মঙ্গলবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

একজন সালাহউদ্দিনের অপেক্ষায় ফিলিস্তিনিরা

এম এ মান্নান

একজন সালাহউদ্দিনের অপেক্ষায় ফিলিস্তিনিরা

ফিলিস্তিন অসংখ্য নবী-রসুল মহাপুরুষের দেশ। নবী হজরত দাউদ (আ.) ছিলেন এ দেশের বাদশাহ। তাঁর পুত্র নবী সুলাইমান (আ.)-এর আমলে ফিলিস্তিনের ঐশ্বর্যের কথা ছড়িয়ে পড়ে দুনিয়াজুড়ে। এ পবিত্র ভূমিতে জন্মেছেন হজরত ঈসা (আ.)-এর মতো মহান নবী। মানুষকে ভালোবাসতে উদ্বুদ্ধ করেছেন যিনি। দিয়েছেন হিংসা বর্জনের শিক্ষা। মানবজাতিকে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ করতে যার শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মুসলমানদের কাছে ফিলিস্তিনের জেরুজালেমের ‘মসজিদুল আকসার’ মর্যাদা অসামান্য। নামাজ আদায় বাধ্যতামূলক হওয়ার পর মুসলমানরা মসজিদুল আকসার দিকে ফিরে নামাজ পড়তেন। পরবর্তীতে কাবার দিকে ফিরে নামাজ পড়ার প্রত্যাদেশ আসে আল্লাহর কাছ থেকে। মসজিদুল আকসা মুসলমানদের কাছে তৃতীয় পবিত্র মসজিদ। মক্কার কাবা এবং মদিনার নবীর মসজিদের পর যার স্থান। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐতিহাসিক মিরাজের রাতে মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে জেরুজালেমের মসজিদুল আকসা সফর করেন। কোরআনুল কারিমে এ সফরের কথাই উঠে এসেছে- ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে  রাতের বেলায় মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়েছেন। যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাঁকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ১)

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজ গমনের সময় এই মসজিদে সব নবী-রসুলের জামাতে ইমামতি করে নামাজ আদায় করেন। ‘ইমামুল আম্বিয়া’ সব নবীর ইমাম ও ‘সায়্যিদুল মুরসালিন’ তথা সব রসুলের নেতা হিসেবে স্বীকৃত হন। সপ্তম শতাব্দীতে ফিলিস্তিন মুসলমানদের দখলে আসে। ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে খলিফা ওমর (রা.) সেনাপতি আমর আসকে ফিলিস্তিন দখলে পাঠান। তার আগে খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে সিরিয়ায় জয়ী হয় মুসলিম বাহিনী। ফিলিস্তিনের রাজধানী জেরুজালেমের দিকে মুসলিম বাহিনী এগোতেই নগর ছেড়ে পালিয়ে যান রোমান সেনাপতি ও গভর্নর আরবাতুন। জেরুজালেমের অবরুদ্ধ অধিবাসীরা খলিফা ওমরের উপস্থিতিতে মুসলমানদের কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেন। অকারণ রক্তপাত এড়াতে খলিফা তাতে রাজি হন। সন্ধিপত্রে একদিকে খলিফা ওমর (রা.) অন্যদিকে খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু সাফ্রেনিয়াস স্বাক্ষর করেন। এর ৪৬১ বছর পর ১০৯৯ সালের ৭ জুন খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা  জেরুজালেম অবরোধ করে। ১৫ জুলাই তারা সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে। ওইদিন খ্রিস্টানরা মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। মুসলমানদের রক্তে প্লাবিত হয় মসজিদুল আকসা। স্বাধীনতা হারানোর পর থেকে ফিলিস্তিনের মুসলিমরা একজন নেতার অপেক্ষায় ছিলেন। যে নেতার নেতৃত্বে তারা গোলামির জিঞ্জির থেকে মুক্তি পাবেন। মসজিদুল আকসায় আবারও ধ্বনিত হবে আজান ধ্বনি। খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের দখলে জেরুজালেম চলে যাওয়ার পরের একটি ঘটনা। সে সময় বাগদাদ শহরে এক কাঠমিস্ত্রি বসবাস করতেন। এ কাঠমিস্ত্রি মনের ভালোবাসা দিয়ে কারুকার্যমন্ডিত একটি মিম্বার তৈরি করেন। মিম্বারটির সৌন্দর্যের কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তা দেখতে মানুষ দলে দলে কাঠমিস্ত্রির বাড়িতে আসতে শুরু করে। অনেকেই মিম্বারটি কিনতে চাইলেও কাঠমিস্ত্রি তা বিক্রি করতে রাজি হয়নি। তার একই জবাব- এ মিম্বার বিক্রির জন্য নয়; বরং এটি বানিয়েছি মসজিদুল আকসার জন্য। কাঠমিস্ত্রির কথা শুনে সবাই হাসত। অনেকে তাকে পাগল ভাবত। কিন্তু কাঠমিস্ত্রি তার সিদ্ধান্তে অটল-অবিচল। এক দিন এক ছোট্ট ছেলে তার বাবার হাত ধরে মিম্বারটি দেখতে আসে। কাঠমিস্ত্রির কাছে  সে জানতে পারে তার স্বপ্নের কথা। ছোট্ট ছেলেটি প্রতিজ্ঞা করেছিল- সে কাঠমিস্ত্রির স্বপ্ন পূরণ করবে। সেই ছেলেটি ছিলেন সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী। আর তিনি জেরুজালেম বিজয়ের পর সেই মিম্বারটি মসজিদে আকসা স্থাপন করেন। বর্তমান ইরাকের দজলা ও ফোরাত নদী দুটির মধ্যবর্তী অঞ্চলে তিকরিতে ১১৩৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন কুর্দি বীর সালাহউদ্দিন ইউসুফ ইবনে আইয়ুব। তিনি ছিলেন মিসর ও সিরিয়ার আইয়ুবীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। ৮৭ বছর ধরে খ্রিস্টানদের দখলে থাকার পর ১১৮৭ সালে মুসলিম বীর সিপাহশালার সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর নেতৃত্বে জেরুজালেম শহর মুসলমানদের অধিকারে আসে। প্রথম মহাযুদ্ধে ১৯১৭ সালে ইংরেজরা ফিলিস্তিন দখল করে। তারা ইহুদিদের ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেয়। ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিতে ইহুদিদের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানদের সঙ্গে সংঘর্ষ নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ১৯৪৮ সালের ১৫ মে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েল ১৯৬৭ সালে  ‘মসজিদুল আকসা’ জোরপূর্বক দখল করে নেয়। এরপর থেকে ফিলিস্তিনিরা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েল একের পর এক এলাকা জোরপূর্বক দখল করে ইহুদি বসতি স্থাপন করছে। বর্তমানে গাজা ও পশ্চিম তীরের মসজিদুল আকসা ও জেরুজালেম নগরী দখলদার ইসরায়েলিদের নিয়ন্ত্রণে। গাজায় এখন চলছে গণহত্যা। ফিলিস্তিনিরা এখন গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর মতো একজন সাহসী নেতার অপেক্ষায়। ইতোমধ্যে হামাস প্রমাণ করেছে তারাই পারবে ফিলিস্তিনকে মুক্ত করতে। আল্লাহ ফিলিস্তিনবাসীদের স্বাধীনতা দিন। আমিন।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আমেনা খাতুন হাফেজিয়া কোরআন রিসার্চ অ্যান্ড ক্যাডেট ইনস্টিটিউট কটিয়াদী, কিশোরগঞ্জ

সর্বশেষ খবর