বাংলাদেশি টেলিভিশন নাটকের ইতিহাসে এমন কিছু চরিত্র আছে, যেগুলো সময় পেরিয়েও দর্শকের মনের ভিতর অমর হয়ে থাকে। হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘আজ রবিবার’ নাটকের আনিস তেমনই এক চরিত্র। সেই আনিসের রূপদান করেছিলেন অভিনেতা জাহিদ হাসান। একজন সাধারণ চাকরিপ্রার্থী, কিছুটা বিভ্রান্ত, খানিকটা উদ্ভট, কিন্তু একই সঙ্গে অদ্ভুত রকম মায়াবী মানুষ। নাটকটি প্রচারিত হয়েছিল নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, যখন টেলিভিশনে হুমায়ূন আহমেদের লেখার মানে ছিল, বাস্তবতার সঙ্গে হালকা জাদু মেশানো গল্প। ‘আজ রবিবার’ ছিল একদল পরিবারের গল্প, যেখানে প্রতিটি চরিত্র যেন আমাদের আশপাশের কোনো না কোনো মানুষ। কিন্তু আনিস ছিল আলাদা-তার চোখেমুখে একরকম শিশুসুলভ সরলতা, তার কথা আর কাজের ভিতর ছিল অনিয়ন্ত্রিত পাগলামির এক স্বাদ। আনিসের পাগলামি ছিল আসলে জীবনের প্রতি তার অতিরিক্ত ভালোবাসা। সে কখনো চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে সব গুলিয়ে ফেলে, কখনো মিষ্টি হেসে এমন সব কথা বলে ফেলে যা মানুষকে হতবাক করে দেয়। অথচ দর্শক বিরক্ত হয় না, বরং মুগ্ধ হয়।
যে সংলাপগুলো মুখে মুখে
আনিসের বেখেয়ালি ভাব, অপ্রস্তুত হাসি ও অদ্ভুত যুক্তিগুলো যেন হুমায়ূনীয় সংলাপের মধ্য দিয়ে এক মানবিক হাসির জগৎ তৈরি করে। আনিসের প্রতিটি সংলাপ ছিল কৌতুকের ভিতর মমতার সুর। যেমন তার সংলাপগুলো ছিল, ‘আজ রাতের মধ্যে আমাকে লেগোরি থিওরেমটা ভাজা ভাজা করতে হবে...’, ‘চাচাজান, আমি কি পাগল হয়ে গিয়েছি’, ‘তিতলী ভাইয়া তিতলী ভাইয়া আজকে তোমার জন্মদিন, তুমি না বললে কী হবে আমি সব জানি, কংকা ভাইয়া আমাকে সব বলেছে।’ ‘কংকা : কী হয়েছে? আনিস : বুঝতে পারছি না। হলে যাচ্ছিলাম, বড় চাচার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি, ফুটো দিয়ে তাকিয়েছি, তারপর থেকে এ অবস্থা। আর হলে যাচ্ছি না।’, ‘চাঁদ এত বড় হয় না এতটুকু হয়।’, ‘ওরা খুব ভালো মেয়ে’, ‘তিতলি ভাইয়া আস্তে গান গাও আমার ডিস্টার্ব হচ্ছে’, ‘তিতলি ভাইয়া! কংকা ভাইয়া! হিজিবিজি হিজিবিজি...সাপ! সাপ!’
জাহিদ হাসানের স্মৃতিতে ‘আজ রবিবার’
‘আজ রবিবার’ নাটকের দ্বিতীয় পর্বে আনিসের পায়ের ওপর উঠে যাওয়া সেই সাপটা, যেটা দেখে আনিস জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল, সেটা আদতে ছিল বিষধর। এ নাটকের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আনিস (জাহিদ হাসান) বলেছিলেন, ‘হুমায়ূন ভাই (হুমায়ূন আহমেদ) পয়লা বৈশাখের আগে আমাকে ডাকলেন। আমি ভাবলাম তিনি সবাইকে পাঞ্জাবি দিচ্ছেন, হয়তো আমাকেও পাঞ্জাবি দেওয়ার জন্য ডেকেছেন। তো হুমায়ূন ভাই একটা বাক্স খুলে বললেন, জাহিদ বেছে নাও। আমি ভাবলাম আমি মেরুন রঙের একটা পাঞ্জাবি পেয়েছি, অন্য রঙের একটা পাঞ্জাবি বেছে নেব। কিন্তু বাক্সতে তো কোনো পাঞ্জাবি নাই; বাক্স ভর্তি সাপ!’ জাহিদ হাসানের বেছে নেওয়া সাপেই শুটিং শেষ হলো। কিন্তু ইউনিটের কেউ জানত না সাপটা ছিল বিষাক্ত। তিনি বলেন, ‘সাপুড়ে বলেছিল সেটা বিষহীন সাপ। তো শুটিং হলো ঠিকঠাক। কিন্তু সাপের ফুঁসে ওঠার শব্দ নেওয়ার জন্য যখন বুম সাপের কাছে নেওয়া হয় তখন সেটি বুমটাকে পেঁচিয়ে ধরে ফেনা ছেড়ে দেয়। এতে বোঝা যায় সাপে বিষ ছিল। অথচ সাপুড়ে বলেছিল বিষহীন সাপ। এরপর সাপুড়েকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।’
আনিস এক অবিনশ্বর প্রতীক
‘আজ রবিবার’ শুধু একটি নাটক নয়, এটি একসময়ের প্রতিচ্ছবি-যখন পারিবারিক সম্পর্ক, রসিকতা ও মানবিকতার মিশেলে তৈরি হতো গল্প। আনিসের চরিত্র সেই সময়কে নতুন করে চিনতে সাহায্য করেছিল। তার পাগলামি আসলে ছিল সমাজের স্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-একটা নীরব বিদ্রোহ, যেখানে হাসির আড়ালে লুকিয়ে ছিল একাকিত্ব আর মায়া। বছর কেটে গেছে, দর্শক বদলেছে, নাটকের ভাষাও পরিবর্তিত। কিন্তু আনিসের মুখে উচ্চারিত সেই অদ্ভুত সংলাপগুলো আজও আমাদের কানে বাজে।