ভালো নেই সুন্দরবন। তার সুরক্ষা প্রশ্নবিদ্ধ। বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনে স্থলভাগের পরিমাণ ৪১৪২ দশমিক ৬ বর্গকিলোমিটার। আর জালের মতো ছড়িয়ে থাকা ৪৫০টি নদনদী ও খাল মিলে জলভাগের পরিমাণ ১৮৭৪ দশমিক ১ বর্গকিলোমিটর। সুন্দরবনের এই বিশাল জলভাগ আন্তর্জাতিকভাবে ‘রামসার এলাকা’ হিসেবে স্বীকৃত। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল, মায়াহরিণসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী, ৩১৫ প্রজাতির পাখি, বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতীসহ ছয় প্রজাতির ডলফিন নিয়ে ২৯২ মৎস্য প্রজাতির আবাসস্থল সুন্দরবন। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর সুন্দরবন ২৪ ঘণ্টায় ছয়বার তার রূপ বদলায়। এসব কারণে প্রতি বছর দেশবিদেশের প্রায় আড়াই লাখ প্রতিবেশ পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করে থাকে। সুন্দরবন সন্নিহিত ছয়টি জেলার মানুষকে ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে বুক পেতে রক্ষা করে আসছে। এই ম্যানগ্রোভ বনের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভর করে এসব জেলার লাখ লাখ মানুষের জীবনজীবিকা। আমাজানকে যেমন বিশ্বের ফুসফুস বলা হয়, তেমনি বাংলাদেশের ফুসফুস সুন্দরবন। দেশের সংরক্ষিত বনভূমির ৫১ ভাগের এই অক্সিজেনের অফুরন্ত ভান্ডারই হচ্ছে সুন্দরবন। দিনদিন অস্তিত্বসংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ২৪ ঘণ্টায় দুবার করে সমুদ্রের লোনাপানিতে প্লাবিত এই বনটির প্রাণপ্রকৃতি। ইতোমধ্যে সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে দুই প্রজাতির হরিণ, দুই প্রজাতির গন্ডার, এক প্রজাতির মিঠাপানির কুমির ও এক প্রজাতির বন্য মহিষ। বছরের পর বছর ধরে সুরক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় সংকট বেড়েই চলেছে।
খোদ বন বিভাগের কিছু প্রকল্প সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম বিনষ্ট করেছে। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, ম্যানগ্রোভ প্রজাতির এই বনে ম্যানগ্রোভ গাছ না লাগিয়ে শরণখোলা রেঞ্জের পুড়ে যাওয়া বন এলাকায় রেন্টি গাছ লাগিয়ে বনায়ন করা হয়েছে। ভরাট হয়ে যাওয়া ভোলা নদী খনন করে সেই মাটি ফেলে বনে জোয়ারের পানি ওঠা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে বনের পাশ উঁচু থাকায় অন্যদিক দিয়ে ঢুকে পড়া পানি নামতে না পেরে জলাবদ্ধ হয়ে সুন্দরীসহ গাছপালা মরে ছোটবড় ২৬টি মিঠাপানির বিশাল বিলের সৃষ্টি হয়েছে। নদী ও খালের সঙ্গে নালা কেটে এসব বিলের সংযোগ করে দিয়ে সহজেই জোয়ারের পলি জমে আবারও বন সৃষ্টির কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এই বিল থেকে কৈ, শিং, মাগুর, চিতলসহ বিভিন্ন প্রজাতির মিঠাপানির মাছ আহরণ করার জন্য সহজ হাঁটাপথ বানাতে এখন শুষ্ক মৌসুমে পরিকল্পিতভাবে সুন্দরবনে আগুন লাগানো হয়। এভাবে প্রতি বছর দস্যুদের লাগানো আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে একরের পর একর সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতি। সমীক্ষায় সুন্দরবনবিনাসী ম্যানগ্রোভ নয় এমন অনেক প্রজাতির গাছ ও লতাগুল্ম চিহ্নিত করা হলেও বছরের পর বছর ধরে তা অপসারণ করা হয়নি।
হিমালয়ের দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে প্রাকৃতিকভাবে প্রায় এক লাখ বছর আগে সূচনা হয়েছিল সুন্দরবনের। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ থেকে সুন্দরবনের যাত্রা শুরু হয়। কালের বিবর্তনে সুন্দরবন আবাদ করে জনবসতি গড়ে তোলা ও কৃষিজমি সৃষ্টির ফলে ধীরে ধীরে সংকুচিত হতে থাকে এই বনটি। ১৮২৯ সালে ব্রিটিশ সরকার সর্বপ্রথম সুন্দরবনের বনাঞ্চলের ওপর জরিপ চালানোর পর ১৮৭৮ সালে সমগ্র সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর ১৮৭৯ সালে এই বনটি রক্ষার দায়িত্ব বন বিভাগের হাতে ন্যস্ত করে। বর্তমানে বাগেরহাট ও খুলনা শহরে বিভাগীয় ২টি প্রধান দপ্তর, ৪টি রেঞ্জ অফিস, ১৮টি ফরেস্ট রাজস্ব স্টেশন, ৫৭ বন টহল ফাঁড়িতে প্রায় ৯০০ কর্মকর্তা ও বনরক্ষী থাকার কথা থাকলেও রয়েছে এর প্রায় অর্ধেক জনবল। বন পাহারায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের প্রয়োজন হলেও এখন সরাসরি নিয়োগ না দিয়ে ঠিকাদারের মাধ্যমে অপ্রশিক্ষিত আউট সোর্সিং কর্মীদের কাজে লাগানো হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে বনকর্মীদের রক্ষায় সুন্দরবনের অনেক বন অফিসে এখনো উঁচু পাকা ভবন নির্মাণ করা হয়নি। নেই পর্যাপ্ত অত্যাধুনিক জলযান। জলবায়ু পরিবর্তনে সমুদ্রে পানির উচ্চতা বৃদ্ধিতে অস্তিত্বসংকটে থাকাসহ চোরা শিকারি, আগুন দিয়ে বন পুড়িয়ে দেওয়া ও খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের ফলে সংকটে রয়েছে সুন্দরবনে প্রাণপ্রকৃতি। বঙ্গোপসাগরপাড়ে দুর্গম কর্দমাক্ত এই ম্যানগ্রোভ বনটির অপ্রতুল কর্মকর্তা ও বনরক্ষী নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে সুরক্ষার কাজটি। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংকটে দিনে দিনে বেড়েছে। এখনো সুন্দরবনে আহত বা অসুস্থ বন্যপ্রাণীদের চিকিৎসায় কোনো ভেটেরিনারি হাসপাতাল নেই। লোকালয়ে চলে যাওয়া, বনের মধ্যে আহত বাঘসহ বন্যপ্রাণীদের অনেক দূর থেকে অচেতন করে উদ্ধারে প্রতিটি বন অফিসে নেই ট্যাকুলাজিং অস্ত্র ও নৌ অ্যাম্বুলেন্স কিংবা বনে আগুন নিয়ন্ত্রণে ভাসমান ফায়ার স্টেশন। অসুস্থ বন কর্মকর্তা-বনরক্ষী, পর্যটক ও বনজীবীদের চিকিৎসায়ও নেই কোনো নৌ হাসপাতাল। সুন্দরবন বিভাগ আজও কেনেনি কোনো দুর্ঘটনায় ছড়িয়ে পড়া তেল দ্রুত অপসারণের অয়েল সুইপিং জলযান। এটা দুর্ভাগ্যজনক। আমাদের গর্ব, বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা সুন্দরবন সুরক্ষায় সব সংকটের দ্রুত সমাধান হবে, প্রত্যাশা সবার।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী