারণে তাদের এ অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন ও পুনঃসক্রিয়তায় ফিরেছিল তা পরিষ্কার নয়। নিষ্ক্রিয় অবস্থায় প্রায় প্রতি বছরই এ সংস্থার পর্ষদ সদস্য পরিবর্তন হয়েছে। যাদের কমপক্ষে একজন করে সংস্থার জন্য বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মোটা অঙ্কের নজরানা পেয়েছে। প্রতিষ্ঠান অভ্যন্তরে জটিলতা চলতে থাকার সময়ও ওয়াকার উদ্দিনসহ কিছু সদস্য ছিল অপরিবর্তনীয়। তারাই মূলত ২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি চালু রেখেছিল। একইভাবে স্যার ইকবাল সেকরাইন এবং সালাউদ্দিন নাসেরউদ্দিন কাজ করেছিল ২০১৫-২০১৬ মূলত মনসুর সাকির নির্দেশনায় চলেছে ২০১৭-২০১৯ পর্যন্ত। একজন কেন্দ্রীয় সদস্য বাসিত খান কোষাধ্যক্ষ ও পর্ষদ সদস্য হিসেবে ছিলেন ২০১৮-২০১৯ যিনি বর্তমানেও মুসলিম এইড ইউএসএর পর্ষদ সদস্য। তিনি প্রধানত অর্থনৈতিক সেবা, কর পরিকল্পনা এবং তহবিল সংগ্রহের তদারকি করেন।

ভুয়া ছবি ও দায়সারা তথ্য : মৃত্যুদন্ডদেশপ্রাপ্ত এক যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মইনুদ্দিন পরিচালিত দাতব্য প্রতিষ্ঠান ভারতে সাহায্য প্রদানের অজুহাতে তহবিল সংগ্রহ করছে। এর যুক্তরাষ্ট্র শাখা ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বহু বছর নিষ্ক্রিয় ছিল। নিষ্ক্রিয়তার সময়ও এর পর্ষদ সদস্যের পরিবর্তন হয়েছিল, যারা মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিক ও সম্মানী নিয়েছে প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য বিশেষ অবদান রাখার অজুহাতে, তারা কোটি কোটি ডলার তহবিল সংগ্রহ করেছিল ভারতে সাহায্য প্রদানের অজুহাতে; কিন্তু বাস্তবে কিছুই বিতরণ করেনি। প্রতারণা ঢাকতে তারা ভুয়া ছবি ও দায়সারা গোছের অপর্যাপ্ত তথ্য উপস্থাপনা করেছে।

 

 

সর্বশেষ খবর