রবিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বাড়ির উঠানে সমুদ্রের শৈবাল

শাইখ সিরাজ

বাড়ির উঠানে সমুদ্রের শৈবাল

২০১৯ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে আন্তর্জাতিক কৃষি যন্ত্রপাতির মেলায় অংশগ্রহণের জন্য চীনের চিংদাও শহরে অবস্থান করছিলাম। পীত সাগরের তীরবর্তী চিংদাও পুরনো একটি শহর। চিংদাওয়ের ওশান ইউনিভার্সিটির সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে গবেষণার বিষয়ে বিশেষ সুখ্যাতি আছে। সেবার ওশান ইউনিভার্সিটির বেশ কয়েকটি ফ্যাকাল্টি ঘুরে দেখে আসার সুযোগ হয়েছিল। আমার সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল তাদের কাজকর্ম সম্পর্কে জানা-বোঝা, বিশেষ করে সমুদ্রসম্পদ নিয়ে তাদের হালনাগাদ গবেষণার তথ্য সম্পর্কে জানা। সেখানে গিয়ে অনেক রকম তথ্য পেয়েছি। চীনের বিপুল জনসংখ্যার পুষ্টি নিশ্চয়তার একটা বড় ক্ষেত্র সমুদ্র। পুষ্টির পাশাপাশি ব্লু-ইকোনমি তাদের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা। সমুদ্রের সম্পদ রহস্য উন্মোচনে নানাভাবে অগ্রসর হচ্ছেন তারা। অনেক সিনিয়র গবেষক ও প্রফেসরের সঙ্গে কথা হয়। মেরিন ইকোলজি বিভাগের আওতাধীন বেনথোস ল্যাবের মূল গবেষক প্রফেসর জোও হোং বলেছিলেন, ‘সমুদ্রই হবে আগামী পৃথিবীর মানুষের পুষ্টির আধার। শুধু সামুদ্রিক মাছই নয়, সামুদ্রিক শৈবালও প্রচুর পুষ্টিমানসমৃদ্ধ। চীনে সামুদ্রিক শৈবালের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।’ তাঁর কথার সত্যতা পেয়েছি হোটেলে প্রতিবার খাওয়ার টেবিলে। সামুদ্রিক শৈবালে তৈরি কোনো না কোনো খাদ্য উপকরণ আছেই। সামুদ্রিক শৈবালের দারুণ চাহিদার বিষয়টি বুঝতে পেরেছি একটি গ্রোসারি শপে গিয়ে। আগেও হয়তো দেখেছি, কিন্তু শৈবালের প্রাচুর্য বুঝতে পারিনি। ওশান ইউনিভার্সিটি থেকে বের হয়ে যখন গ্রোসারি শপটিতে গেলাম দেখলাম দোকানটির বড় একটি অংশে নানারকম সামুদ্রিক শৈবালের পসরা। নানান রঙের প্যাকেটে সজ্জিত নানা আকারের শৈবাল। সেখানকার জনগোষ্ঠীর দারুণ পুষ্টিকর অপরিহার্য খাদ্য উপাদান হচ্ছে এ শৈবাল।

যত দূর মনে পড়ে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের সূচনায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (BARC) বাংলাদেশে স্পিরুলিনা চাষের সম্ভাবনা নিয়ে একটা কনফারেন্সের আয়োজন করেছিল। এর মাঝে কেটে গেছে ৩০ বছর। ২০১৮ সালের মে মাসে আমাদের দেশের সামুদ্রিক শৈবাল গবেষণা ও মাঠ পর্যায়ে উৎপাদন সাফল্য নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছিলাম। আমাদের বিশাল সমুদ্রসীমা ঘিরে যে ব্লু-ইকোনমির স্বপ্ন রয়েছে সে ক্ষেত্রে সামুদ্রিক শৈবাল একটি সম্ভাবনাময় উপাদান। আমাদের সুদীর্ঘ সমুদ্রসীমা থেকে চাষ ও আহরণ করে বিপুল পরিমাণ সমুদ্র শৈবাল উৎপাদন করা সম্ভব। মনে পড়ছে তারও আগে ২০০৫ সালে প্রথম টোকিওতে সমুদ্রে শৈবাল চাষের দৃশ্য দেখি। যত দূর জানা যায়, ১৬৭০ সালে টোকিও সমুদ্রে সর্বপ্রথম শৈবাল চাষ শুরু হয়। সে চাষ বাণিজ্যিক রূপ নেয় ১৯৪০ সালে। তারপর জাপান, চীন, কোরিয়া, ফিলিপিন্স বিভিন্ন দেশে শৈবাল এক অনন্য অর্থকরী সবজি। যা হোক, সমুদ্রের তটরেখার শৈবাল চাষের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে আমাদের। সবচেয়ে আশার কথা, শুধু সমুদ্রতটেই নয়, এখন দেশের স্থলভাগে অন্য যে কোনো চাষ ব্যবস্থাপনার মতো করে সামুদ্রিক শৈবাল চাষে নেমেছেন আমাদের উদ্যোক্তারা। রাজশাহীর তানোর উপজেলার আমশো গ্রামের রাকিবুল সরকার তেমন একজন উদ্যোক্তা। রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে রুক্ষতার জন্য সাধারণত যে কোনো ফসল চাষের কথাই সেখানে ভাবা যেত না, এখন রীতিমতো সমুদ্র শৈবাল চাষ শুরু করেছেন রাকিবুল। রাকিবুলের বাড়িটি আর দশটি সাধারণ কৃষকের বাড়ির মতোই। বাড়ির সামনে এক টুকরো উঠান। সে উঠানেই পলিথিনে ঘেরা আর সাদা প্লাস্টিকের ছাউনিতে গড়া একটি ঘর। ঘরে প্রবেশ না করলে কেউ বুঝতেই পারবে না সেখানে কী হচ্ছে। ঘরের ভিতর সামান্য উঁচু সিমেন্টের ঘের তোলা একটা চৌবাচ্চা। পলিনেটের ভিতর চৌবাচ্চা দেখে মনে হয়েছিল বোধহয় বায়োফ্লকে মাছ চাষ হচ্ছে। কিন্তু রাকিবুল জানালেন চৌবাচ্চার ১৭ হাজার লিটার পানিতে প্রয়োজনীয় উপাদান মিশিয়ে তৈরি করা হয়েছে সমুদ্রের পানির মতো পরিবেশ। সেখানে চাষ হচ্ছে পুষ্টিকর স্পিরুলিনা। স্পিরুলিনা একটি সামুদ্রিক শৈবাল। পুষ্টিবিদদের দেওয়া তথ্যমতে সমগ্র পৃথিবীতে একক খাদ্য হিসেবে সবচেয়ে বেশি পুষ্টি উপাদান যেসব খাবারে পাওয়া যায় স্পিরুলিনা তাদের মধ্যে অন্যতম। অর্থাৎ এটি একটি সুপার ফুড, মানুষের ব্যবহারের জন্য সর্বাধিক পুষ্টিকর খাদ্য। সাধারণ খাদ্য হিসেবে প্রতি ১০০ গ্রাম স্পিরুলিনায় ৩৭৪ কিলোক্যালরি শক্তি রয়েছে। এতে রয়েছে বিপুল পরিমাণ বিটা ক্যারোটিন, ভিটামিন বি১২, আয়রন ও ফ্যাটি অ্যাসিডসহ টেস মিনারেল GLA-gramma-linolenic Acid যা কেবল মায়ের দুধেই পাওয়া যায়। এ ছাড়া এতে মাছ ও গরুর মাংসের তুলনায় ৩ গুণ এবং ডিমের তুলনায় ৬ গুণ বেশি প্রোটিন। সয়াবিনের তুলনায় ২ গুণ বেশি মিনারেল, আটার চেয়ে ৪ গুণ বেশি ফাইবার বা খাদ্য আঁশ, গাজরের তুলনায় ৫ গুণ ও পালং শাকের তুলনায় ৪০ গুণ বেশি ক্যারোটিন, দুধের তুলনায় ১০ গুণ বেশি ক্যালসিয়াম, পালং শাকের তুলনায় ৬৫ এবং গরুর মাংসের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি আয়রন রয়েছে। রাকিবুল জানালেন স্পিরুলিনা চাষের জন্য তৈরি চৌবাচ্চাটিতে আছে ১৭ হাজার লিটার পানি। এতে তিনি ৩০ লিটার পরিমাণ স্পিরুলিনা সামুদ্রিক শৈবাল ছেড়েছেন। এরপর সেখান থেকে ১৫ দিন অন্তর হারভেস্ট করেন। এতে মাসে ২৫ থেকে ৩০ কেজি পরিমাণ শৈবাল আহরণ করা সম্ভব। রাকিবুল বলেছেন, প্রতি কেজি স্পিরুলিনা ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারছেন। প্রথম ছয় মাসেই তার বিনিয়োগ উঠে এসেছে। রাকিবুলের কাছে আমার প্রশ্ন ছিল- স্পিরুলিনা বাইরের দেশে যেভাবে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে আমাদের দেশে তো সেভাবে শুরু হয়নি। তাহলে কীভাবে তিনি বাজারজাত করছেন? তিনি জানালেন, ইউনানি মেডিসিনসহ ওষুধশিল্পে স্পিরুলিনার খুব কদর। এ ছাড়া পোলট্রি বা গবাদি পশুর খাবারে স্পিরুলিনার ব্যবহার মুরগি ও গবাদি পশুর পুষ্টি চাহিদা মেটাবে। দেশে রঙিন মাছ চাষ বাড়ছে, রঙিন মাছের জন্য স্পিরুলিনা আমদানি করতে হয়। এ ছাড়া বাইরের দেশে স্পিরুলিনার যে পরিমাণ চাহিদা আমরা তা রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি। বুঝলাম বেশ বুঝেশুনেই এ পথে পা বাড়িয়েছেন রাকিবুল। মাত্র ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ করেই ক্ষুদ্র আকারে শৈবাল উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব বলে জানালেন রাকিবুল। তবে এ ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ সূর্যের তাপ খুবই দরকারি। কোনো উদ্যোগে যুক্ত হওয়ার আগে সে বিষয়ে জানা-বোঝা জরুরি। ছোট্ট আকারে পরীক্ষামূলকভাবে স্পিরুলিনা চাষ শুরু করতেই পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি। প্রায় এক বছর সময়ে রাকিবুল শৈবাল উৎপাদন নিয়ে অনেক রকম স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। প্রস্তুতি নিচ্ছেন বড় রকমের। তার বিশ্বাস স্পিরুলিনা চাষের মাধ্যমে তিনি পাল্টে দিতে সক্ষম হবেন তার অর্থনৈতিক অবস্থা।

শুধু রাকিবুল নয়, শৈবাল নিয়ে এমন স্বপ্নযাত্রা শুরুর দৃষ্টান্ত আরও রয়েছে। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে পুষ্টিগুণে ভরপুর সামুদ্রিক শৈবাল স্পিরুলিনা চাষে সাফল্য পেয়েছেন নিভৃত পল্লীর সাত তরুণ উদ্যোক্তাও। তারা কৃত্রিমভাবে স্পিরুলিনা উৎপাদন করে কর্মসংস্থান ও বিদেশে রপ্তানির স্বপ্নও দেখছেন। এ সাত তরুণ উদ্যোক্তা হলেন- ফুলবাড়ী উপজেলার প্রাণকৃষ্ণ গ্রামের সেলিম রেজা, এরশাদ হোসেন, গোলাম ওয়াদুদ, জাকির সরকার, হাসান বাপ্পী, মাসুদ রানা ও ফাতেমা আক্তার মিতু। এরশাদ হোসেনের বাড়ির উঠানে মাত্র ৩ শতাংশ জমির ওপর তৈরি করেছেন স্বপ্নের গ্রিনহাউস। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্পিরুলিনা চাষের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে বাকি ছয়জনকে নিজেই স্পিরুলিনা চাষ করার কৌশল শেখান সেলিম। এখন তাদের স্বপ্ন ও সাফল্য বহুদূর ছড়িয়েছেন। সমুদ্রতট ছাড়াও কৃত্রিমভাবে স্পিরুলিনা উৎপাদনের দারুণ সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে দেশে। শুধু স্পিরুলিনা স্থানীয়ভাবে খাওয়া ও খাদ্য উপকরণে ব্যবহারের কৌশলটি সাধারণ মানুষের জানা দরকার। তা ছাড়া বিদেশে এর রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। আমাদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও কৃষি অর্থনীতিতে এ সমুদ্র শৈবাল রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। আমরা যে ব্লু-ইকোনমির স্বপ্ন দেখছি এ ক্ষেত্রেও দেশে ছড়িয়ে পড়া স্পিরুলিনা উৎপাদনের এ উদ্যোগগুলো রাখতে পারে অনেক বড় ভূমিকা।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর