‘নীলাঞ্জনা, ওই নীল নীল চোখে চেয়ে দেখো না’-এই একটি পঙ্ক্তি শুনলেই আজও কানে বাজে আশির দশকের সেই মিষ্টি কণ্ঠ, যিনি বাংলাদেশের আধুনিক গানে এনেছিলেন নতুন মেলোডির জোয়ার। তিনি শেখ ইসতিয়াক- যাঁকে সংগীতাঙ্গন ডাকত ‘মেলোডি কিং’।
‘নীলাঞ্জনা’ গানের পেছনের গল্প
‘নীলাঞ্জনা’ গানের পেছনের গল্পটিই হয়তো আরও মেলোডিয়াস। ইসতিয়াক তখন নতুন, কিন্তু তাঁর গলার মধ্যে ছিল এমন এক মাদকতা- যা শ্রোতাদের টেনে নিত স্বপ্নের জগতে। ‘নন্দিতা’ অ্যালবামের বাকি গান ‘আমার মনের ফুলদানিতে’, ‘নন্দিতা’-সবই পেয়েছিল সাড়া জাগানো জনপ্রিয়তা। সংগীতপ্রেমীরা একবাক্যে মেনে নিলেন, নতুন এক তারকা এসেছেন, যার নাম শেখ ইসতিয়াক। ১৯৮৬ সাল। মকসুদ জামিল মিন্টুর সুরে প্রকাশিত হয় তরুণ শিল্পী শেখ ইসতিয়াকের অ্যালবাম ‘নন্দিতা’। সময়টা ক্যাসেটের। কিন্তু যেন আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল এই অ্যালবাম। বিশেষ করে ‘নীলাঞ্জনা- গানটি হয়ে ওঠে সময়ের সিগনেচার সং। রেডিও থেকে শুরু করে পথের পাশের দোকান- সবখানে বাজত এই গান। শ্রোতারা মেনে নিলেন, নতুন এক তারকা জন্ম নিয়েছেন, যিনি গানের ভিতর দিয়ে প্রেমকে মেলোডিতে রাঙিয়ে দিতে পারেন।
লাকী আখন্দের শিষ্য, গিটারের জাদুকর
১৯৬০ সালে জন্ম শেখ ইসতিয়াকের। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই তিনি গঠন করেন ব্যান্ড ‘সন্ন্যাসী’। ছোটবেলা থেকেই গান শেখা, ক্লাসিক্যাল সংগীতে তালিম, আর মিউজিক্যাল সেন্স- সব মিলিয়ে ছিলেন একেবারে আলাদা মানের শিল্পী। তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায় যখন যুক্ত হন লাকী আখন্দ, হ্যাপি আখন্দ ও নিলয় দাসের সান্নিধ্যে। লাকী আখন্দের বিখ্যাত গান ‘এই নীল মণিহার’-এর গিটার বাজিয়েছিলেন ইসতিয়াক নিজে। লাকী আখন্দ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘হ্যাপি, নিলয় আর ইসতিয়াক- এই তিনজন ছিল দেশের সেরা গিটারিস্ট।’
জনপ্রিয়তার রহস্য
শেখ ইসতিয়াকের কণ্ঠের মধ্যে ছিল কোমল বিষণ্নতা, যা গানকে পরিণত করত অনুভূতির গল্পে। তিনি সর্বমোট সাতটি একক অ্যালবাম করেছিলেন। এর বাইরে কিছু মিক্সড অ্যালবামে গেয়েছেন।
অজানা ইতিহাসের পরত
বাংলা গানের ইতিহাসে আরেকটা গোপন তথ্য, জনপ্রিয় গান ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’, যা আমরা কুমার বিশ্বজিতের কণ্ঠে চিনি, সেটি প্রথম গেয়েছিলেন শেখ ইসতিয়াক! লাকী আখন্দ আশির দশকের শুরুতে গানটি ইসতিয়াকের কণ্ঠে রেকর্ড করান, যদিও তা কখনো প্রকাশিত হয়নি। এমনকি লাকীর ‘পলাতক সময়ের হাত ধরে’ গানটিও প্রথম তাঁর গলায় রেকর্ড হয়েছিল। লাকী মজা করে বলতেন, ‘ইসতিয়াক কিশোর কুমারের মতো গাইতে চায়!’ তবু তাঁকে ভাইয়ের মতোই স্নেহ করতেন। ইসতিয়াকের মৃত্যুর পর লাকী বলেছিলেন, ‘হ্যাপি চলে যাওয়ার পর এমন ব্যথা আর পাইনি।’
ভালোবাসা আর সংগীতের টানাপোড়েন
১৯৯৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। বয়স মাত্র ৩৯। দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগে ভুগছিলেন শেখ ইসতিয়াক। চিকিৎসকরা বলেছিলেন, অপারেশন করতেই হবে, কিন্তু শর্ত ছিল, এরপর আর গান গাওয়া যাবে না। গান ছিল তাঁর নিঃশ্বাস, তাঁর অস্তিত্ব। তাই অপারেশন করেননি। নিয়মিত ওষুধ খেলেও ভাগ্য এড়াতে পারেননি। সেদিন তাঁর স্ত্রী মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে দরজা বন্ধ দেখে প্রতিবেশীদের সহায়তায় ভাঙতে হয়। ঘরে পড়ে ছিলেন ইসতিয়াক-নিঃশব্দ, কিন্তু গানের আত্মা তখনো ভেসেছিল চারপাশে।
বিদায়ের পরও অনুরণন
মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ অ্যালবাম ছিল ‘তুমি অভিমানী’। মৃত্যুর পর সাউন্ডটেক থেকে প্রকাশিত হয় সংকলন অ্যালবাম ‘নীলাঞ্জনা’। সাউন্ডটেকের কর্ণধার সুলতান মাহমুদ বাবুলের জন্য ইসতিয়াক একটি উপহার কিনে রেখেছিলেন। কিন্তু তা আর দেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে তাঁর স্ত্রী পুনম প্রিয়াম সেই উপহার হাতে তুলে দেন বাবুলকে- আর তিনি কান্না চেপে রাখতে পারেননি।