অপরিপক্ব¡ লিচু এবং আমে বাজার সয়লাব। গত কয়েক দিন ধরে ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র এমনকি দূরপাল্লার বাসেও হকারদের ছোট ছোট লিচুর তোড়া বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে। দেখে যে কারও মনে প্রশ্ন আসবে- এত ছোট ছোট লিচু এখনই বাজারে কেন? এগুলোতে তেমন রস নেই, মিষ্টিও না। আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করলেই এই লিচুগুলো আকারে বেশ বড় হতো এবং অল্প কয়েকটা খেলেই প্রাণ ভরে যেত। অথচ সেই নির্দিষ্ট সময়ের আগেই এগুলো এখন চওড়া দামে বিক্রি হচ্ছে, প্রতারিত হচ্ছে গ্রাহকরা। একইভাবে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই অপরিণত বাজারে প্রচুর আম দেখা যাচ্ছে। এগুলোও তেমন মিষ্টি বা সুস্বাদু নয়। প্রশাসন থেকে নিরাপদ, বিষমুক্ত ও পরিপক্ব আম নিশ্চিত করতে এ বছরের ‘ম্যাঙ্গো ক্যালেন্ডার’ প্রকাশ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী ১৫ মে থেকে সব ধরনের গুটি আম পাড়ার কথা। এ ছাড়া ২০ মে থেকে গোপালভোগ, ২৫ মে থেকে রানীপছন্দ বা লক্ষ্মণভোগ ও ৩০ মে থেকে হিমসাগর বা ক্ষীরসাপাতি, ১০ জুন থেকে ব্যানানা ও ল্যাংড়া, ১৫ জুন থেকে আম্রপালি ও ফজলি, ৫ জুলাই থেকে বারি-৪, ১০ জুলাই থেকে আশ্বিনা এবং ১৫ জুলাই থেকে গৌড়মতী পাড়া যাবে। কিন্তু মনে হচ্ছে কেউই সেটা মানছে না। চলতি বছর রাজশাহীতে ১৯ হাজার ৬০৩ হেক্টর জমিতে আমবাগান আছে। মোট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬০ হাজার ৬ টন। এবার শুধু রাজশাহী জেলা থেকে ১ হাজার ৬৯৫ কোটি ৮৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকার আম বিক্রির সম্ভাবনা। কিন্তু বর্তমানে যেভাবে অপরিপক্ব¡ আম অধিক মূল্য বিক্রি হচ্ছে, তাতে নির্ধারিত আয় হতে পারে বটে কিন্তু সুস্বাদু আমের প্রকৃত স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবে আমপ্রিয় মানুষগুলো।
লিচুর বেলায়ও তাই। অতি মুনাফার আশায় আগেভাগেই লিচুবাগানের মালিক ও অসাধু ব্যবসায়ীরা। দেশের সর্বত্র অপরিপক্ব¡ লিচু সরবরাহ করছেন। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে সুস্বাদু ও রসালো পরিপক্ব¡ লিচু বাজারে আসতে এখনো সময় লাগবে অন্তত ৭ থেকে ১০ দিন। যার মধ্যে থাকবে আগাম জাতের দেশি, মাদ্রাজি ও বোম্বাই লিচু। এর পরপরই বাজারে মিলবে চায়না থ্রি ও বেদানা জাতের লিচু। চলতি বছরে উত্তরবঙ্গের ৪১০ হেক্টর জমির ৫৭০টি বাগানে ৩ হাজার ২৮০ টন লিচু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। এগুলোর আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ৭০ কোটি টাকা। সাধারণত মে মাসের ২০ তারিখের পর বাজারে পরিপক্ব¡ লিচু বিক্রি করার কথা থাকলেও তা এখনই হচ্ছে দেদার। নির্দিষ্ট সময়ের আগে আম, লিচু ও কলা পাকা ও হলুদ করতে ব্যবহার করা হয় বিষাক্ত ইথিলিন বা ক্যালসিয়াম কার্বাইড, যা প্রয়োগের দুই-চার দিনের মধ্যেই ফল হলুদ রং ধারণ করে। আনারস দ্রুত বর্ধন, সুন্দর রং এবং পাকানোর জন্য ব্যবহার করা হয় রাইপেন বা ইথোফেন। তরমুজ পাকা এবং লাল দেখানোর জন্য মেশানো হচ্ছে বিপজ্জনক লাল রং ও মিষ্টি স্যাকারিন। স্থানীয় বাজারে এ ধরনের বিষাক্ত কীটনাশক যেমন রাইপেন, টমটম, প্যানোফিক্স, সুপারফিক্স ইত্যাদি প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে। বাজারের অন্যান্য ফল যেমন আঙুর, বেদানা, পেয়ারা, নাশপাতিসহ অন্যান্য সব ফলেই বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এদিকে বেগুন, শিম, ফুলকপি ও শাকের জমিতে কৃষকরা অতিরিক্ত মাত্রায় বিষাক্ত কীটনাশক ছিটাচ্ছেন। মাছে অতিরিক্ত ফরমালিনের কারণে যেখানে মাছিও বসতে সাহস পায় না, সেখানে সাধারণ মানুষ এগুলো খাচ্ছে মজা করে। সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়াধীন জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের গবেষণাগারে ৮২টি খাদ্যপণ্যের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। সংগৃহীত খাদ্যের ৫২ শতাংশ দূষিত, যা গড়ে ৪০ শতাংশই মানবদেহের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্ধারিত সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৩ থেকে ২০ গুণ বেশি নিষিদ্ধ ডিডিটি, ৩৫ শতাংশ ফল ও ৫০ শতাংশ শাকসবজিতে বিষাক্ত কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। চালের ১৩টি নমুনায় মিলেছে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক, পাঁচটি নমুনায় পাওয়া গেছে ক্রোমিয়াম। হলুদের গুঁড়ার ৩০টি নমুনায় ছিল সিসা ও অন্যান্য ধাতু। লবণেও সহনীয় মাত্রার চেয়ে ২০-৫০ গুণ বেশি সিসা পাওয়া গেছে। মুরগির মাংস ও মাছে পাওয়া গেছে শরীরের জন্য ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব। গরুর মাংসেও বিষাক্ত রং মেশানোর অভিযোগ পুরোনো। অতিব্যবহার্য ভোজ্য তেল সয়াবিনের মধ্যে ৮০ শতাংশে ভেজালের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ভেজালযুক্ত এসব খাদ্যপণ্যের মধ্যে আরও রয়েছে মধু, মিষ্টি, ঘি, রসগোল্লা, ডালডা, দই, সেমাই, ছানা ও ছানার মিষ্টি, চাটনি, জুস, লজেন্স ইত্যাদি। পেঁয়াজু-বেগুনি মচমচে রাখতে মেশানো হচ্ছে পোড়া মবিল-তেল, চকচকে দেখাতে মেশানো হচ্ছে কাপড়ের রং। গুঞ্জন আছে ইনজেকশনের মাধ্যমে ডাবের পানি বের করে সেখানে সাধারণ পানি ভরে দেওয়া হয়। দুধের রং ঠিক রাখতে ও পরিমাণ বাড়াতে ব্যবহার করা হচ্ছে ইউরিয়া।
এভাবে সব ধরনের খাদ্যে কোনো না কোনো বিষাক্ত কীটনাশক মেশানোর ফলে একদিকে যেমন খাদ্যের স্বাভাবিক পুষ্টি ও স্বাদ নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে পাকস্থলীতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং অ্যাসিডের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে সাধারণ খাদ্যের সঙ্গে প্রতিনিয়ত এসব বিষাক্ত কেমিক্যাল খাওয়ার ফলে নানা রকম স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হতে হচ্ছে। মহিলারা বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম দিতে পারেন। শিশুদের স্বল্প মেয়াদে বদহজম, ডায়রিয়া, নাক দিয়ে পানি পড়া, বমি, পেটের পীড়া, পাতলা পায়খানা, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, শরীরের চামড়া-চোখে চুলকানি ইত্যাদি হতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে জন্ডিস, গ্যাস্ট্রিক, লিভার, কিডনি, হৃদরোগ এমনকি মরণব্যাধি ক্যানসারেও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। খাদ্যে ভেজাল রোধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তর তাদের সীমিত লোকবল দিয়ে মাঝেমধ্যে অভিযান চালালেও তা বেশি দিন টেকে না। খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে ২০১৩ সালে ‘নিরাপদ খাদ্য বিল’ পাস হয়। এই আইনে খাদ্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর দায়ে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই যেন ফল পাওয়া যাচ্ছে না। তাই নিষিদ্ধ রাসায়নিক পদার্থের আমদানিকারক ও সরবরাহকারীদের আইনের আওতায় আনতে জোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে কৃষক, ভোক্তা এবং ব্যবসায়ী সবার সচেতনতায় কাক্সিক্ষত ফলাফল পাওয়া যাবে আশা করা যায়।
লেখক : অধ্যাপক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়