বৃহস্পতিবার, ২০ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

নতুন শ্রমবাজারে শক্তিশালী হবে অর্থনীতি

কর্নেল মেসবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী, বিএসপি

গত জুন মাসে হয়ে গেল ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা। যার ফল বলছে বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। ১৯৭১ সালে সাড়ে ৭ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ তার জনগণের জন্য মৌলিক প্রয়োজন মেটাতেই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিল এবং সে সময় সম্পদের স্বল্পতা, জনসংখ্যার প্রবল চাপ, শিক্ষার নিম্নহার, দারিদ্র্য, খনিজ সম্পদের অপ্রতুলতা এবং নানামুখী প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে পারেনি। তবে বিগত দেড় দশকের পরিকল্পনা ও দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করার চেষ্টার প্রতিফলন ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পেতে শুরু করেছে। প্রবাসী রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি। রেমিট্যান্স প্রাপ্তির দিক থেকে বিশ্বে সপ্তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তানের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। এ বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা মোট জিডিপিতে প্রায় ৬ থেকে ৭ শতাংশ অবদান রাখে। বিশ্বের উল্লেখযোগ্য দেশসমূহ যখন মহামারিতে বিপর্যস্ত তখন বাংলাদেশ পেয়েছিল রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা, ফলে রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলারে। দেশের শ্রমবাজারে প্রতি বছর যুক্ত হচ্ছে ২০ লাখ নতুন শ্রমশক্তি, যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশই পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। বিশ্বে চলমান অর্থনৈতিক অস্থিরতা, শ্রমবাজারে নীতির পরিবর্তন ও প্রযুক্তি আধুনিকায়নের ফলে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রধান উৎসে কাজের পরিধি কমছে। তাছাড়া করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বের শ্রমবাজার আগের তুলনায় অনেক বেশি চাপে রয়েছে। তাই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরকারি ও বেসরকারিভাবে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি, নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান ও কৌশলী কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার। আমদানি বৃদ্ধি ও বিশ্ব অর্থনীতি সংকুচিত হওয়ায় ২০২১ সালে তা ২১.৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। বিশ্বে ১৭২টি দেশে ছড়িয়ে থাকা এক কোটির বেশি প্রবাসীর পাঠানো অর্থে আমরা দেশের আমদানি চাহিদা মেটাই। হিসাবে দেশের সংখ্যা বেশি হলেও আমাদের শ্রমবাজার মূলত মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক। আবার মধ্যপ্রাচ্যের শতকরা ৭৮ ভাগ শ্রমিকের গন্তব্য সৌদি আরব। তবে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কুয়েত, কাতার, ইরাক ও জর্ডানও মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার। এ ছাড়াও সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রুনাই, জাপান, ইতালি, যুক্তরাজ্যের মতো দেশেও উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশি কর্মী রয়েছেন। প্রতি বছর ৮ থেকে ১০ লাখ শ্রমিক দেশগুলোতে ভালো কাজ ও পারিশ্রমিকের আশায় পাড়ি জমায়। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য মতে, ১৯৭৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে গিয়েছেন ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ, যার ৩৩ শতাংশ বেছে নিয়েছে সৌদি আরবকে। ১৯৭৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মোট ২৩ লাখ শ্রমিক পাড়ি জমিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এক সময় বাংলাদেশ জনশক্তি রপ্তানিতে শুধু পুরুষ কর্মীর ওপর নির্ভরশীল থাকলেও ২০১৪ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে নারী শ্রমিক পাঠানোর মাধ্যমে নারীদেরও এ খাতে সংশ্লিষ্ট করা হয়। পুরুষের পাশাপাশি এ পর্যন্ত ৬৮ হাজার ৫৭৯ জন নারী শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত আছেন। নারীদের জন্য উপযুক্ত কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিক রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের উন্নয়নে সরাসরি অংশ নিতে পারবেন।

সাধারণত নির্মাণ শ্রমিক, কল-কারখানার কর্মী, বিক্রয় সহকারী ও গৃহপরিচারিকার কাজে বাংলাদেশ থেকে অধিকসংখ্যক কর্মী মধ্যপ্রাচ্যে যায়। এ ছাড়াও পূর্ব-ইউরোপ, এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের শিল্প খাত ও কৃষি কাজের জন্য প্রতিনিয়ত শ্রমিক রপ্তানির হার বাড়ছে। একজন শ্রমিকের বিদেশ যেতে বিভিন্ন পর্যায় সম্পন্ন করা, গন্তব্য নির্ধারণ, কাজের ধরন, পছন্দ অনুযায়ী কাজ প্রাপ্তি, বেতন, পাসপোর্ট-ভিসার প্রস্তুতি, গন্তব্য দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে জানাশোনা প্রভৃতি বিষয়ে অভিবাসন প্রত্যাশীদের মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম হয় যা কোনো ক্ষেত্রে তাদের বিদেশ গমনের উৎসাহ হ্রাস করে। কভিড পরিস্থিতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতির গ্রাফ নিম্নমুখী। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘দ্য গ্লোবাল রিস্কস রিপোর্ট-২০২২’-অনুযায়ী, কভিডের শুরু থেকে পরিবেশগত ঝুঁকি ও জীবিকার সংকটে রয়েছে বিশ্বের অনেক দেশ, পাশাপাশি দেখা দিয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। বিশ্ব অর্থনীতির সংকটকালীন অবস্থায় বিভিন্ন দেশ খাদ্যপণ্য মজুদ, ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণসহ মেগাপ্রকল্পগুলোর নির্মাণকাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের লাখ লাখ প্রবাসী শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়ছে। বিশ্বে ঘনীভূত হওয়া নতুন অর্থনৈতিক সংকটের এ ঢেউ এসে লেগেছে বাংলাদেশেও। বিশ্বব্যাপী যে সংকট তৈরি হয়েছে তার জন্য বাংলাদেশ মোটেও দায়ী নয় বরং ভুক্তভোগী।

বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ শ্রমবাজার সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। দক্ষ জনশক্তি উৎপাদন ও মধ্যপ্রাচ্য নির্ভরতা বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে প্রবেশের কর্ম-পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। যার অংশ হিসেবে পোল্যান্ড, রোমানিয়া, সিচেলিস, বলিভিয়া, জাপান, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, গ্রিস, ব্রুনাই ইত্যাদি দেশে স্বল্প পরিসরে দক্ষ ও আধাদক্ষ কর্মীরা ক্যাটারিং, নার্স, পোশাক শিল্প, কেয়ারগিভার কাজের জন্য যাচ্ছে। সম্প্রতি নেওয়া উদ্যোগের ফলে দক্ষ ও আধাদক্ষ মিলিয়ে ৫ হাজার ৪০০ বাংলাদেশি শ্রমিক ভিসায় রোমানিয়া যাচ্ছে। গত এপ্রিল-জুলাইয়ের দিকে কর্মী প্রতি সরকারিভাবে ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকার ইমিগ্রেশন ফির বিনিময়ে রোমানিয়ান কনসুল্যার ভিসা মঞ্জুর করেছে। যেখানে বেসরকারিভাবে যেতে চাইলে কর্র্মী প্রতি ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা খরচ হতে পারে। ইতোমধ্যে রোমানিয়ায় এক হাজার কর্মী গেছেন যারা ফার্ম, নির্মাণ ও সেবা খাতে কাজ করছেন। রোমানিয়া সরকার জানিয়েছে তাদের কমপক্ষে ৪০ হাজার কর্মী প্রয়োজন। কর্মী ভিসায় রোমানিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকরা যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে ৬১৫ থেকে ১৪০০ মার্কিন ডলার আয় করতে পারবে। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশ বুলগেরিয়াও বাংলদেশ থেকে দক্ষ পোশাক শ্রমিক আমদানি করতে চায়। তাছাড়া ইতোমধ্যে গ্রিসের সঙ্গেও কর্মী প্রেরণে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। ইউরোপ ও উন্নত দেশগুলো অধিক দক্ষ শ্রমশক্তির খোঁজ করে। চাহিদা অনুযায়ী জোগান দেওয়া সম্ভব হয় না। কেননা অদক্ষ শ্রমিকরা বিদেশ গিয়ে ভাষা ও সংস্কৃতিগত আচরণ নিয়ে সমস্যায় পড়েন। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্স ইউনিটের মতে, ২০২০ সালে বিদেশ যাওয়া কর্মীদের প্রায় ৭৪ শতাংশই অদক্ষ। আর ৩.৬ শতাংশ আধাদক্ষ এবং দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ২৩.৩ শতাংশ যেখানে ২০১৯ সালে দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৪ শতাংশ। তাছাড়া, এ খাতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারত, পাকিস্তান ও ফিলিপাইনের কারণে দিন দিন শ্রমবাজার হারাতে হচ্ছে।

সরকার ২০১৬ সালে মালয়েশিয়ার সঙ্গে জিটুজি প্লাস পদ্ধতিতে মাত্র ৩৭ হাজার টাকায় কর্মী প্রেরণের ব্যবস্থা করলেও তা একসময় বাধাগ্রস্ত হয়। ২০১৮ সালের পর বাংলাদেশি কোনো কর্মীকে শ্রমিক ভিসা দেয়নি মালয়েশিয়া সরকার। কিন্তু সরকারের প্রচেষ্টায় ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আবারও মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর বিষয়ে সমঝোতা হয়, ফলে গত ৮ আগস্ট ৫৩ জন কর্মীর একটি দল মালয়েশিয়া পাঠানোর মাধ্যমে নতুন করে দেশটিতে বাংলাদেশি শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয়। সৌদি সরকার ‘ভিশন ২০৩০’-এর আওতায় শ্রমশক্তির ৭০ শতাংশ অভ্যন্তরীণভাবে জোগান দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। যেখানে তারা পূর্বে শতভাগ চাহিদা পূরণ করত বিদেশ থেকে শ্রমিক আমদানি করে। সৌদি আরবের সঙ্গে কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে ভিশন ২০৩০ প্রকল্পে জনশক্তি রপ্তানি করা গেলে বাংলাদেশি শ্রমবাজার আরও বিকশিত হবে। দীর্ঘ ও মধ্যমেয়াদে সংযুক্ত আরব আমিরাত ‘মেটাভার্স’ সেক্টরে প্রায় ৪০ হাজার লোক নেবে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘কপার ফিটেক’-এর জরিপে দেখা যায়, ২০২২ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত ১০ শতাংশ, বাহরাইন ৯ শতাংশ, ওমান ৬ শতাংশ, কাতার ৪ শতাংশ এবং সৌদি আরব ২ শতাংশ শ্রমবাজার সম্প্রসারিত করবে। ‘বিএমইটি’-এর তথ্য অনুযায়ী গত ছয় মাসে কর্মী প্রেরণের দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশিরাই দখল করেছে ৯৩ শতাংশ বাজার।

বিশ্বের দক্ষ শ্রমিকের দেশগুলোতে কারিগরি শিক্ষা বাধ্যতামূলক, ৫ থেকে ৬ কর্মঘণ্টা, ভালো বেতন, স্বাস্থ্যবীমা, পর্যাপ্ত ছুটি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের মাধ্যমে শ্রমিকের মনোবলকে চাঙা রাখে। জাপান মাত্র ১৫ শতাংশ আবাদযোগ্য ভূমি ও সীমিত খনিজসম্পদ নিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির দ্বিতীয় অবস্থান দীর্ঘদিন ধরে রাখতে পেরেছে দক্ষ জনশক্তির মাধ্যমে। ১৯৫৮ সালেই পাঠ্যপুস্তকে তারা বাধ্যতামূলক প্রযুক্তি শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করে। বাংলাদেশে বর্তমানে ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষা অর্জন করে, ২০৩০ সালে ৩০ শতাংশ এবং ২০৫০ সালে ৫০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে যার অংশ হিসেবে বর্তমানে দেশে ৭০টি (৬৪ টি টিটিসি ও ৬টি আইএমটি) প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কর্মসংস্থান উপযোগী ৫৫টি ট্রেডে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলমান। ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো হতে ৬ লাখ ৮২ হাজার জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। ভাষা প্রশিক্ষণের জন্য জাপানিজ, কোরিয়ান, ইংরেজি, আরবি ও চাইনিজ কোর্স পরিচালিত হচ্ছে যা কর্মীদের অনেকটাই উপযোগী করে দেশের বাইরে পাঠাতে সাহায্য করছে। সারা দেশে ৩৯টি হাইটেক পার্ক স্থাপন করা হচ্ছে; এগুলোর সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয় ঘটাতে পারলে দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে ওঠার পাশাপাশি প্রায় তিন লাখ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং সরকারি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করে ৬ লক্ষাধিক ফ্রিল্যান্সার পরিচয়পত্র গ্রহণের সুযোগ পাবে। ২০২৫ সালে ১০ লাখ আইটি কর্মী সরবরাহ করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

কভিড-১৯ পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক রপ্তানি কমে যেতে পারে ধারণা থেকেই বিকল্প বাজার হিসেবে ইউরোপকে গুরুত্ব দিয়ে ইতোমধ্যে সার্বিয়া, যুগোশ্লাভিয়া ও আলবেনিয়ায় বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক যাচ্ছে। দেশগুলো ‘জিটুজি’ চুক্তির মাধ্যমে দক্ষ ও আধাদক্ষ শ্রমিক নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দূরপ্রাচ্যের দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, চীনও সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার। জাপানের বয়স্ক জনগোষ্ঠী বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ ৫ লাখ বিদেশি শ্রমিক নেবে। কিছু ভাষাগত দক্ষতা ও সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেই বাংলাদেশ এ বৃহৎ বাজারের অংশীদার হতে পারে। এ দেশগুলোতে জনশক্তি রপ্তানি করা গেলে মধ্যপ্রাচ্যের তুলনায় বাংলাদেশিরা ভালো বেতন পাবেন। বৈশি^কভাবে উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও মেক্সিকোর মতো দেশগুলোর দিকে সচেতনভাবে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। সরকার আফ্রিকা মহাদেশের বিপুল পরিমাণ খালি উর্বর কৃষিজমি লিজ নেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। এ খাতে আগামী ২০২৭ সাল নাগাদ ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা সম্ভব। উগান্ডা, তাঞ্জানিয়া, কেনিয়া, সেনেগাল, সুদান, সিয়েরালিওন, লাইবেরিয়া, আইভরি কোস্ট ও ঘানায় কয়েক লাখ একর জমি এখনো খালি পড়ে আছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ হতে পারে এ অঞ্চলের ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং’-এর বড় উদাহরণ। কেননা আমাদের আছে প্রচুর দক্ষ কৃষি শ্রমিক যাদের অল্প প্রশিক্ষণ ও খরচে কাজে লাগানো যেতে পারে। বাংলাদেশ ২০০৭ সালে জনমিতিক লভ্যাংশে (Demographic Dividend) প্রবেশ করেছে যার বর্তমান কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ৬৮ শতাংশ। আগামী ৫০ বছরে বিপুল এ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে বিদেশে কর্মসংস্থানের হার বাড়াতে হবে। ভবিষ্যতের বহুল তথ্যনির্ভর বিশ্বে তৈরি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, কম্পিউটার সিস্টেম অ্যানালাইটিকাল, রোবোটিক্স, জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং, বিগ ডাটা অ্যানালিস্ট, সিকিউরিটি এক্সপার্ট, কিউলিনারি সার্ভিসের মতো ফিচারগুলোর জন্য কর্মীবাহিনী তৈরি করার দিকে মনোযোগী হতে হবে। দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলগুলো হতে প্রবাসে পাড়ি জমানোর হার বেশি। গত দেড় দশকে এ অঞ্চল থেকে লাখ লাখ শ্রমিক বিদেশে যাওয়ায় পাল্টে গেছে এ অঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতি। দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে কেন কম মানুষ বিদেশে যাচ্ছে সে ব্যাপারে গবেষণার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। সরকার ঘোষিত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রতি উপজেলা থেকে এক হাজার লোককে বিদেশে পাঠানোর ঘোষণা কার্যকর করার এটাই উপযুক্ত সময়।

লেখক : সামরিক বাহিনীতে কর্মরত।

সর্বশেষ খবর