সোমবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

কর্তৃত্ববাদের প্রতিক্রিয়া ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া

খায়রুল কবীর খোকন

কর্তৃত্ববাদের প্রতিক্রিয়া ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া

আওয়ামী লীগের বড় ও মাঝারি নেতা এবং এ সরকারের মন্ত্রী সাহেবদের বিএনপি-বিরোধী সমালোচনার (‘বিষোদগার’ বলা চলে) ঝাঁজে সমগ্র জাতির কান ঝালাপালা। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের বড়-ছোট সব নেতার প্রলাপ বকার স্বভাবটা বেশ শক্তপোক্তভাবে শেকড় গেড়ে বসেছে এবং তা অবিরাম চলছে।

যে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাদের এমনকি সাধারণ নাগরিকদেরও তো যে কোনো দলের বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে সমালোচনার সহজ-সরল অধিকার রয়েছেই, সেটা তো গণতন্ত্রেরই সংস্কৃতি। তবে অন্যের কাজের সমালোচনার সঙ্গে সঙ্গে পরমতসহিষ্ণুতাও চাই।  কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকেই, সিনিয়র-জুনিয়র, উচ্চশিক্ষিত-স্বল্পশিক্ষিত নির্বিশেষে একটা সংস্কৃতি ভালোভাবেই মনেপ্রাণে ধারণ করেছেন-নিজে তারা সমালোচনা করবেন অন্যের, কিন্তু যুক্তিতর্ক দিয়ে অন্যের সমালোচনার সুষ্ঠু জবাবদানের বদলে তাদের বিরুদ্ধে কটুকাটব্য এবং বিষোদগার করে যাবেন। এটাকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেব ‘ক্ষমতা দখলদার’ আওয়ামী লীগ নেতাদের ‘একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক’ দৃষ্টিভঙ্গি বলে মন্তব্য করেছেন।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী (এবং একজন সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা) অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না একটি প্রধান বাংলা দৈনিকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে (৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত) জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের আমলের আওয়ামী লীগের সঙ্গে বর্তমান আওয়ামী লীগের পার্থক্য প্রসঙ্গে বলেন, ‘আকাশ-পাতাল পার্থক্য’। তিনি আরও বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তর্ক করা যেত; তিনি ভিন্নমত গ্রহণ করতে পারতেন। এখন আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন কমিটির কোনো নেতার সঙ্গেও তর্ক করা যায় না।’ তাঁর এ বক্তব্য শতভাগ সঠিক এবং এসব কারণেই অ্যাডভোকেট পান্না সাহেবের মতো ব্যক্তিদের পক্ষে এ দলটিতে আর থাকা সম্ভব হয়নি। 

কথায় বলে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে (মানে বাতাসেই চলতে পারে সৎ-কর্ম)। ক্ষমতাসীন দল ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের সীমাহীন অনাচারের কেচ্ছা-কাহিনি আপনাআপনি বেরিয়ে যাচ্ছে, অপকর্ম দেশবাসীর চোখে ধুলো দিয়ে ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে ১২ বছরের শাসনামলে ক্ষমতার দাপটে সমগ্র রাষ্ট্র-ব্যবস্থাপনা এক চরম স্বেচ্ছাচারী রূপে আবির্ভূত হয়েছে।

রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাত থেকে মূল ক্ষমতা চলে গেছে আমলাতন্ত্রের হাতে। তার পরিণাম সাম্প্রতিক বরিশাল ট্র্যাজেডি। সেখানে আমলা বনাম আওয়ামী লীগ বরিশাল বিভাগীয় নেতৃত্ব এক রাউন্ড লড়াই হয়ে গেছে। সে যুদ্ধটা চলেছে সরকারি দলের সুদীর্ঘকালের এক গডফাদারতুল্য রাজনীতিকের এক উত্তরাধিকারীর ‘দুর্বৃত্ততুল্য আচরণের’ কারণে। আওয়ামী লীগ শীর্ষ নেতৃত্ব স্বজনতোষণের উদ্দেশ্যে ওইসব ব্যক্তিকে মদদদান করে যান।

এদিকে সারা দেশে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ এদের ভিতরে নেতায় নেতায়, সংগঠকে সংগঠকে যুদ্ধ চলছে। সরকার-সমর্থক এসব সংগঠনের মধ্যে অন্তর্কলহে গত সাড়ে ১২ বছরে কমপক্ষে ২০০ নেতা-কর্মী নিহত হয়েছে আর আহত ও পঙ্গু হয়েছে হাজার হাজার। প্রতি সপ্তাহে এসব সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, চাঁদাবাজির ভাগাভাগি, অবৈধ ঠিকাদারির শেয়ার ভাগাভাগির প্রক্রিয়ায় মারামারি চলছে অবিরাম। তাতে হতাহতও হচ্ছে প্রচুরসংখ্যক। আর সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক নৈরাজ্য। সাম্প্রতিককালের এক ছাত্রলীগ সভাপতির দেড় কোটি টাকা দামের বিলাসবহুল প্রাইভেট কার (‘হ্যারিয়ার’ ইত্যাদি) ব্যবহার এবং কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে বাড়ি বানানোর ঘটনা মুখে মুখে প্রচার হয়েছে। (তাকে অন্যসব অভিযোগে যদিও দল থেকে বিতাড়ন করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে কিন্তু দুর্নীতির মামলা হয়নি, তার অবৈধ সম্পদও রাষ্ট্র পুনরুদ্ধার করে দখলে নিতে পারেনি)। ছাত্রলীগের, যুবলীগের, যুব মহিলা লীগের অধিকাংশ নেতা, এমনকি পাতি নেতার জীবনযাপন অত্যন্ত বিলাসী পর্যায়ের যা বড় বড় শিল্পকারখানার মালিকদেরই মানায়। শুধু চাঁদাবাজির ধান্ধায় কীভাবে এসব চলে? সরকারি দলের নেতারা কি জানেন না সেসব? পাকিস্তান আমলের ষাট দশকের মোনায়েম খানের দালাল-সংগঠন ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশনের (এনএসএফ) পান্ডারাও তো এত টাকা বানানোর কথা ভাবতে পারেনি। তারা মস্তানি করেছে ঠিকই-সেটা লেখাপড়ার ব্যয় নির্বাহে এবং বড় চাকরি বাগানো কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় সিনিয়র শিক্ষকদের ভয় দেখিয়ে নিজ নিজ রেজাল্টটা একটু বেশিমাত্রার ‘ভালো’ করে নেওয়ার উদ্দেশ্যে। এখনকার ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাদের একাংশ যা করে চলেছে তা স্রেফ দুর্বৃত্তায়ন, ভয়ানক সব অপরাধের তৎপরতা।

এর মধ্যে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় বেশ বড় বড় রিপোর্ট ছাপা হয়েছে-সরকারি দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের এক জেলা পর্যায়ের নেতা এবং উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক দীর্ঘকাল ধরে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের চোরাকারবারের হোতা, এ লোকটি একাই প্রায় ২০০ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছে। কীভাবে এ দুর্বৃত্তটি ছাত্রলীগের নেতা হলো? এরকম নেতা কিন্তু সরকারি দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর ভিতরে খুব একটা অভাব নেই, এমনকি মূল দলের ভিতরেও রয়েছে অনেক। কিন্তু তাদের এসব অপরাধকর্ম দমনে কোনো অ্যাকশন তো দেখা যায় না। 

এই যে পর পর তিন টার্ম ক্ষমতায় একটি দল, এর মধ্যে সমাজের সর্বক্ষেত্রে অনাচার কীভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে আর তার জন্য দুর্ভোগে পড়ে দেশের মানুষ কতটা সর্বস্বান্ত হচ্ছে তা তো আর বলার অপেক্ষাই রাখে না। পিরোজপুরের ৫৫ হাজার পরিবার নিজেদের কষ্টার্জিত শ্রমের টাকা এক বাটপাড় কোম্পানির কাছে বিনিয়োগ করে এখন সব হারিয়ে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে আর্তনাদ করছে। ‘ধর্মব্যবসায়ী’ ‘এহসান গ্রুপ’ যে ধর্ম প্রচারের নামে প্রচুর ওয়াজ-মাহফিল করে প্রায় এক দশক ধরে গ্রামীণ মানুষের রক্তজল করা উপার্জনের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে তা কি এ সরকারের কারও চোখে পড়েনি? কেন ঠেকানো গেল না রাগীব আহসান আর তার ভাইদের বদমায়েশ চক্রকে? সেখানকার মানুষের দাবি-এ তথাকথিত ‘এহসান’ গ্রুপ ৫৫ হাজার আমানতকারীর কাছ থেকে উঁচু মুনাফার লোভ দেখিয়ে (প্রতি লাখে মাসে ২ হাজার টাকা মুনাফা) হাজার হাজার কোটি টাকা ‘বিনিয়োগ সঞ্চয়’ তুলে এক ভয়ংকর বাটপাড়ি করেছে। পিরোজপুরের ভুক্তভোগী এসব বিনিয়োগকারীর দাবি-প্রায় এক দশককালে এই ‘এহসান’ চক্র যে টাকা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তুলে নিয়ে আত্মসাৎ করেছে তার পরিমাণ ১৭ হাজার কোটি। সহজেই অনুমেয়, একেক বিনিয়োগকারী ৫ লাখ, ১০ লাখ অবধি এ গোষ্ঠীর ‘ওয়াজ-মাহফিলের’ বড় বড় জালেমের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে দিয়েছে। ৫৫ হাজার বিনিয়োগকারীর দেওয়া মোট অর্থের পরিমাণ কম করে হলেও ৫ হাজার কোটি টাকা (১৭ হাজার কোটি টাকা যদি না-ও হয়) তো হবেই। আট/দশ বছর ধরে এ বদমায়েশ চক্র পিরোজপুর এলাকায় মসজিদ ও মাদরাসাগুলোর লোকজনকে সাথী করে এসব মাসিক সঞ্চয় স্কিমের কিস্তিভিত্তিক পদ্ধতির মাধ্যমে ও এককালীন জমা আমানত হিসেবে সংগ্রহ করে। এ ধরনের আমানত-সংগ্রহকারী অনেক ইবলিশ চক্র এর আগেও এ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সময়ে প্রতারণা করে লাখ লাখ সাধারণ মানুষকে পথে বসিয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র সাধারণ নাগরিকদের অর্থ নিরাপদ রাখতে তার দায়িত্ব পালন করেনি। কারণটাও জানা, যারা রাষ্ট্রের কমকর্তা-কর্মচারী, যাদের ওপরে দায়িত্ব অর্পিত তারা সেই দায়িত্ব পালনে আগ্রহ দেখায়নি, তারা হয় জেগে জেগে ঘুমোচ্ছিল অথবা নিজেরাই ওই দুষ্ট চক্রের কাছ থেকে ‘বখরা’ খেয়েছে।

এখানে একটি বড় প্রশ্ন হলো-পিরোজপুরের সবচেয়ে ‘বাঘা নেতা’ আইন-ব্যবসায়ী তো মহাক্ষমতাধর এক দশককাল, তিনি কোথায় ঘুমোচ্ছিলেন? কেন তিনি এসব অনাচার দেখেও চোখ বুজে ছিলেন? তিনি তো দুই দশকেরও বেশি সময়কাল ধরে আওয়ামী লীগের অতি শক্তিধর নেতা হওয়ার চেষ্টায় মরিয়া। আওয়ামী লীগ সরকারের নেতিবাচক যে কোনো কাজের সমালোচনাকারীর বিরুদ্ধে তিনি তো পারলে ঢাল-তলোয়ার নিয়ে সম্মুখযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে তাঁর ‘জ্ঞান-গর্ভ বক্তব্য’ তো চমৎকার! তিনি কেন এসব অনাচার সামাল দিতে এগিয়ে এলেন না? সেটা তো তাঁর মতো নেতার পবিত্র কর্তব্য।  তিনি সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের নেতাগিরি করেছেন দীর্ঘকাল, তার ওপরে তিনি আরও বড় ক্ষমতাও পেয়েছেন সাম্প্রতিককালে।

তার মানে দাঁড়ায় এই-এসব নেতা দেশের মানুষের কল্যাণ ভাবনা নিয়ে আদৌ চিন্তিত নন, তারা যেনতেনভাবে ক্ষমতার সুফলটা (‘কুফল’ বলাই উত্তম) ভোগ করতে চান। আর এর ফলেই এক প্রকল্পের নামে কমার্স ব্যাংকের ২০০ কোটি টাকা এবং সরকারি ভর্তুকির আরও বিপুল পরিমাণ টাকা লুট করে (ঋণের অর্থে বিনিয়োগের নামে) একজন শাহজাহান বাবলু এখন মধ্যপ্রাচ্যে বালাখানায় বসে রাজা-বাদশার জীবনযাপন করছেন।

ক্ষমতাধর রাজনীতিকদের সহযোগিতা ছাড়া নিশ্চয়ই এসব সম্ভব হয়নি।  এ সবকিছুই হচ্ছে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া এবং পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া।

 

লেখক : বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব এবং সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক।

সর্বশেষ খবর