বৃহস্পতিবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে মাদকাসক্তি

প্রিন্সিপাল এম এইচ খান মঞ্জু

ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে মাদকাসক্তি

দেশে মাদকের বিস্তার বেড়ে গেছে। কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা আসক্ত হয়ে পড়ছেন মাদকে। এর প্রতিক্রিয়ার ভয়াবহতা এমনই যে এর সেবনকারী নিজেই নিজের ঘাতক হয়ে উঠতে পারে। উঠতি কিশোরের অনেকে মাদকাসক্ত, যারা খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, মাদক বেচাকেনায়ও জড়িত। ফলে সমাজে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে।

মাদক এখন বাংলাদেশে সামাজিক বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজের বিত্তবান ও প্রভাবশালী পরিবারের সন্তানরাও সর্বনাশা এ নেশার জগৎ ঘিরে গড়ে তোলে বাণিজ্যিক সিন্ডিকেট। মাদকের প্রভাব কমানো যাচ্ছে না। মাদকদ্রব্য সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ায় গ্রামাঞ্চলেও তরুণসমাজে মাদকাসক্তি ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে মাদক সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের প্রধান লক্ষ্য অভিজাত পরিবারের সন্তানরা। পাশাপাশি উঠতি বয়সী কিশোর-তরুণরাও তাদের টার্গেট। মাদকাসক্তরা মাদকের অর্থ জোগাতে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরাসহ অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাটে ‘হাউস পার্টি’র নামে মদ, সিসা, গাঁজা, ইয়াবার সঙ্গে ক্রিস্টাল মেথ বা আইসসহ বিভিন্ন নতুন মাদক সেবনের আড্ডা বসে। ঘরোয়া ‘ডিজে পার্টি’ বা ‘রিক্রিয়েশন পার্টি’র নামে ফ্ল্যাটগুলোয় চালানো হচ্ছে রমরমা মাদক কারবার। এখানে ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের ‘নিউ এক্সপেরিমেন্টের’ নামে লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাই-ইথালামাইড বা এলএসডি, ডাইমিথাইলট্রিপ্টামাইন বা ডিএমটি, গাঁজার কেক, ম্যাজিক মাশরুম ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অনলাইনে মাদক কারবারি চক্রের সঙ্গে মিলে এসব হাউস পার্টির আয়োজক নতুন ধরনের এসব মাদক সরবরাহ করছে। তরুণ-যুবকের বেশ বড় একটা অংশ এ আত্মঘাতী আসক্তির শিকার। তবে মাদকাসক্তি শুধু এ বয়সীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, পূর্ণবয়স্ক, এমনকি শিশু-কিশোরদের মধ্যেও মাদকাসক্তি ছড়িয়ে পড়েছে। মাদকাসক্তির এলাকাও সীমাবদ্ধ নেই, রাজধানী ঢাকা থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম-মফস্বল পর্যন্ত সারা দেশে মাদকাসক্তি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি আইস জব্দের ঘটনাও বেড়েছে। ইয়াবা বা আইসজাতীয় মাদক শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ইয়াবায় অ্যামফিটামিন থাকে ৫ শতাংশ। আর আইসের পুরোটাই অ্যামফিটামিন। এসব মাদক সেবনকারীর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের সমস্যা হতে পারে। মানসিক অবসাদ বা বিষণ্ণতার কারণে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে সেবনকারী। তরুণ প্রজন্মকে বিপথগামী ও উচ্ছৃঙ্খল করে তোলার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করে মাদক। মাদক চোরাকারবারিদের লক্ষ্যই থাকে তরুণ ও যুবক শ্রেণি। তারাই তাদের মাদকের প্রধান খরিদ্দার। তারা নিত্যনতুন মাদক চোরাচালান করে তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তারা ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবা থেকে শুরু করে এখন নতুন সংস্করণ হিসেবে এলএসডি ও গাঁজার কেক নিয়ে আসছে। মাদক ব্যবসায়ীরা অনলাইনে বিভিন্ন গ্রুপ খুলে এসব মাদক বিক্রি করছে। দেখা যাচ্ছে ইয়াবার সঙ্গে এখন এ মাদক যুক্ত হয়ে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বহুদিন ধরেই দেশে ইয়াবার ব্যাপক বিস্তার চলছে। মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ দিয়ে জোয়ারের মতো ইয়াবা দেশে প্রবেশ করছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন ইয়াবা কারবারি তৈরি হচ্ছে।

মাদকের বিস্তারের সঙ্গে জড়িতদের ধরে ও ক্রসফায়ার করে ঠেকানো যাবে না। এর মূল বা গোড়ায় যেতে হবে। এর পেছনে বিভিন্ন ক্ষেত্রের যেসব প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছে তাদের ধরতে হবে। মাদক চোরাকারবারিকে কোনো দলীয় পরিচয় বা প্রভাবশালী বিবেচনায় ছাড় দেওয়া যাবে না। তাহলে মাদকের বিস্তার অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। মাদক ও অপরাধমুক্ত সমাজ গড়তে হলে মানুষের মধ্যে সংশোধন ও সংস্কার আনতে হবে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের জাগরণ ঘটাতে তাদের নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। একই সঙ্গে সমাজ ও পরিবারের অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে।

মাদকের কারবার বন্ধ করা না গেলে সামাজিক-অর্থনৈতিক সব ধরনের স্থিতিই বিঘিœত হবে। তাই মাদকের বিস্তার রোধে কারবারিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। মাদক প্রতিরোধে সরকারকে কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আরও তৎপর হবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। এদিকে রাজধানীতে সক্রিয় আরেক অপরাধী চক্র কিশোর গ্যাং। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় গ্রেফতার বাড়লেও গ্যাং সদস্যদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই সামনে আসছে নতুন নতুন গ্যাংয়ের নাম। আধিপত্য বিস্তার, পথচারীদের হঠাৎ ঘিরে ধরে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যাওয়া, রাস্তায় পরিকল্পিত সংঘাত তৈরির মাধ্যমে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চাঁদাবাজির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। তাই বলছি, সমাজকে অধঃপতন থেকে রক্ষা করতে এসব অপরাধপ্রবণতা যে কোনো মূল্যে বন্ধ করতে হবে।

তথ্যপ্রযুক্তি যত এগোবে এর অপব্যবহার কিংবা প্রযুক্তিকেন্দ্রিক অপরাধ ততই বাড়বে। তাই তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা সম্প্রসারণের পাশাপাশি সাইবার অপরাধ দমনে আমাদের আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে।

অপরাধ নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী সাইবার স্কোয়াড গড়ে তুলতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা যেহেতু গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে যাচ্ছে তাই সারা দেশের থানা পর্যায়ে প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধ দমনের সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানোরও উদ্যোগ নিতে হবে।

                লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর