বুধবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

তারেক ও হারিস চৌধুরীকে ফেরানো সম্ভব

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

তারেক ও হারিস চৌধুরীকে ফেরানো সম্ভব

সম্প্রতি কয়েকটি বিশ্বস্ত সংবাদপত্রে এ মর্মে খবর প্রকাশিত হয়েছে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হত্যা মামলার সাজাপ্রাপ্ত অন্যতম আসামি হারিস চৌধুরীর খোঁজ পাওয়া গেছে, সে করোনা আক্রান্ত হয়ে লন্ডনের এক হাসপাতালে, এখন তার সন্তানদের বাড়িতে লন্ডনেই রয়েছে।

খবরটি আমাদের জন্য আশাব্যঞ্জক যে এত দিন পালিয়ে থাকা এ সাজাপ্রাপ্ত খুনের আসামিকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে তার সাজা কার্যকর করার সুযোগ হতে পারে। একই দেশে গ্রেনেড হামলায় সাজাপ্রাপ্ত মূল আসামি তারেক রহমানও অবস্থান করছে।

এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে কোনো অপরাধী একবার দেশ থেকে পালিয়ে গেলে তাকে ফেরত আনা অনেক কঠিন বইকি। তবে এটি অসম্ভব নয়। প্রথমত যে আইনটির কথা উল্লেখ করতে হয় তা হচ্ছে ‘একস্ট্রাডিশন’ আইন যাকে বাংলায় আসামি প্রত্যর্পণ আইন বলা যায়। অনেকে ভুল করে একে বন্দীবিনিময় আইন বলে থাকেন। বন্দীবিনিময় আইন সম্পূর্ণ ভিন্ন তত্ত্ব।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশেই আসামি প্রত্যর্পণ আইন রয়েছে। এ আইন প্রাথমিকভাবে আন্তর্জাতিক আইনের অংশ হলেও বর্তমানে এটি সংশ্লিষ্ট দেশের সাংবিধানিক আইনের পর্যায়ভুক্ত। বিশ্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে সংহতি রক্ষাই আইনের মূল উদ্দেশ্য। তদুপরি কোনো অপরাধী যেন এক দেশ থেকে পালিয়ে আর এক দেশে অভয়ারণ্য না পায় সেটিও এ আইনের উদ্দেশ্য। অতীতে আসামি প্রত্যর্পণ নিয়ে ২০-এর দশকে আন্তর্জাতিক কনভেনশন করার প্রচেষ্টা হয়েছিল, যার অন্যতম ছিল হার্ভার্ড রিসার্চ ড্রাফট কনভেনশন অন একস্ট্রাডিশন।

এ আইনের মূল কথা হলো, কোনো ব্যক্তি একটি দেশে মারাত্মক অপরাধ করে অন্য দেশে পালিয়ে যেন বিচার এড়াতে না পারে, তার নিশ্চয়তা, ভুক্তভোগী দেশ যেন তার বিচারের জন্য তাকে ফিরে পেতে পারে। শুধু বিচারাধীন আসামিই নয়, সাজাপ্রাপ্ত আসামিরাও এ আইনভুক্ত।

তবে এ আইনে অনেক জটিলতা রয়েছে। প্রথমত অনেক ক্ষেত্রেই আসামি প্রত্যর্পণ চুক্তির প্রয়োজন থাকে, দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশসহ বহু দেশের আসামি প্রত্যর্পণ আইনে বলা হয়েছে কোনো আসামিকে এমন দেশে প্রত্যর্পণ করা যাবে না যেখানে পাঠালে তার মৃত্যুদন্ড হতে পারে। আর একটি বিধানে বলা আছে যে রাজনৈতিক অপরাধের কোনো আসামিকে প্রত্যর্পণ করা যাবে না।

বাংলাদেশের সঙ্গে বেশ কটি দেশেরই আসামি প্রত্যর্পণ চুক্তি অথবা সমঝোতা রয়েছে। যদিও এ ধরনের কোনো চুক্তি যুক্তরাজ্যের সঙ্গে নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও যুক্তরাজ্য থেকে আসামি ফিরিয়ে আনতে কোনো বাধা নেই এজন্য যে আসামি প্রত্যর্পণে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আমাদের কোনো চুক্তির প্রয়োজন নেই। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে এমন চুক্তির প্রয়োজন রয়েছে বলে এমনকি অনেক গুণীজনও ভুল কথা বলে থাকেন। তাই আমি কর্তৃত্ব নিয়েই বলতে পারি তাদের এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। বিলেতে য্ক্তুরাজ্য ইমিগ্রেশন অ্যাডভাইজারি সার্ভিসে চাকরির সময় যেসব আইনের ওপর আমার বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছিল, একস্ট্রাডিশন আইন তার অন্যতম এবং সে শিক্ষার আলোকেই আমি কর্তৃত্ব নিয়েই কথা বলছি।

১৯৬৬ সালে কমনওয়েলথ আইনমন্ত্রীদের সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে কমনওয়েলথভুক্ত দেশসমূহে আসামি প্রত্যর্পণের জন্য কোনো চুক্তির দরকার হবে না। সে সিদ্ধান্ত মোতাবেক যুক্তরাজ্য একস্ট্রাডিশন আইনের পাশাপাশি ‘ফিউজিটিড অফেন্ডারস’ আইন প্রণয়ন করেছিল শুধু কমনওয়েলথভুক্ত দেশসমূহের জন্য। সেটিতে বলা হয়েছিল, কমনওয়েলথভুক্ত দেশসমূহে আসামি হস্তান্তর চুক্তি লাগবে না। পরবর্তীকালে যুক্তরাজ্য ‘একস্ট্রাডিশন’ এবং ‘ফিউজিটিড অফেন্ডারস’ নামক দুটি ভিন্ন আইনকে একত্রীভূত করে শুধু ‘একস্ট্রাডিশন’ আইন নামে একটি আইন প্রণয়ন করেছে। বর্তমান আইনটি হচ্ছে ২০০৩ সালের। এ আইন অনুযায়ী যেসব দেশে আসামি প্রত্যর্পণ করা যেতে পারে সেগুলো দুটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। এর ৬৯(২) ধারামতে ২ নম্বর ক্যাটাগরিতে রয়েছে বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশের নাম যেসব দেশে আসামি হস্তান্তর করা যেতে পারে। সেসব দেশে অন্য শর্ত পূরণ সাপেক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আদেশবলে আসামি হস্তান্তর করা যায়। তাই বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো চুক্তির প্রশ্নই আসে না। তবে যুক্তরাজ্য থেকে একস্ট্রাডিশনের ব্যাপারে ব্রিটিশ আদালতের সিদ্ধান্তও অখন্ডনীয়।

একইভাবে আমাদের দেশের ১৯৭৪ সালের একস্ট্রাডিশন আইনের ৪ ধারামতে যেসব দেশের সঙ্গে চুক্তি নেই গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সেসব দেশেও আসামি প্রত্যর্পণ করা যেতে পারে আর সেসব দেশের মধ্যে যুক্তরাজ্য অন্যতম, যার কারণে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যেও আসামি হস্তান্তর সম্ভব অন্যান্য শর্ত পূরণ সাপেক্ষে। ২০০০ সালে আমাদের হাই কোর্ট আবদাল আবেদিন বনাম রাষ্ট্র মামলায় নিশ্চিত আদেশ দিয়ে বলেছিলেন, যুক্তরাজ্যের সঙ্গে একস্ট্রাডিশন চুক্তির প্রয়োজন নেই, অন্য শর্ত পূরণ সাপেক্ষে কোনো আসামিকে যুক্তরাজ্যে হস্তান্তর করা যায়। এ আইনে বিশেষজ্ঞ বলে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়েছিল, আমি তখন একজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে এ মামলায় সরকার পক্ষে হাই কোর্টে উপস্থিত হয়েছিলাম। এ রায়টি ২০০১ সালের বিএলডি নামক ল রিপোর্টে মুদ্রিত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জনাব ফজলে কবির সে সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পদে থেকে এ মামলার দায়িত্বে ছিলেন।

বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্যসহ বহু দেশের একস্ট্রাডিশন আইনে বলা আছে, কোনো আসামিকে এমন কোনো দেশে প্রত্যর্পণ করা যাবে না, যেখানে তার মৃত্যুদন্ড হতে পারে। তবে দেশটি যদি এ মর্মে নিশ্চয়তা দেয় যে আসামিকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হবে না, তাহলে তাকে পাঠানো যেতে পারে। আর একটি যে শর্ত থাকে তা হলো যে রাজনৈতিক অপরাধে দন্ডিত কাউকে হস্তান্তর করা যাবে না। সাম্প্রতিক দশকগুলোয় রাজনৈতিক অপরাধের ব্যাখ্যায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে যার ফলে এখন আর হত্যার অপরাধকে রাজনৈতিক অপরাধ ভাবা হয় না। বিশেষ করে পিনোশের মামলায় সর্বোচ্চ ব্রিটিশ আদালত হাউস অব লর্ডস এ বিষয়টি আরও পরিষ্কার করেছে।

যুক্তরাজ্যসহ (বাংলাদেশ নয়) বহু দেশ ১৯৫১ সালের রিফিউজি কনভেনশনভুক্ত, যাদের ওপর কনভেনশন আরোপিত বিধান হলো যে সব মানুষ বর্ণ, ধর্ম, জাতীয়তা, রাজনৈতিক মতাদর্শ অথবা একটি বিশেষ শ্রেণিভুক্ত হওয়ায় যদি সে তার নিজ দেশে নিপীড়ন (ঢ়বৎংবপঁঃরড়হ)-এর শিকার হয় তবে তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া। তবে উক্ত কনভেনশনে এমন বিধান নেই যে কোনো ব্যক্তিকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হলে তাকে একস্ট্রাডিশন করা যাবে না। বরং কনভেনশনের আর্টিকেল-এ (এফ) এ বলা আছে, আশ্রয়প্রার্থী যদি শান্তির বিরুদ্ধে, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করে থাকে, যুদ্ধাপরাধ করে থাকে, অথবা আশ্রয় চাওয়া দেশে প্রবেশের পূর্বে অন্য কোনো দেশে মারাত্মক অরাজনৈতিক অপরাধ করে থাকে তাহলে সে উক্ত কনভেনশনে প্রদত্ত সুবিধা পাবে না। একটি দেশ তার নিজস্ব নাগরিককেও প্রত্যর্পণ করতে পারে, যেটি বাংলাদেশ করেছিল আবদাল আবেদিনের ব্যাপারে।

অনেক বিজ্ঞজনের মধ্যেও ইন্টারপোল নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। অনেকের ধারণা, এটি জাতিসংঘের পুলিশ বাহিনী, যা মোটেও ঠিক নয়। জাতিসংঘে এর কনসালটেটিভ মর্যাদা রয়েছে বটে, যেমন রয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বহু আন্তর্জাতিক এনজিওর এবং এমনকি কিছু আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির। কিন্তু ইন্টারপোল জাতিসংঘের কোনো সংস্থা নয়। এটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পুলিশ বাহিনীর একটি সমিতি মাত্র। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর কোনো দেশেই এর কোনো বিধিগত অবস্থান বা ক্ষমতা নেই। এটি কোনো দেশেই কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার তো দূরের কথা জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারে না, কেননা তা হবে একটি সার্বভৌম দেশে একটি বাহ্যিক সংস্থার হস্তক্ষেপ, যা কোনো দেশের আইন মেনে নেবে না। ইন্টারপোলের গ্রেফতারি পরোয়ানার যে কথা মাঝেমধ্যে গণমাধ্যমে বলা হয় তা-ও ভুল, কেননা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার মতো কোনো ক্ষমতা ইন্টারপোলের নেই। এর মূল কাজ হচ্ছে বিভিন্ন দেশের পুলিশ বাহিনীকে তথ্য প্রদান, যা দিয়ে সংস্থা আন্তর্জাতিক অপরাধ দমনে কার্যকর ভূমিকা রেখে থাকে। তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী পালিয়ে যাওয়া অপরাধীদের ঠিকানাও পাওয়া যায় যা একস্ট্রাডিশন পদ্ধতি প্রয়োগে প্রয়োজন। তা ছাড়া প্রত্যর্পণ করা অপরাধীদের সংশ্লিষ্ট দেশে পৌঁছে দিতেও প্রত্যর্পক দেশ অনেক সময় ইন্টারপোলের সহায়তা নিয়ে থাকে। একটি দেশে বেসরকারি গোয়েন্দা কোম্পানি যেভাবে দেশের আইন লঙ্ঘন না করে কাজ করে, ইন্টারপোলও তা-ই করে থাকে, কেননা একটি দেশের আইন ইন্টারপোল লঙ্ঘন করতে পারে না। এটি বিভিন্ন রঙের নোটিস ব্যবহার করে তথ্য সরবরাহ করে থাকে।

মোট কথা হলো, যেহেতু তারেক  রহমান ও হারিস চৌধুরী যুক্তরাজ্যে রয়েছে এবং যেহেতু যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আমাদের আসামি প্রত্যর্পণ চুক্তির প্রয়োজন নেই, যেহেতু যুক্তরাজ্যের একস্ট্রাডিশন আইনে বাংলাদেশে আসামি প্রত্যর্পণের বিধান রয়েছে, যেহেতু তাদের মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়নি, যেহেতু তাদের অপরাধ মোটেও রাজনৈতিক ধরনের নয়, তাই তাদের যুক্তরাজ্য থেকে একস্ট্রাডিশন আইন অনুযায়ী ফিরিয়ে আনা সম্ভব এবং এ প্রক্রিয়া এখনই শুরু করা উচিত।

একস্ট্রাডিশন ছাড়াও ডিপোর্টেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেও এমন কোনো ব্যক্তিকে একটি দেশ থেকে ফেরত পাঠানো যায় যে ব্যক্তি পাঠানো দেশের নাগরিক নয়। এটি সংশ্লিষ্ট দেশের ইমিগ্রেশন আইনের অংশ। ব্যক্তিবিশেষের ভিসার মেয়াদ শেষ হলে অথবা সে মিথ্যা বলে ভিসা নিলে অথবা পাঠানো দেশ যদি মনে করে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া সে দেশের জন্য মঙ্গলকর, তাহলে এ প্রক্রিয়া ব্যবহার করা যায়। হোসেন বল এবং সবলেন মামলায় লর্ড ডেনিং এ মর্মে রায় দিয়েছিলেন যে বিদেশি নাগরিককে এমন দেশে ডিপোর্ট করা সম্ভব যে দেশে পাঠানো মানে পরোক্ষভাবে একস্ট্রাডিশন পদ্ধতিই প্রয়োগ করা।

 

চাহাল নামক শিখদের মামলায়, যাদের সবারই যুক্তরাজ্যে স্থায়ী বসবাসের অধিকার ছিল, কিন্তু যারা শিখ আন্দোলনে জড়িত, তাদের যুক্তরাজ্য সরকার ভারতে ডিপোর্ট করার সিদ্ধান্ত নিলে তারা রিটের মাধ্যমে সে সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করলে তৎকালীন সর্বোচ্চ বিচারালয় হাউস অব লর্ডসও তাদের রিট আবেদন খারিজ করেছিলেন। পরে অবশ্য ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত ইউরোপীয় মানবাধিকার কনভেনশনের বিধান অনুযায়ী তাদের পক্ষে রায় দেয়। সুতরাং যেসব ক্ষেত্রে একস্ট্রাডিশন প্রযোজ্য নয়, যথা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা সেখানে ডিপোর্টেশন পদ্ধতিতে পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনা উপযুক্ত ক্ষেত্রে সম্ভব হতে পারে।

 

                লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর