প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের সঙ্গে সঙ্গে বরিশালের মানুষের সংস্কৃতিতেও রয়েছে নানা রকমের বৈচিত্র্য এবং সুদীর্ঘ ইতিহাস। প্রায় ৫৫০ বছর আগে আগৈলঝাড়ার গৈলা মনসা মন্দিরে রয়ানি গানের সূচনা হয়। যা এখনো নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ ছাড়াও রয়েছে পুঁথি, জারি, কীর্তন, মুকুন্দ দাসের গণসংগীত এবং ভাটিয়ালী গান। বরিশালকে গানের ক্ষেত্রে জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যারা তারা হলেন ভাষাসৈনিক আবদুল লতিফ, শহীদ আলতাফ মাহমুদ এবং আবদুল গাফফার চৌধুরী। অমর একুশের ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি এখন দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমাদৃত। এ ছাড়াও ভাষাসৈনিক আবদুল লতিফের বিভিন্ন গণসংগীত এবং পল্লীগীতি সবার কাছে ব্যাপক সমাদৃত। এর মধ্যে রয়েছে ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’, নোঙ্গর ছাড়িয়া নায়ের দে, আর কতকাল ভাসব আমি’, ‘সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা’, ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’ ইত্যাদি।
সত্তর দশকে এসব সংগীতের ধারার সঙ্গে যুক্ত হয় বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত আঞ্চলিক গান। প্রথম দিকে দুয়েকটি ভালো গানের সঙ্গে বেশিরভাগই কিছু ভাবাবেগ, কৌতুক, তুছ-তাচ্ছিল্যের উপরেই আঞ্চলিক গান রচনা শুরু হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘কওছেন দেহি এহন মুই এল্হা এল্হা কি হরি’। এর পর আশি এবং নব্বই দশক ছিল বরিশালের আঞ্চলিক গান সৃষ্টির সুবর্ণ সময়। এই এলাকার মানুষের আবেগ অনুভূতি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, খেলাধুলাসহ সব বিষয়ে বরিশালের তিন সংগীতপ্রেমী বন্ধু শিল্পী বশিরুল হক বাদল, গীতিকার ও কবি শ্রী অসিত দাস এবং গীতিকার শ্রী পঙ্কজ কর্মকার মিলে অনেক আঞ্চলিক গান রচনা, সুর এবং গণমানুষের মধ্যে প্রচারের উদ্যোগ নেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘বরিশাল বন্দনা’, ‘এই বরিশালের মাডিরে মুই দেলে দেলে রাহি’, ‘কীর্তনখোলা আইতে যাইতে’, ‘মোগো মেজাজ বোলে কড়া’, ‘ভাবী সাব কইছে মোরে বিয়া হরাইবে’, ‘ডং ডং ডং ডং’, ‘ধান কাডিরে ধান আডি’, ‘ও ঢেহি তোরে দেছে ছোঁয়া’, ‘আর প্যাকনা হইররেন না’ ইত্যাদি। একবিংশ শতাব্দীতে বশিরুল হক বাদল এবং শ্রী অসিত দাসের মৃত্যুর পর তাদের যোগ্য উত্তরসূরি সংগীতশিল্পী, গীতিকার এবং সুরকার জহুরুল হাসান আঞ্চলিক গানের প্রচার-প্রসারে কাজ শুরু করেন। পুরনো গানগুলো সংরক্ষণ, ইউটিউবে (Zohurul Hasan) এবং বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারসহ নতুন নতুন আঞ্চলিক গান রচনার ধারা অব্যাহত রাখতে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। সোহেলের রচিত এবং সুরারোপিত গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘মোরে বোলে দেকতে আইবে ভোলাইয়া পোলা’, ‘তোরে দেকলে কইলজার ভিতরে’, ‘ট্যাক ট্যাক ট্যাক ট্যাক’, ‘মোর উনি চাকরি হরে অপসোনিয়ারে’ ইত্যাদি। ইউটিউবে আপলোড করা সোহেলের গানগুলো প্রচুর দর্শনাথী উপভোগ করেন।
বরিশালের আঞ্চলিক গানের ধারক-বাহক জহিরুল হাসান সোহেল বলেন, অনেক ক্ষেত্রে সস্তা আনন্দ দেওয়া অথবা সহজে বাহবা পাওয়া কিংবা অর্থের জন্য বরিশালের আঞ্চলিক ভাষাকে ব্যবহার করে দুয়েকজন কৌতুক অভিনেতা বা শিল্পী কিছু কিছু সৃষ্টি বাজারে ছেড়েছেন। যার ফলে বরিশালের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তাদের সৃষ্টিগুলো আঞ্চলিক ভাষাকে হেয় করে কুরুচিপূর্ণভাবে করা হয়েছে। মানুষ ভালো সৃষ্টি পেলে এসব কুরুচিপূর্ণ গান এমনিতেই বর্জন করবে বলে ধারণা আঞ্চলিক গানের ধারক সোহেলের। বরিশালের আঞ্চলিক গানের ক্ষেত্রে যারা এর সৃষ্টি এবং প্রসারে কাজ করেছেন তার সবটুকুই ছিল নিজ নিজ উদ্যোগে এবং নিজের ভালো লাগার জন্য। যার ফলে অনেক সম্ভাবনা থাকলেও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পরবর্তীতে বেশিরভাগ শিল্পী, সুরকার বা গীতিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারেননি। সোহেল বলেন, ‘বাংলাদেশ বেতার এবং টেলিভিশনের আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলোতে আঞ্চলিক গানের জন্য আলাদা সময় রাখা, জাতীয়ভাবে এসব আঞ্চলিক সৃষ্টির জন্য মূল্যায়ন এবং জাতীয় পুরস্কারের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় এবং সংগীতানুষ্ঠানে আঞ্চলিক গান অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। একই সঙ্গে সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিষয়ভিত্তিক আঞ্চলিক গানের জন্য সময় এবং বাজেট বরাদ্দ রাখাসহ সংশ্লিষ্ট শিল্পীদের সম্মানিত করার দাবি জানান সোহেল। সোহেল আরও বলেন, শিকড় বাদ দিয়ে যেমন কোনো বৃক্ষ টিকে থাকতে পারে না, তেমনি নিজের সংস্কৃতি, ভাষা এবং শিল্পকে বাদ দিয়ে কোনো জাতি বা গোষ্ঠী তার ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারে না। তাই নিজের যা কিছু আছে তাকে আরও সমৃদ্ধ করা, সঠিক সুন্দর ব্যবহার এবং প্রয়োগের মাধ্যমেই কোনো জাতি বা গোষ্ঠী উৎকর্ষের পথে ধাবিত হয়। সবার কাছে সহজবোধ্য এবং গ্রহণযোগ্য শিল্প কখনোই অগ্রাহ্য হয় না বলে মনে করেন আঞ্চলিক গানের ধারক সোহেল।