যে হজে নিয়মমাফিক সবকিছু আদায় করা হয়, আল্লাহতায়ালার কাছে তার প্রতিদান একমাত্র জান্নাত। আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে যে হজ করা হয় এবং তাতে লৌকিকতা বা অহংকার থাকে না, নিশ্চয় তা হবে মাকবুল হজ। ইহরাম পরিপন্থি কোনো কাজ যদি সে না করে, তবে সে এই ফজিলত অবশ্যই পাবে। এমনকি হাদিসে এ-ও বলা হয়েছে যে কোনো ব্যক্তি এ বিষয়গুলোর যথাযথ মূল্যায়ন করলে সে নিষ্পাপ শিশুর মতোই ফিরে যাবে। যেন মায়ের উদর থেকে সদ্য জন্ম নিয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
‘যে ব্যক্তি এ ঘরের (বাইতুল্লাহর) হজ আদায় করল, স্ত্রী সহবাস করেনি এবং অন্যায় কোনো আচরণেও জড়ায়নি, সে প্রত্যাবর্তন করবে মাতৃগর্ভ থেকে সদ্যপ্রসূত শিশুর মতোই (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৭০২)।’
মুসলিম শরিফের বর্ণনায় এসেছে-
‘যে ব্যক্তি এই (কাবা) ঘরে (হজের উদ্দেশ্যে) আসে, অতঃপর অশ্লীল এবং দুষ্কর্মও করে না, সে এমন (নিষ্পাপ) হয়ে প্রত্যাবর্তন করে যেন তার জননী তাকে (নিষ্পাপ অবস্থায়) প্রসব করেছেন (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩১৬১)।’
পবিত্র কোরআনের ভাষায়-
‘হজের নির্দিষ্ট কয়েকটি মাস আছে। যে ব্যক্তি সেসব মাসে (ইহরাম বেঁধে) নিজের ওপর হজ আবশ্যক করে নেয়, সে যেন হজের সময়ে কোনো অশ্লীল কথা না বলে, কোনো গুনাহ না করে এবং ঝগড়াও না। তোমরা সৎকর্ম হিসেবে যা কিছু করো আল্লাহতায়ালা তা জানেন। আর (হজের সফরে) পথখরচা সঙ্গে নিয়ে নিও। বস্তুত তাকওয়াই উৎকৃষ্ট অবলম্বন। আর হে বুদ্ধিমানরা! তোমরা আমাকে ভয় করে চলো (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৯৭)।’
এ আয়াতে হজের ইহরামকারীদের জন্য নিষিদ্ধ কাজকর্মের কিছু বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। ইহরাম অবস্থায় যেসব বিষয় থেকে বিরত থাকা একান্ত কর্তব্য ও ওয়াজিব, তা হচ্ছে রাফাস, ফুসুক ও জিদাল। ‘রাফাস’ একটি ব্যাপক শব্দ, যাতে স্ত্রী সহবাস ও তার আনুষঙ্গিক কর্ম, স্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা, এমনকি সহবাসসংক্রান্ত আলাপচারিতাও এর অন্তর্ভুক্ত। ইহরাম অবস্থায় এসবই হারাম।
‘ফুসুক’-এর শাব্দিক অর্থ বের হওয়া বা সীমা অতিক্রম করা। কোরআনের ভাষায় নির্দেশ লঙ্ঘন বা নাফরমানি করাকে ফুসুক বলা হয়। সাধারণ অর্থে যাবতীয় পাপকেই ফুসুক বলা হয়। তাই অনেক ব্যাখ্যাতা এ স্থানে সাধারণ অর্থই নিয়েছেন। কিন্তু হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) এখানে ‘ফুসুক’ শব্দের অর্থ করেছেন ‘সে সকল কাজকর্ম, যা ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ।’ অবস্থার বিচারে এখানে এ ব্যাখ্যাই যুক্তিযুক্ত। কারণ সাধারণ পাপ ইহরামের অবস্থায়ই শুধু নয়, সব সময়ই নিষিদ্ধ।
যেসব বিষয় প্রকৃতপক্ষে নাজায়েজ ও নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু ইহরামের কারণে নিষিদ্ধ ও নাজায়েজ হয়, সেগুলো ছয়টি। ১. স্ত্রী সহবাস ও এর আনুষঙ্গিক যাবতীয় আচরণ, এমনকি খোলাখুলিভাবে সহবাসসংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা। ২. স্থলভাগের জীবজন্তু শিকার করা বা শিকারিকে বলে দেওয়া। ৩. নখ বা চুল কাটা। ৪. সুগন্ধি দ্রব্যের ব্যবহার। এ চারটি বিষয় নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবার জন্য ইহরাম অবস্থায় হারাম। আরও দুটি বিষয় পুরুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ৫. সেলাই করা কাপড় পরিধান, এবং ৬. মাথা ও মুখমণ্ডল আবৃত করা। অবশ্য মুখমণ্ডল আবৃত করা স্ত্রীলোকদের জন্যও নাজায়েজ।
আলোচ্য ছয়টি বিষয়ের মধ্যে স্ত্রী সহবাস যদিও ‘ফুসুক’ শব্দের অন্তর্ভুক্ত, তবু একে ‘রাফাস’ শব্দের দ্বারা স্বতন্ত্রভাবে এজন্য ব্যক্ত করা হয়েছে। ইহরাম অবস্থায় এ কাজ থেকে বিরত থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এর কোনো ক্ষতিপূরণ বা বদলা দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। কোনো কোনো অবস্থায় এটা এত মারাত্মক যে এতে হজই বাতিল হয়ে যায়। অবশ্য অন্য কাজগুলোর কাফফারা বা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আরাফায় অবস্থান শেষ হওয়ার আগে স্ত্রী সহবাস করলে হজ বাতিল হয়ে যায়। গরু বা উট দ্বারা এর কাফফারা দিলেও পরবর্তী বছর আবার হজ করতে হবে। এজন্যই ‘রাফাস’ শব্দ ব্যবহার করে এর স্বাতন্ত্র্যতা বোঝানো হয়েছে।
‘জিদাল’ শব্দিক অর্থে একে অপরকে পরাস্ত করার চেষ্টা করা। এজন্যই বড় রকমের বিবাদকে ‘জিদাল’ বলা হয়। এ শব্দটাও ব্যাপক। কোনো কোনো মুফাসসির এ শব্দের ব্যাপক অর্থই গ্রহণ করেছেন। আবার অনেকে হজ ও ইহরামের সম্পর্কের কারণে এখানে জিদালের অর্থ করেছেন হজের সময়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে। সাধারণ ও ব্যাপক অর্থে ফুসুক, রাফাস ও জিদাল থেকে বারণ করা এবং এসব বিষয়কে হারাম গণ্য করার একটা কারণ এ-ও হতে পারে যে হজের সময় মানুষের অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়ায়, যার ফলে উল্লিখিত বিষয়ে জড়িয়ে পড়ার বেশি আশঙ্কা থাকে।
লেখক : শিক্ষক, বাইতুল আকরাম মসজিদ ও মাদরাসা কমপ্লেক্স, গাজীপুর