রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

চলচ্চিত্রে কোথাও কেউ নেই

প্রযোজক ♦ পরিচালক ♦ নায়ক ♦ নায়িকা সংকট

চলচ্চিত্রে কোথাও কেউ নেই

ঢাকাই চলচ্চিত্র দীর্ঘদিন ধরে সংকটের বেড়াজালে বন্দী হয়ে আছে। এ শিল্পে চলছে প্রযোজক পরিচালক নায়ক নায়িকা থেকে শুরু করে গল্প সংকট। এসব সংকটে শিল্পটি স্থবির হয়ে আছে। দেখে-শুনে মনে হচ্ছে চলচ্চিত্র শিল্পে কোথাও কেউ নেই। এ বিষয়টি বিস্তারিত তুলে ধরেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

 

ঢাকাই  চলচ্চিত্র নির্মাণ গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে উদ্বেগজনক হারে কমছে। এতে বেকার হচ্ছে নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলী। পর্যাপ্ত ছবির অভাবে ধারাবাহিকভাবে বন্ধ হচ্ছে সিনেমা হল। এ কারণে লগ্নীকৃত অর্থ ফেরত না পাওয়ার আশঙ্কায় প্রযোজকরা এ অঙ্গন থেকে ক্রমেই দূরে সরছেন। চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় সংগঠন হলো প্রযোজক সমিতি। এটি প্রায় সাড়ে সাত বছর ধরে অচল ছিল। এতে সংকট আরও ঘনিভূত হয়। সম্প্রতি এ সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সভাপতি খোরশেদ আলম খসরুর নেতৃত্বে সমিতি পুরনো প্রযোজকদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এ সমিতির বর্তমান সদস্য সংখ্যা প্রায় ৭০০ জন। চলচ্চিত্রের অবস্থা মন্দ হওয়ায় এসব সদস্যের মধ্যে মাত্র ৫ থেকে ৮ শতাংশ কাজ করছেন। তাও আবার অনিয়মিত। অন্যদিকে, ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সদস্য সংখ্যা প্রায় ৩৭৩ জন। লগ্নীকারকের অভাবে অনেক পরিচালকের হাতে কোনো কাজ নেই। শতকরা ৫ থেকে ১০ ভাগ পরিচালক কাজ করছেন। তাও আবার অনিয়মিত।

আগে প্রযোজক আসতেন পরিচালকের কাছে, এখন পরিচালক খুঁজে বেড়ান প্রযোজক। খুঁজে আনা প্রযোজক একটি ছবি করার পর আর নতুন করে বিনিয়োগ করতে চান না। কারণ লাভ দূরে থাক লগ্নীকৃত অর্থ ফেরত আসে না। চলচ্চিত্র ব্যবসায় ধস নামার পেছনে অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। আশির দশক পর্যন্ত নির্মাতারা সরাসরি সিনেমা হল মালিকের কাছে ছবি নিয়ে যেতেন অথবা সিনেমা হল মালিকরা নির্মাতা থেকে সরাসরি ছবি নিতেন। নব্বই দশক থেকে মধ্যস্বত্ত্বভোগী জম্ম নিলে তাদের দাপটে সিনেমাহল মালিক আর নির্মাতা উভয়েই ব্যবসায়িক ক্ষতির কবলে পড়েন। এখন ছবিপ্রতি সর্র্বোচ্চ ব্যবসা মাত্র ৪০ লাখ টাকা। তা হলে কোটি টাকা ব্যয় করে একটি ছবি নির্মাণ করে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে কে আসবেন? বর্তমানে দেশের ১০ শতাংশ নির্মাতা নিয়মিত চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। চলচ্চিত্র-নির্মাতাদের সংগঠন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সদস্যদের তালিকা বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত এ সংগঠনে আজীবন সদস্য ১৭ জন, সাধারণ সদস্য ৩৬৭ জন ও প্রাথমিক সদস্য ১৫০ জন। সংগঠনের মোট সদস্য ৫৩৪ পরিচালকের মধ্যে মারা গেছেন ২১৫ জন। গত পাঁচ বছরের চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নিয়মিত চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন ৩০-৩৫ জন পরিচালক, যা জীবিত ২৮৩ পরিচালকের ১২.৩৭ ভাগ। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি মহাসচিব বদিউল আলম খোকন বলেন, ‘একটা সংগঠন করা হয় তার সদস্যদের সুবিধা-অসুবিধা দেখভাল করার জন্য। ছবি নির্মাণের বিষয়টি তো নির্মাতার ওপরই নির্ভর করে। কর্মজীবনে কে কতটুকু সফলতা পাবে, সেটা তো আর সমিতি নির্ধারণ করে দেবে না। সেটা একদমই নির্মাতার কৃতিত্ব।’ প্রখ্যাত চিত্র নির্মাতা ও সমালোচক  মতিন রহমান জানান, বর্তমানে নির্মাতার হাতে ছবির সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো, যারা একসময় নিয়মিত ছবি প্রযোজনা করতেন, এখন আর তারা করছেন না। ঠিক কতজন প্রযোজক এখন সিনেমা বানাচ্ছেন? প্রযোজক যদি না থাকে, নির্মাতারা ছবি বানাবেন কীভাবে? নির্মাতারা তো মধ্যবর্তী জায়গায় দাঁড়িয়ে আপ্রণ। তারা তো ওয়ার্কার (নির্মাতা)। এখন যারা ফাইনান্স (অর্থায়ন) করেন তারা যদি দূরে সরে থাকেন, তাহলে ওয়ার্কারদের হাতে ওয়ার্ক (কাজ) থাকবে কী করে? কেন বড় বড় প্রযোজকরা ইন্ডাস্ট্রি থেকে সরে গেল? তাদের অভিমানটা কোথায়? যারা এখন কাজ করছে তারাও দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছেন। চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রফেশনালিজমটা এখনো আমরা আনতে পারিনি। কাজেই কত টাকার টিকিট আসলেই বিক্রি হচ্ছে, সেটা আমরা জানতে পারি না। এ বিষয়গুলোতে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য অনেক দিন আগেই সরকারকে জানিয়েছি, কিন্তু সরকারের সব কাজের গতিই খুব ধীর। তাই দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখছি না।’

প্রযোজক-পরিচালকের সংকটের মতো ঢাকাই ছবিতে দীর্ঘদিন ধরে নায়িকা সংকট চলছে। চলচ্চিত্রকারদের কথায় আগের মতো সাড়া জাগানো নায়িকা তৈরি হচ্ছে না। আর এর জন্য দায়ী নির্মাতারা। ঢাকাই চলচ্চিত্রের সূচনালগ্ন থেকেই একসঙ্গে একাধিক নায়িকা রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে দক্ষ অভিনয় দিয়ে সমানভাবে দর্শক মন জয় করে গেছেন। যেমন ষাটের দশকে শবনম, সুচন্দা, সুজাতা, কবরী, শাবানা, ববিতা। আশির দশকে অঞ্জু ঘোষ, রোজিনা, অরুণা বিশ্বাস, দিতি, চম্পা। নব্বইয়ের দশকে শাবনাজ, শাবনূর, মৌসুমী, পপি, পূর্ণিমা। সর্বশেষ জয়া আহসান। চলচ্চিত্র গবেষক ও সাংবাদিক অনুপম হায়াতের কথায় ‘একজন নায়িকা বড়জোর ১০ থেকে ১২ বছর এ চরিত্রে অভিনয় করতে পারেন।

কারণ এ সময়ের পর তার গ্ল­ামার কমতে থাকে। তাই নায়িকা হিসেবে তাদের গ্রহণযোগ্যতা আর থাকে না। এরপর নতুন মুখ প্রয়োজন। আর এ নতুন মুখ আবিষ্কারের দায়িত্ব নির্মাতাদের। যা এখনকার নির্মাতাদের দক্ষতা আর মেধার কারণে হচ্ছে না। নির্মাতারা বলছেন, হাতেগোনা কয়েকজন নায়িকা দিয়ে তো আর ইন্ডাস্ট্রি চলে না। পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, ‘ইন্ডাস্ট্রিতে এখন অনেক নায়িকা আছেন। নতুন অনেকেই আসছেন। তবে দক্ষ অভিনেত্রীর অভাব রয়েছে। হাতেগোনা দুই-একজনের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে নির্মাতাদের।’ ঢাকাই ছবিতে তারকা সংকটও এখন প্রকট। শিল্পীর অভাব নেই। নতুন শিল্পীদের অভিষেক চলছেই। কিন্তু দর্শক গ্রহণযোগ্যতা আর তারকাখ্যাতি পাচ্ছেন না কেউ। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা আজিজুর রহমান বলেন, এখন যারা অভিনয়ে আসছে তারা শুরুতেই এবং সহজেই অর্থবিত্ত আর খ্যাতি পেতে চায়। কেউ অভিনয় শিখেও আসছে না বা শেখার প্রতিও কারও আগ্রহ নেই। মূলত এ কারণে শিল্পী প্রচুর পাওয়া গেলেও তারকার অভাব থেকেই যাচ্ছে। আরেক খ্যাতিমান নির্মাতা মতিন রহমানের কথায়- আগে কাজের প্রতি শিল্পীদের যে ডেডিকেশন ছিল তা এখন কোথায়? এর জন্য নির্মাতারাও দায়ী। তারা দায়সারা গোছের কাজ করেন বলে নতুন যারা অভিনয়ে আসছে তারা ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। আরেক প্রখ্যাত নির্মাতা ও তারকা তৈরির কারিগর সোহানুর রহমান সোহানের কথায়, এখন যারা এ অঙ্গনে আসছে তাদের মধ্যে অভিনয়ে পূর্ব প্রস্তুতি কিংবা নায়কোচিত চেহারা ও আচরণ নেই। ফলে দর্শক গ্রহণযোগ্যতার অভাবে এক-দুটি সিনেমার পরই হারিয়ে যায় তারা। চলচ্চিত্রে শিল্পী সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নতুন মুখ খোঁজার অভিযানে নামা হয়েছে বহুবার। অনেক সময় ব্যক্তিগতভাবেও প্রযোজক-পরিচালকরা নতুন মুখের আগমন ঘটিয়েছেন। কিন্তু এ কার্যক্রমগুলো সুষ্ঠু সমন্বয়ের অভাবে কোনো ইতিবাচক ফল দেয়নি ঢাকাই চলচ্চিত্রকে। শিল্পী সংকট কাটাতে এফডিসির ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ নামে একটি প্রতিভা খোঁজার কার্যক্রমের প্রচলন থাকলেও বর্তমানে এটি একটি কর্মশক্তিহীন প্রকল্প। প্রায় এক যুগ আগে ‘সুপার হিরো-সুপার হিরোইন’ নামে একটি প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেখান থেকেও নির্ভরশীল কোনো শিল্পী বের হয়ে আসেনি। চলচ্চিত্রের শিল্পী সংকট কাটাতে ‘ট্যালেন্ট হান্ট’ নামে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়েছিল। সুষ্ঠু সমন্বয় না থাকায় এ প্রকল্পও চলচ্চিত্রের জন্য ফলপ্রসূ হয়নি। কেন তারকা সংকটে পড়েছে ঢাকার চলচ্চিত্র। কারণ হিসেবে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ মনে করছেন, ভালো পরিচালকের অনুপস্থিতি, প্রসিদ্ধ প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া, বিগ বাজেটে ছবি নির্মাণ না হওয়া, মৌলিক গল্পের অভাব প্রভৃতি। এতে ভালো মানের ছবি তৈরি হচ্ছে না। বেরিয়ে আসছে না নির্ভরশীল তারকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর