সোমবার, ২৬ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধের গান ও তার সংরক্ষণ

মুক্তিযুদ্ধের গান ও তার সংরক্ষণ

মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে জাগরণী সংগীত। যার বাণী ও সুর সাহসী করে তুলেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের।

মুক্তিযুদ্ধের সেসব গানের শিল্পী, সুর, সংগীত ও সংরক্ষণ নিয়ে লিখেছেন—আলী আফতাব

 

আপেল মাহমুদ

মুক্তিযুদ্ধে এঁকেছিল বিধ্বংসী ও অমানবিক দৃশ্যপট। উফ্, কত মৃত্যু, অনাচার-অত্যাচার যে দেখেছি, তা বলে শেষ করা যাবে না। পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতা যারা না দেখেছে তারা কখনো তার ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারবে না। সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্যগুলো মনে গেঁথে রেখেই নেমেছিলাম যুদ্ধের ময়দানে। ‘বিক্ষুব্ধ বাংলা’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা থেকে শব্দসৈনিক হয়েছিলাম। এর পর নানা আয়োজনে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি কণ্ঠে তুলে নিয়েছিলাম গান। গোবিন্দ হালদারের লেখা ও নিজের সুরারোপিত ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’সহ দলীয়ভাবে গেয়েছি ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর’, ‘নোঙর তোলো তোলো’ প্রভৃতি গান। মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করতে গানই ছিল সবচেয়ে বড় শক্তি। বোম্বের [মুম্বাই] শঙ্খনাদ হলে শো করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেছিলাম। এসব কিছুর পেছনে গানই ছিল আমাদের প্রধান পুঁজি, সম্পদ, শক্তি এবং স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখার অবলম্বন। গানে গানে এভাবেই মুক্তিযুদ্ধ করেছি আমরা।

 

সুজেয় শ্যাম

মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রধান অস্ত্র ছিল সংগীত। গানে গানে আমরা সাহস জুগিয়েছি, স্বপ্ন বুনেছি স্বাধীন দেশের। এজন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী, সুরকার ও সংগীত পরিচালকসহ সবাই দিন-রাত নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। কবি দেলওয়ারের ‘আয়রে চাষি মজুর’ গানটি ছিল আমার প্রথম মুক্তিযুদ্ধের আয়োজন। এর পর আরও আটটি গান করেছি। গানে তুলে ধরেছি সাম্য, বিদ্রোহ আর মানবতার কথা। সুর ও সংগীতায়োজনের মধ্য দিয়ে আশার মশাল জ্বালানোর আহ্বান জানিয়েছি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শেষ গান ছিল ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’। একদিক থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গানও এটি। সে কারণে গানটি সৃষ্টির পর সংগীত জীবন সার্থক মনে হয়েছিল। একদিকে বিজয়ের আনন্দ, অন্যদিকে ছিল সৃষ্টি সুখের উল্লাস। একাত্তরের সংগীতযোদ্ধা হিসেবে তাই মাঝে-মধ্যে নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে হয়। এজন্য আজীবন চেষ্টা করে যাব মুক্তিযুদ্ধকালীন গানগুলো আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার। আশার কথা, নতুন প্রজন্মের অনেকে এখন মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে চায়।

 

তিমির নন্দী

মুক্তিযুদ্ধের অনেক গান আছে, যা আজকাল শোনা যায় না। সরকারি অথবা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা কিংবা অ্যালবাম প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধের গানগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নিলে আগামী প্রজন্ম তা শোনার পাশাপাশি যুদ্ধের ইতিহাসটা ভালোভাবে জানার সুযোগ পাবে। আমরা একদিন থাকব না। তখন আমাদের গানগুলো নতুনরা গাইবে—এটুকু প্রত্যাশা করতেই পারি। চাওয়া কেবল একটাই, গানগুলো যেন বিকৃত না হয়। ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি’, ‘স্বাধীন দিকে দিকে’ থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শেষ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গান ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’-এ কণ্ঠ দেওয়ার স্মৃতি কখনো ভোলার নয়। প্রতিটি গানের পেছনে যেমন রয়েছে কত রাত জাগানিয়া গল্প-গান, তেমনি মুক্তিযুদ্ধে রেখে গেছে বিশাল অবদান।’ আমরা চাই, যে গানগুলো মুুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, আজো মনকে আন্দোলিত করে যাচ্ছে তা বেঁচে থাকবে চিরকাল।

 

গাজী মাজহারুল আনোয়ার

মুক্তিযুদ্ধের সময় একেকটি গান একেকটি অস্ত্রের মতো কাজ করেছে। ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি বঙ্গবন্ধুর বলা জয় বাংলাটাই ছিল আমার গানের শুরুর শব্দদ্বয়। এটা নিয়েই শুরু করলাম একদিন। ওই সময় এলেন আনোয়ার পারভেজ। আসার পর ওকে বললাম, আমাদের একটা দায়িত্ব পালন করতে হবে। এটা শুনেই আমার সঙ্গে বসল ও। লেখা চলতে থাকল। হঠাৎ ওই স্টুডিওতে হাজির হলেন আলতাফ মাহমুদ। তিনি গানের শুরুটা শুনেই বললেন, ‘আরে গাজী, এটা দুর্দান্ত গান। লেখ লেখ।’ তার উৎসাহে লেখার গতি বাড়ল।  সে দিনই আমরা গানটা রেকর্ড করলাম। গানটা রেকর্ড করে আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে দিই। এমনি করে ওই সময়ে সৃষ্টি হওয়া একেকটি গান ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা। এখন একমাত্র নতুন শিল্পীরাই পারে এসব গান সঠিকভাবে বাঁচিয়ে রাখতে।

 

রথীন্দ্রনাথ রায়

নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমি কলকাতার বালীগঞ্জের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পৌঁছাই ১৯৭১ সালের জুনের ১৩ বা ১৪ তারিখ। ৫৭/৮ এই দোতলা বাড়িটি সার্বক্ষণিক পাহারা দেওয়া হতো। এদিকে আমি কলকাতার কিছুই চিনি না। অনেক খুঁজে লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে পেয়েছিলাম। গিয়েই আমি তো পরিচিত সবাইকে পেয়ে গেলাম। কামাল লোহানী ভাই, আবদুল জব্বার আংকেল, আপেল মাহমুদসহ সবাই। লোহানী ভাই বললেন, ‘এখানে খাওয়া-থাকা সব ফ্রি। মাসে হাত-খরচ বাবদ ৫০ টাকা পাবি।’ আমি তাতেই রাজি। সেদিন দুপুরের পর একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সন্ধ্যার দিকে আমাকে এসে আপেল ডাকছে ‘মামু ও মামু ওঠ’। আপেল আমার বন্ধু ছিল এবং আমাকে মামু ডাকত। আমার তখনো মাথার মধ্যে ঘুরছে আমি হয়তো পূর্ব পাকিস্তানে আছি। আমি ধড়ফড় করে উঠে বললাম কেন মিলিটারি আসছে নাকি? আমাকে বলল, ‘এখানে মিলিটারি আসবে কোথা থেকে। তুই হাতমুখ ধুয়ে একটু উপরে আয়। আমি একটা গানে সুর করেছি। তোকে একটু টান দিয়ে দিতে হবে।’

 

 

সর্বশেষ খবর