রবিবার, ৩ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু

তপন কুমার ঘোষ

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু

স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে আমাদের উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। এই আনন্দ-উচ্ছ্বাসের মধ্যেই ঘটে গেল কয়েকটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরদিন যান চলাচলের জন্য সেতু উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে ঢল নামে যানবাহনের। বিশেষ করে মোটরসাইকেলের জট লেগে যায়। পদ্মা সেতুর টোল প্লাজায় পৌঁছতে কারও কারও দু-তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। এহেন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির কথা আঁচ করতে পেরে পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ আগে ভাগেই বেশ কিছু বিধিনিষেধের কথা জানিয়ে দেয়। সেতুর ওপর কোনো যানবাহন থামানো যাবে না। গাড়ি থেকে নেমে হাঁটাচলা করা যাবে না। গাড়ি থামিয়ে সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে ছবি তোলা যাবে না। কিন্তু কে মানে এসব বিধিনিষেধ! এমনিতেই ট্রাফিক নিয়ম-কানুন মানতে আমাদের যত অনীহা। তার ওপর আবার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ‘পদ্মা সেতু’ এতদিনে সত্যি হয়েছে। স্বপ্নপূরণের আবেগ অবদমিত করে রাখা কি মুখের কথা! দেখা গেছে, এক মোটরসাইকেলে তিনজন আরোহী। আরোহীদের অনেকের মাথায় নেই হেলমেট। ছোট ছোট সোনামণিদের নিয়ে পুরো পরিবার গেছেন স্বপ্নের পদ্মা সেতু দেখতে। তাও আবার মোটরসাইকেলে চেপে। ঝুঁকির বিষয়টি আমলে নেননি। বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে বাহন থেকে নেমে সেতুর ওপর হেঁটে বেড়িয়েছেন অনেকে। সেলফি তুলেছেন। ভিডিও করেছেন। দলবেঁধে আড্ডা দিয়েছেন। এমনকি সেতুর রেলিংয়ের ওপর বসে থাকতেও দেখা গেছে অনেককে। 

পদ্মা সেতু উন্মুক্ত করে দেওয়ার প্রথম দিনই সেতুর ওপর দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী দুই যুবক মারা গেছেন। সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, তাদের একজন মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন। অন্যজন পিছনে বসে ভিডিও করছিলেন। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, অতিরিক্ত গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে সামনের সব গাড়িকে ওভারটেক করেন তাঁরা। হঠাৎ চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন। আনন্দ-উচ্ছ্বাসের মধ্যে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার খবর আমাদের ব্যথিত করে।

পদ্মা সেতু নিয়ে যখন সারা দেশ উৎসবে মাতোয়ারা, তখন কিছু মতলববাজ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতে সক্রিয়। টিকটক ভিডিও বানিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়েছেন এক যুবক। আরেক যুবক সেতুতে উঠে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়েছেন! ধৃষ্টতারও একটা সীমা থাকে! যিনি এই কর্মটি করেছেন তিনি হয়তো ভেবেছেন এটা হাসির খোরাক হবে। কিন্তু এই ফাজলামোর কোনো বিনোদন মূল্য নেই। এ ঘটনা নিন্দার। এ নিয়ে আলোচনা করতেও রুচিতে বাধে।

এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির লাগাম টানা জরুরি হয়ে পড়েছিল। শৃঙ্খলা ফেরাতে দ্রুত ব্যবস্থা নেয় সরকার। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় সেতু কর্তৃপক্ষ। নজরদারি বাড়ানো হয়। এর ফলে সেতুতে দ্রুত শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। তবে এটাও ঠিক, এই হঠাৎ সিদ্ধান্তে ভোগান্তিতে পড়েছেন মোটরসাইকেল চালকরা। শিগগিরই এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। সেতুতে রাডার স্পিডগান মেশিন ও সিসি ক্যামেরা বসানোর পরই মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী। স্পিডগান যন্ত্রের মাধ্যমে চলন্ত গাড়ির গতিবেগ পরিমাপ করা যাবে।

দেশের সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় একের পর এক ঝরছে অমূল্য প্রাণ। মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় অকালেই হারিয়ে গেছে কত সম্ভাবনাময় তরুণের জীবন! আহত হয়ে চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন অনেকে। সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করে নিতে বাধ্য হয়েছেন কেউ কেউ। এর যেন কোনো শেষ নেই। এ বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনে সম্পাদকীয় মন্তব্য ছাপা হয়েছে একাধিক। কিন্তু বাইক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন মৃত্যুর পরও কোনো হেলদোল নেই।

বেপরোয়া গতি, ওভারটেকিং, বিপজ্জনক প্রতিযোগিতা, নিয়ম না জানা বা না মানা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা বলার কারণেও দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন অনেকে। দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের বড় অংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। তাদের অধিকাংশই আবার তরুণ। সন্তানের আবদার মেটাতে গিয়ে বা অনেক সময় চাপে পড়ে অনেক অভিভাবক সন্তানের হাতে নামিদামি ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলের চাবি তুলে দেন। দ্রুতগতির এই দ্বিচক্রযান নিয়ে বন্ধুবান্ধব মিলে গতির প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে কিশোর-তরুণরা। গতির ঘোর কাটাতে না পেরে হামেশাই এরা মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়ছে। এদের অনেকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। অভিজ্ঞতাও নেই। সন্তান ঘরে ফিরে না আসা পর্যন্ত অভিভাবকদেরও মনে শান্তি নেই। উদ্বেগের মধ্যে সময় কাটান তাঁরা।

রাজধানীতে মোটরসাইকেল খুব দ্রুতই জনপ্রিয় বাহন হয়ে উঠেছে। এক সময় রিকশার শহর হিসেবে পরিচিত ঢাকা এখন মোটরসাইকেলের শহর। রাজধানীর সড়কগুলোতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মোটরসাইকেল। বর্তমানে সড়কের সক্ষমতার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি মোটরসাইকেল চলাচল করছে ঢাকার রাস্তায়। অবশ্য, অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং বা ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল চালু হওয়ায় কর্মসংস্থান হয়েছে কয়েক লাখ শিক্ষিত যুবকের। গত ৩০ মে বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘রিকশার শহর এখন মোটরসাইকেলের’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে রাজধানীর সড়কে মোটরসাইকেলের দৌরাত্ম্যের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কথায় বলে, ‘আপন বুঝ পাগলেও বোঝে।’ নিজের জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কী আছে! চালক ও আরোহীদের সচেতন হতে হবে। অভিভাবকদের আরও সচেতন হওয়া দরকার। আইন-কানুন না মানার সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আইন প্রয়োগে শৈথিল্য দেখানোর সুযোগ নেই। সবাই সচেতন না হলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল ঠেকানো যাবে না।

                লেখক : পরিচালক, পরিচালনা   পর্ষদ, বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন।

সর্বশেষ খবর