সবার বুকেই স্বপ্ন থাকে। হরেক রকম মানুষের অনেক রকম স্বপ্ন। লাল, নীল, হলুদ, কালো ও সবুজ স্বপ্ন। সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্ন হলো কালো গেলাফ আর সবুজ গম্বুজের স্বপ্ন। স্বপ্ন নিয়ে একটি বিখ্যাত কথা আছে। মানুষ যা ঘুমিয়ে দেখে সেটি স্বপ্ন নয়, আসল স্বপ্ন হলো যা সে জেগে দেখে। যাদের বুকে বাইতুল্লাহর স্বপ্ন বোনা, তাদের চোখ ঘুমালেও মন ঘুমায় না। তারা সব সময় মাওলার কাছে কাঁদতে থাকে কাবার ঘর আর রওজা শরিফে হাজির হওয়ার আকুতি নিয়ে। হয়তো পকেটে টাকা নেই, দূর দেশে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই, পাথেয় নেওয়ার মতো সামান নেই; তবু অবুঝ শিশুর মতো মোনাজাতে ডুকরে কেঁদে বলে, মাওলাগো! জীবনে একবার হলেও তোমার ঘর আর নবীজির (সা.) রওজা পাকের সামনে দাঁড়ানোর তাওফিক দিও। স্বপ্নের মতোই দোয়া কবুল হয়ে গেল। কীভাবে যেন বিমানের ডানায় চেপে এখন আপনি বাইতুল্লাহর মুসাফির হয়ে গেলেন। কেউ কেউ হয়তো বলবে, টাকা আছে, হজে এসেছি- এখানে আবার স্বপ্ন কী! না বন্ধু! টাকা থাকলেই সবাই কালো ঘরে হাজির হতে পারে এটা পুরোপুরি ভুল ধারণা। খোঁজ নিয়ে দেখুন, হয়তো আপনারই প্রতিবেশীই পৃথিবীর সব দেশ চষে বেড়িয়েছে, শুধু কালো গেলাফের সামনে এসে দাঁড়ানো হয়নি তার। এমনকি সে এসেছিল সৌদি আরবেও, কিন্তু কাবার অলিগলি ঘোরার ভাগ্য তার হয়নি। হয়নি নবীজির রওজার সামনে দাঁড়ানোর বিরল সৌভাগ্য। আসলে কালো ঘরে হাজির হওয়ার জন্য মনে প্রেম আর বুকে স্বপ্ন থাকতে হয়। নয়তো সব ব্যবস্থা হওয়ার পরও কেউ প্লেনে চড়তে পারে না বা কারও ভিসা জটিলতায় যাওয়া আটকে যায়। হে বাইতুল্লাহর মুসাফির! আল্লাহর শোকর! দীর্ঘ অপেক্ষার পর কালো ঘরের স্বপ্ন সত্যি হয়ে ধরা দিয়েছে আপনার জীবনে। বছরের পর বছর মোনাজাতের কান্না বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে। এখন আপনি সবুজ গম্বুজের মেহমান। বাড়ি ফিরে আসা পর্যন্ত খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে। একটু ভুল, একটু বেয়াদবি আপনার দুনিয়া আখেরাত দুটোই নষ্ট করে দিতে পারে। হজ সফরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে বিষয়টিতে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে তা হলো, ভার্চুয়াল গোনাহ থেকে পুরোপুরি মুক্ত থাকা। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না হাতের মোবাইলটি আর ইন্টারনেট দুনিয়া কীভাবে অতি যত্নে লালন করা কাবা ঘর আর সবুজ গম্বুজের স্বপ্ন ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারে। তাই যে কোনো ধরনের অনলাইন অ্যাক্টিভিটিসহ সেলফি, লাইভ, ফটো, ভিডিও অপ্রয়োজনীয় যত কর্মকাণ্ড আছে, সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলুন এখনই। এক কথায়, দুনিয়ার কোনো কাজই আপনি এখন করবেন না। আপনি পুরোপুরি মৃত। মৃত মানুষের যেমন দুনিয়ার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, আপনারও দুনিয়া নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। আপনি প্রেমিক। প্রেমিক যেমন প্রেয়সী ছাড়া আর কোথাও মনোযোগ দিতে পারে না, আপনিও আল্লাহ-আল্লাহর রসুলের প্রেম সাগরে এমনভাবে ডুব দিন, যেন পৃথিবীবাসী আপনাকে দেখলে চিনতে না পারে, আপনিও পৃথিবীবাসীকে চিনতে না পারেন। যদি হজের দিনগুলো এভাবে দিওয়ানা বেশে কাটাতে পারেন, আপনি সফল। আপনার দুনিয়া-আখেরাত দুটোই সফল। হায়! কেমন সময়ে বসবাস করছি আমরা! হজের এরাদা থেকে শুরু করে হজ শেষ বাড়ি ফেরা পর্যন্ত আমরা ফেসবুক পোস্ট ও লাইভে মজে থাকি। হজের টাকা জমা দেওয়ার সময় ছবি, পাসপোর্ট করার সময় ছবি, ভিসা হাতে এলে ছবি, বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার সময় ছবি, বিমানে উঠে ছবি, কাবার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি, রওজাপাকের সামনে বসে লাইভসহ যত জায়গায় হজের সফরে ‘ভ্রমণ’ করা হয়, সব জায়গায় আমরা দুনিয়াবাসীকে দেখিয়ে বেড়াই। অথচ ইবাদত হওয়ার কথা ছিল গোপনে। সুফিরা বলেন, ইবাদত যত গোপনে হয়, মর্যাদা তত বেশি হয়। আর ইবাদত যত লোক দেখানো হয়, আল্লাহর কাছে সে ইবাদত তত অপছন্দনীয় হয়ে থাকে। জ্ঞাননগরীর দরজা সাইয়েদেনা আলী (রা.) আমাদের সতর্ক করে বলেছেন, ‘ওহে মানব সমাজ! নিজের আমল প্রচার করে বেড়িও না। আমল হলো গোপন রাখার বিষয়। জেনে রাখ! এটাই মুক্তির পথ। যেদিন তোমার মুক্তি নিশ্চিত হবে, সেদিন দুনিয়ার সব আবেদ খুশি হবে আর শয়তান জ¦লে পুড়ে মরবে।’ হজের মৌসুমে দেখা যায়, মানুষ নিজেকে প্রকাশ করার জন্য কত ধরনের বাহানা খুঁজে বেড়ায়। কেউ কেউ ফেসবুকে লেখে, শোকর আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহর কাবাঘর দেখার তাওফিক দিয়েছেন। সবার কাছে দোয়া চাই। আবার কেউ লেখে, নবীজির রওজায় দাঁড়িয়ে কান্না ধরে রাখতে পারছি না। এসব লেখার মাধ্যমে নিজের অজান্তেই রিয়ার গোনাহ হয়ে যায়।
লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর